প্রতিনিধি, বাঁশখালী (চট্টগ্রাম)ঃ চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলা। লিচুর রাজ্য হিসেবে দেশজুড়েই নামডাক রয়েছে এ উপজেলার। আর যেজন্য নামডাক, সেই লিচুকে কালীপুরের লিচু বলে। মে মাসের শুরুর দিক থেকে মে মাসের শেষ পর্যন্ত পাওয়া যায় এই রসালো লিচু। শুধু ১৫ থেকে ২০ দিন পর্যন্ত স্থায়িত্ব হয় এই লিচুর বাজার। মূলত মে মাস ঘিরেই চলে চট্টগ্রামের বিখ্যাত কালীপুরের লিচু উৎসব। তাই বাঁশখালীর কালীপুরের লিচুর কদরটাই আলাদা।
সরেজমিনে বাঁশখালী উপজেলার কালীপুরের বিভিন্ন লিচুবাগান ঘুরে দেখা যায়, বাগানের প্রতিটি গাছে থোকায় থোকায় ঝুলছে লাল রঙের লিচু। বিগত বছরের তুলনায় এ বছর লিচু ধরেছে বেশ। তাতে উঁচুনিচু পাহাড়ের সারিতে লাগানো ঝুপড়ি গাছের শাখা-প্রশাখায় লিচু আর লিচু। শুধু কি বাণিজ্যিক লিচু চাষের বাগান? না! সড়কের পাশে, বাড়ির উঠানে ও লোকালয়ে সব জায়গায় দু-একটা করে লিচু গাছ রয়েছে। প্রতি বাড়িতেই লিচু গাছ থাকা যেন এই এলাকার ঐতিহ্য। এছাড়া এসব বড়-ছোট লিচু বাগানের পাশেই চলছে লিচু উৎসব। গাছ থেকে যত্নসহ পাকা লিচু ছেঁড়া ও পরিচর্যা করা ছাড়াও সেসব লিচু গণনা করে বাজারজাত করতে ব্যস্ত সময় পার করছেন বাগান মালিক, ইজারাদার ও শ্রমিকরা।
অপরদিকে কালীপুর রেজিস্ট্রি অফিসে প্রধান সড়কের দুপাশে শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাই লিচু বিক্রি করছেন। সড়কে প্রায় যানবাহন দাঁড়িয়ে তাদের কাছ থেকে সেই লিচু কিনছেন। খুচরা ও পাইকারি দামে যার যেমন ইচ্ছা ক্রয়-বিক্রয় করছেন। আবার পাশের স্কুলের মাঠের উত্তর-পূর্ব কোণে পাইকারি দরে লিচুর বেচাকেনা চলছিল। তাতে সারি সারি লিচুভর্তি বাঁশের ঝুড়ি। আর সেই বাঁশের ঝুড়িতে সবুজ পাতার বিছানা। সেই ঝুড়িতে থাকা লাল ও সবুজ রঙের থোকা থোকা লিচু নজর কাড়ছে সবার। তাতে ভালো মানের লিচু পাইকারি দামে বিক্রি হচ্ছে প্রতি হাজার দুই থেকে তিন হাজার টাকায়। অপরদিকে খুচরা বাজারে আকার অনুসারে একেকটি লিচু এক থেকে পাঁচ টাকায় পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে।
কৃষি অধিদপ্তর সূত্র জানা যায়, ‘বাঁশখালীতে প্রতিবছরই লিচু চাষ বাড়ছে। উপজেলার পুঁইছড়ি, চাম্বল, জলদী, কালীপুর, বৈলছড়ি ও সাধনপুরের পাহাড়ি এলাকায় লিচু চাষ বেশি হয়। সবচেয়ে বেশি লিচু চাষ হয় কালীপুরে। কালীপুরের লিচুর কদর দেশজুড়ে। ২০২০ সালে ৬০০ হেক্টর, ২০২১ সালে ৭০০ হেক্টর, ২০২২ সালে ৭২০ হেক্টর ও ২০২৩ সালে ৭৬০ হেক্টর লিচু চাষের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও চলতি সালে ৬৩০ হেক্টর লিচু চাষ হয়েছে। প্রতি হেক্টরে বীজের গাছ হয় ২০১-২২০টি। কলমের নতুন জাতের চারা হয় ২৬০টি। বাঁশখালীতে স্থানীয় উন্নত জাতের কালীপুরী লিচু, বোম্বাই, চায়না-থ্রি, চায়না-টু ও মোজাফ্ফরী লিচুর আবাদ হয়। ব্যবসায়িকভাবে চায়না-থ্রি ও চায়না-টু জাতের লিচু বেশি বিক্রি হয়। বাঁশখালীতে স্থানীয় জাতের লিচু যেটিকে কালীপুরী লিচু বলা হয়, সেটির কদরই বেশি। চায়না থ্রি জাতের লিচুর শাঁস বড়, কিন্তু বিচি ছোট। ফলনও আসে দেরিতে। কালীপুরের লিচুর শাঁস ও বিচি ছোট হলেও আগেভাগেই ফলন আসে, যে কারণে বাণিজ্যিকভাবে এ জাতের লিচু বিক্রি করে লিচুবাগান মালিকরা বেশি লাভবান হন।
স্থানীয়রা জানান, ‘প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন না হওয়ায় এ বছর লিচুর উৎপাদন হয়েছে বরাবরের চাইতে কয়েকগুণ বেশি। এতে লিচুর বাম্পার ফলন হলেও দামের কমতি নেই। ব্যাপক চাহিদা থাকায় লিচুর আকারভেদে প্রতি ১০০টি লিচু বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকায়। আবার অতীব ভালো মানের লিচু বিক্রি হচ্ছে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকায়। তবে প্রথম দিকে দাম বেশি থাকলেও তা ধীরে ধীরে কমে আসবে। বর্তমানে উপজেলার অধিকাংশ হাটবাজারে কালীপুরের লিচু বিক্রি হচ্ছে। তাতে হাটবাজারে পাইকার ও খুচরা ক্রেতারা ভিড় জমাচ্ছেন। আবার কেউ কেউ বিদেশে লিচু রপ্তানি করতে পাইকারি দামে ক্রয় করে নিয়ে যাচ্ছে।’
কালীপুরের লিচুচাষি মোহাম্মদ হারুন বলেন, ‘রাস্তার কাছে বাগানের চেয়ে পাহাড়ি এলাকার বাগানগুলোয় ফলন বেশি হয়। গাছ থেকে লিচু ছেঁড়ার আগ পর্যন্ত বাগানের পরিচর্যা করতে হয়। প্রকৃতি অনুকূলে না থাকলে লিচুর ফলন কমে যায়। কালীপুরের লিচু সারাদেশেই যায়। আগেভাগে বাজারে আসার কারণে এই লিচুতে বেশি লাভবান হন ব্যবসায়ীরা। এরই মধ্যে প্রায় লিচুবাগান পাইকার ব্যবসায়ীরা কিনে নিয়েছেন। তাছাড়া অনেকেই মৌসুমি ব্যবসা হিসেবে লিচু বিক্রি করেন।
কালীপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আ ন ম শাহাদত আলম বলেন, ‘এখানে লিচু ব্যবসায়ীরা ঝুঁকিহীনভাবে ব্যবসা করে থাকেন। পরিষদের পক্ষ থেকে ব্যবসায়ী ও চাষিদের সব ধরনের নিরাপত্তা ও সহযোগিতা করা হচ্ছে।’
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আবু সালেক বলেন, ‘চলতি বছরে ৬৩০ হেক্টর লিচু চাষ হয়েছে বাঁশখালীতে। সব জায়গায় লিচুর বাম্পার ফলন হয়েছে।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জেসমিন আক্তার বলেন, ‘কালীপুরের লিচু রসালো ও টসটসে। ভারী মিষ্টি ও সুস্বাদু। বাজারে এর চাহিদাও ভালো। এবার লিচুর বাম্পার ফলন হয়েছে। চাষিরা এবার লাভবান হবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।’