আসাদুজ্জামান চৌধুরী: প্রতি বছর রমজান মাসসহ কিছু প্রধান ধর্মীয় উৎসবের আগে দেশের বাজার ব্যবস্থা চরমভাবে অস্থিতিশীল ও প্রায় অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ে বললেই চলে। এর মূল কারণ এসব উৎসবকে কেন্দ্র করে দেশের একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিতে উঠেপড়ে লেগে যায়। ভোগ্যপণ্যের বাজার অস্থিতিশীল হওয়ার কারণে বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি পায় এবং বাজার ব্যবস্থা প্রায় সময় প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। সম্প্রতি আমাদের দেশে বাজারের অস্থিতিশীল অবস্থা প্রতিবছর রমজানের আগ মুহূর্তের জন্য একটি সাধারণ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশে রমজান মাস আসার আগে অসাধু ব্যবসায়ীরা অধিক পরিমাণের পণ্য মজুত করে রাখে এবং বাজারে ভোগ্যপণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে। ফলে বাজারে দ্রব্যের দাম মাত্রাতিরিক্ত হারে বৃদ্ধি পায়, যা বর্তমানে বাজারের মধ্যে বেশ দৃশ্যমান। এছাড়া ভেজাল ও নি¤œমানের পণ্যের ছড়াছড়ি ও বিক্রির মাধ্যমে রমজানসহ বিভিন্ন ধর্মীয় প্রধান উৎসবের আগ মুহূর্তে আমাদের দেশের বাজারের পরিস্থিতি খুবই খারাপ হয়ে পড়ে।
দেশে যথাযথ আইন প্রয়োগের অভাব বাজারে এ সমস্যা সৃষ্টির প্রধান কারণ। এরই মধ্যে উচ্চ আদালতও বলেছেন, ‘আইন থাকলেও প্রয়োগ না থাকায় দেশের নিত্যপণ্যের বাজার ব্যবস্থা জোটবদ্ধ ব্যক্তিগোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে।’ উল্লেখ্য, সরকার রমজানের আগে বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা নিলেও তা যথাযথভাবে কার্যকর হতে পারে না। অনেক ক্ষেত্রে ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও প্রশাসন নানা প্রতিবন্ধকতার শিকার হয়ে প্রকৃত সিন্ডিকেটদের ওপর জোরালোভাবে আইনি ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে বাজারে প্রশাসনের চলমান মনিটরিং প্রক্রিয়ায় তেমন কোনো সুফল বয়ে আনে না, বরং বাজারে নব নব অব্যবস্থাপনার নানা ফাঁদ সৃষ্টি হয়। উল্লেখ্য, প্রশাসন যাদের ওপর মনিটরিং করা প্রয়োজন, তাদের ওপর না করে দেশের গুটিকয়েক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ব্যবসা কার্যক্রমে মনিটরিং করে থাকে। ফলে দেশের বাজার ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ চলে যায় দুষ্টচক্রের কলকব্জায়। এছাড়া প্রতিবছর সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ নানা কৌশলে উপেক্ষা করে প্রতিনিয়ত বাজারে অস্থিতিশীল অবস্থার সৃষ্টি করছে এক শক্তিশালী চক্র, যা আমাদের দেশের জন্য খুবই দুঃখজনক বিষয়। দীর্ঘদিন ধরে জোটবদ্ধ অসৎ ব্যক্তিগোষ্ঠীর হাতে যদি বাজার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চলে যায়, তাহলে দেশের নি¤œবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষ পণ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে চরম আর্থিক বিড়ম্বনার শিকার হয়। এছাড়া আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ স্বল্প আয়ের। সীমিত আয়ের মানুষের জীবনযাপন এমনিতেই বহুমুখী সমস্যায় বিপর্যস্ত, তার ওপর দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জাতীয় কল্যাণের লক্ষ্যে এসব সমস্যার দ্রুত সমাধান করা একান্ত জরুরি। সর্বপ্রথম, কেন বাজারের অবস্থা অস্থিতিশীল, কারা এর জন্যে আসল দায়ীÑএসব বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলকে খতিয়ে দেখতে হবে। একইসঙ্গে বাজার ব্যবস্থা প্রশাসনের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে এবং সব ধরনের অসাধু ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ বিভিন্ন তদারকি সংস্থাগুলোকে আরও সক্রিয় হতে হবে। এছাড়া প্রশাসনকে বাজারের বিক্রীত পণ্য, সরবরাহ পণ্য এবং মজুদকৃত পণ্য প্রভৃতি বিষয়ে সার্বক্ষণিকভাবে নজর দিতে হবে। এক্ষেত্রে বাজার স্থিতিশীলতা দীর্ঘদিন বজায় রাখতে নির্দিষ্ট সংখ্যক ম্যাজিস্ট্রেটসহ বাজারসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি টিম গঠন করে বাজার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে আরও সক্রিয় ও স্থায়ী করতে হবে। বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য দেশের মজুতদারি ব্যবসা যথাসম্ভব কমাতে হবে, প্রয়োজনে তা বন্ধ করে দিতে হবে। প্রশাসনকে স্বল্প কয়েক ভ্রাম্যমাণ আদালত বা জরিমানা করে স্তিমিত হয়ে থাকলে হবে না, বাজার নিয়ন্ত্রণে স্থান ও কালভেদে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ এবং তা দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। কালোবাজারির মাধ্যমে যারা জনগণকে বেশি প্রতারিত করে, আগে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। এককথায়, রমজানের আগ মুহূর্তে বাজার স্থিতিশীল রাখার লক্ষ্যে প্রশাসনকে আরও কঠোর ও কর্মঠ হতে হবে। লক্ষণীয়, দেশের মধ্যবিত্ত ও নি¤œবিত্ত মানুষের ঘুম হারাম হতে বসেছে ক্রমাগত বাজার অবস্থার অস্থিতিশীলতার জন্য। তাই সরকারের পাশাপাশি দেশের বড় ব্যবসায়ীদের জনগণের প্রতি মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে আন্তরিকতা দেখাতে হবে, যাতে দেশের বাজারের অবস্থা স্থিতিশীল থাকে। এছাড়া সাধারণ জনগণকে বাজার ব্যবস্থাপনা স্বাভাবিক রাখার জন্য আরও সচেতন হতে হবে। এক্ষেত্রে জনগণের উচিত রমজানকে কেন্দ্র করে হুড়োহুড়ি করে একসঙ্গে অধিক পণ্য কেনা থেকে বিরত থাকা, ধীরেসুস্থে বাজার করা এবং গৃহের প্রয়োজন অনুযায়ী পণ্য ক্রয় করা। কোনো স্থানে অসাধু ও সংঘবদ্ধ চক্রের কারসাজি পরিলক্ষিত হলে তা প্রশাসনকে দ্রুত অবহিত করতে হবে।
মুক্তবাজার অর্থনীতিতে সরকারের অধীনে বাজার সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করা খুবই কঠিন কাজ। তবে বৃহত্তর জনকল্যাণের লক্ষ্যে জাতীয় কর্মোদ্যোগ ও প্রচেষ্টার মাধ্যমে দেশের বাজার অবস্থা স্থিতিশীলতায় আনতে সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও স্থানীয় প্রশাসনকে আরও কঠোরতা অবলম্বন করতে হবে।
শিক্ষার্থী
বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়