বাজারভিত্তিক সুদহারেও হস্তক্ষেপ করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক

নিজস্ব প্রতিবেদক: ব্যাংকঋণের সুদের হার পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়ার এক সপ্তাহ পরই সেখানে হস্তক্ষেপ করার ইঙ্গিত দিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। তিনি ব্যাংকঋণের সুদের হার ১৪ শতাংশের বেশি হবে না বলে ব্যবসায়ী ও শিল্পমালিকদের আশ্বস্ত করেছেন। এছাড়া আমদানিতে ডলারের দাম ১১৮ টাকার মধ্যে থাকবে বলেও জানিয়েছেন তিনি। গতকাল বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে এফবিসিসিআইয়ের একটি প্রতিনিধিদলের বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে এমনই আশ্বাস দেন গভর্নর। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বিষয়টি নিশ্চিত করেন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মাহাবুবুল আলম। এছাড়া এর পরিপ্রেক্ষিতে গভর্নর জানিয়েছেন, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে ডলার মার্কেট স্বাভাবিক হয়ে যাবে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শে গত ৮ মে এক সার্কুলারে ব্যাংকঋণের সুদহার নির্ধারণ পদ্ধতি সিক্স মান্থ মুভিং অ্যাভারেজ রেট (স্মার্ট) প্রত্যাহার করে তা পুরোপুরি বাজারভিত্তিক করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে এখন থেকে ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে ঋণের সুদহার নির্ধারিত হবে। এ কারণে সুদের হার আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ী ও শিল্পমালিকরা। এ বিষয়ে গতকাল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠকে এফবিসিআইয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়, সুদহার নির্ধারণের চলমান স্মার্ট পদ্ধতি তুলে দিয়ে তা বাজারভিত্তিক করা হয়েছে। এর মাধ্যমে ব্যাংকগুলো নিজেদের সুবিধামতো সুদহার নির্ধারণের সুযোগ পেয়েছে। ফলে সব ধরনের ঋণের সুদের হার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। এফবিসিসিআই বলছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী ব্যাংকগুলো ঋণের খাতভিত্তিক সুদের হার ঘোষণা করবে এবং গ্রাহকভেদে ঘোষিত হারের চেয়ে ১ শতাংশ কম বা বেশি হারে ঋণ বিতরণ করতে পারবে। কিন্তু এ নির্দেশনা ব্যাংকের পক্ষে অনুসরণ করা সম্ভব হবে কিনা সে বিষয়টি ভেবে দেখা দরকার। সুদের হার বৃদ্ধি করা হলে ব্যবসার খরচ বেড়ে যাবে এবং স্থানীয় শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এজন্য সুদের হারের জন্য সর্বোচ্চ সিলিং নির্ধারণ করে দেয়ার অনুরোধ করে সংগঠনটি। ব্যবসায়ীদের এমন দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সুদহার বাজারভিত্তিক করার নির্দেশনা যথাযথভাবে বাস্তবায়নের পরিবর্তে সেখানে হস্তক্ষেপ করার ইঙ্গিত দিয়েছেন গভর্নর। বৈঠকে তিনি সুদের হার ১৪ শতাংশের বেশি হবে না বলে ব্যবসায়ী নেতাদের আশ্বস্ত করেছেন।

এ বিষয়ে বৈঠক শেষে এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি সাংবাদিকদের বলেন, ‘সুদের হার বাজারভিত্তিক করা হলেও তা ১৪ শতাংশের বেশি হবে না বলে জানিয়েছেন গভর্নর। কারণ ব্যাংকগুলোর কস্ট ৬ থেকে ৮ শতাংশের বেশি না। তাই গভর্নর মনে করছেন ১৪ শতাংশের ওপরে সুদহার উঠবে না। এই ১৪ শতাংশ সুদের হার অলমোস্ট ফিক্সড। তবে ভালো গ্রাহকের ক্ষেত্রে ১ শতাংশ কম হতে পারে। অন্য গ্রাহকের জন্য ১ শতাংশ বেশি হতে পারে।’

বৈঠকে বারবার পলিসি পরিবর্তনে ব্যবসায়ীদের কী ধরনের সমস্যা হচ্ছে সেটিও তুলে ধরেছে এফবিসিসিসিআই। এ বিষয়ে সংগঠনটি বলেছে, পলিসির ধারাবাহিকতা বিঘ্নিত হলে বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং বিনিয়োগকারীর আগ্রহ কমে যায়। বিনিয়োগের স্বার্থে পলিসির ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন রাখতে হবে। পরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বারবার নীতি পরিবর্তন ইস্যুতেও সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অবশ্যই বারবার নীতি পরিবর্তন হলে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এটাই স্বাভাবিক। কারণ একটা প্রজেক্ট করার সময় সুদের হার, বিনিময় হারসহ নানা চিন্তাভাবনা করেই কাজ শুরু করতে হয়। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিছুদিন পরই যদি নীতিতে পরিবর্তন আনে, তখন আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হই। এজন্য আমরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে অনুরোধ করেছি, যাতে নীতিগুলো বারবার পরিবর্তন না করে, নীতিগুলো দীর্ঘমেয়াদি হয়। এতে আমাদের ব্যবসায়িক পরিকল্পনা করতে সহজ হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর এ বিষয়ে আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন।

পলিসি করার সময় স্টেকহোল্ডার হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যবসায়ীদের মতামত নিয়েছে কি নাÑএমন প্রশ্নে তিনি বলেন, স্টেকহোল্ডার হিসেবে মতামত নিলে ওনাদের জন্যও ভালো, আমাদের জন্যও ভালো।

বৈঠকে ডলারের বিনিময় মূল্য অত্যধিক বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা আর্থিকভাবে ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে গভর্নরকে জানান ব্যবসায়ী নেতারা। তারা বলেন, ডলারের বিনিময় মূল্য ৮৫ থেকে ১১০ এবং সর্বশেষ ১১৭ টাকা করা হয়েছে। এতে কোনো কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে এবং ঋণখেলাপিতে পরিণত হচ্ছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে গভর্নর জানিয়েছেন, ক্রলিং পেগ পদ্ধতির আওতায় ডলারের দাম ১১৮ টাকার মধ্যেই থাকবে। এ বিষয়ে এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, বৈঠকে গভর্নর বলেছেন ডলারের দর ১১৭ টাকার থেকে সর্বোচ্চ এক টাকা বেশি এবং সর্বনিম্ন ১ টাকা কম হবে। এর বাইরে যাবে না। প্রত্যেক ব্যাংকে এই দর মেনেই এলসি করতে হবে।

সিঙ্গেল বরোয়ার এক্সপোজার লিমিট নিয়ে এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি বলেন, ‘ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় অনেকের ঋণসীমা অতিক্রম হয়ে যাচ্ছে। এতে ঋণপত্র (এলসি) খুলতে সমস্যা হচ্ছে। এজন্য আমরা ঋণের সীমা শিথিল করার অনুরোধ করেছি।’

বৈঠকে আমদানি কার্যক্রম নিরবচ্ছিন্ন রাখার স্বার্থে বাজারে ডলার সরবরাহ যতটা সম্ভব স্বাভাবিক রাখার অনুরোধ জানায় ব্যবসায়ীরা। এ বিষয়ে বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, আমরা ডলারের অভাবে এলসি খুলতে পারছি না। এদিকে ইডিএফ কমিয়ে তিন বিলিয়নে নামিয়ে আনা হয়েছে। এর কারণে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। এই সমস্যা সমাধানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিকল্প একটি তহবিল ব্যবহারের পরামর্শ দেয়া হয়েছে। ব্যবসায়ীরা ১১৭ টাকায় এলসি খুলতে পারছেন কি নাÑএমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, যদি কোনো ব্যবসায়ীর কাছ থেকে বেশি টাকা নেয়া হয় তাহলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে অভিযোগ করতে বলা হয়েছে। তাহলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে বাংলাদেশ ব্যাংক।

তিনি আরও বলেন, ‘ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে কিছু গ্রাহকের একক গ্রহণ সীমা অতিক্রম করেছে। বিষয়টি সমাধানে ব্যাংক এবং গ্রাহকভিত্তিক বিশেষ সুবিধা দেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন গভর্নর। ফান্ডেড এবং নন-ফান্ডেড মিলে ২৫ শতাংশের বেশি ঋণ একজন গ্রাহক না পাওয়ার শর্ত থাকলেও এই পরিস্থিতিতে তাদের জন্য বিশেষ বিবেচনা করা হবে।’

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০