Print Date & Time : 23 June 2025 Monday 9:57 am

বাজেটের সব তথ্য প্রকাশ না করায় উম্মুক্ত আলোচনা হচ্ছে না

নিজস্ব প্রতিবেদন: যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নয়ন সহযোগী দেশের দৃষ্টিতে বাংলাদেশ আর্থিক স্বচ্ছতার ন্যূনতম মানদণ্ড পূরণ করছে না। আন্তর্জাতিক বাজেট পার্টনারশিপের (আইবিপি) সূচকেও বাংলাদেশের অবস্থান মধ্যবর্তী অবস্থানে। বাংলাদেশ বাজেট ও আর্থিক খাতের বেশ কিছু তথ্য উম্মুক্ত করলেও প্রতিরক্ষা ও সরকারি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যয়ের ক্ষেত্রে তথ্য প্রকাশ করছে না। এজন্য কার্যকর গণবিতর্ক হচ্ছে না। এছাড়া বাজেটের অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্রে সুষম ও স্বচ্ছ বণ্টন হচ্ছে না বাংলাদেশে। যে এলাকায় প্রভাবশালী মন্ত্রী আছে সে এলাকায় বরাদ্দ বেশি যাওয়ার ঘটনা ঘটছে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) আয়োজিত এক আলোচনা সভায় গতকাল বৃহস্পতিবার বক্তারা এসব কথা বলেন। যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের সহায়তায় ‘ফিসকাল ট্রান্সপারেন্সি ইন বাংলাদেশ শীর্ষক’ আলোচনাটি রাজধানীর একটি হোটেলে অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তিনি তার বক্তব্যে বলেন, ১৯৯০-এর পর থেকে বাজেট প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশে সক্ষমতা বেড়েছে। বিশেষ করে গত কয়েক বছরে অটোমেটেড হওয়ার কারণে বাজেট ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা বেড়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে এখনও আরও উন্নতি করার আছে। যেকোনো আর্থিক সংস্কার ও পরিবর্তনকে টেকসই করার জন্য স্বচ্ছতার বিষয়টি খুবই জরুরি। বাজেটকে আরও গ্রহণযোগ্য করার জন্য আগামী বছর থেকেই প্রি-বাজেট স্টেটমেন্ট, সম্পূরক বাজেটের ওপর সংসদে আলোচনার সুযোগ, ঘাটতি বাজেটকে সীমিত রাখার বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। আর্থিক ও অন্যান্য তথ্যের স্বচ্ছতার জন্য পরিসংখ্যান ব্যুরোকে স্বায়ত্তশাসন দেওয়া যেতে পারে বলেও মত দেন অর্থমন্ত্রী।

সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পিআরআই’র নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর। পিআরআই’র চেয়ারম্যান জায়েদী সাত্তারের সঞ্চালনায় এতে বিশেষ অতিথি ছিলেন যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স জোয়েল রাইফম্যান। প্যানেল আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন পিআরআই’র ভাইস চেয়ারম্যান ড. সাদিক আহমেদ, সাবেক অর্থসচিব জাকির আহমেদ খান, ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তাফা কে মুজেরি, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী। সাবেক অর্থসচিব তারিক আহমেদ, সোহেল চৌধুরী, অর্থনীতিবিদ সিদ্দিকুর রহমান ওসমানী, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান মো. আবদুল মজিদ, অর্থনীতি বিশ্লেষক মামুন রশিদ প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।

উপস্থিত বিশেষজ্ঞদের পরামর্শের প্রতিক্রিয়ায় অর্থমন্ত্রী আরও বলেন, স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা শুরু হয় প্রতিবছরই ফেব্রুয়ারি থেকে। বাজেটের আগে স্টেকহোল্ডারদের পরামর্শ কী ছিল, আর বাজেটের তার কী কী প্রতিফলন হয়েছে, এ বিষয়ে বাজেটের পরে আলাদাভাবে একটা বিস্তারিত প্রতিবেদন দেওয়া যেতে পারে। আমরা সেটা করবো। এছাড়া তথ্যের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করার বিষয়ে চেষ্টা অব্যহত রাখার চেষ্টা করবো আমরা।

তবে স্থানীয় সরকার ও সরকারি মালিকানাধীন সংস্থাগুলোর আর্থিক কর্মকাণ্ড বাজেটে প্রতিফলিত না হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে অর্থমন্ত্রী বলেন, ক্ষমতা ও অর্থায়ন উভয় ক্ষেত্রেই স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশুর মতো। ইউনিয়ন পরিষদ আর জেলা পরিষদ সামান্য কিছু রেভিনিউ সংগ্রহ করে, যা মোট বাজেটের আধা শতাংশও হবে কি না, সন্দেহ। তবে ঢাকা সিটি করপোরেশন এবং অন্যান্য সিটি করপোরেশন ভালো পরিমাণের রাজস্ব আদায় করে। কিন্তু ঢাকায় এখনও হোল্ডিং ট্যাক্স রয়েছে ৬০ বছর আগের পরিমাণ। সাদেক হোসেন খোকার সময়ে এটা একবার বাড়ানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সেটাতে ধরা হয়েছিল ১১ গুণ। ফলে পরে সেটা বাতিল হয়ে যায়। আমি নিজে ১৪ কাঠা জমি এবং ৫৮০০ বর্গফুট নির্মিত এলাকায় মাত্রা ১১ হাজার টাকা হোল্ডিং ট্যাক্স দিই। তার থেকেও আবার রেয়াত পাই বিভিন্ন পরিমাণ। ফলে আমি পরিশোধ করি মাত্র ছয় হাজার টাকা। এবার মেয়রদের হোল্ডিং ট্যাক্স বাড়াতে বলেছি আমি।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স জোয়েল রাইফম্যান বলেন, বাংলাদেশ নানা দিকে অভূতপূর্ব উন্নতি করছে। এ উন্নয়নটাকে টেকসই করতে হলে স্বচ্ছতা হচ্ছে মৌলিক প্রয়োজন। ২০২১ সালের পর বাংলাদেশকে আর সস্তা শ্রম আর সস্তা পুঁজির ভিত্তিতে আর্থিক ব্যবস্থা পরিচালনা করলে চলবে না। সে সময় টেকসই উন্নয়ন, ভালো ব্যবস্থাপনা এবং উৎপাদন ও উদ্ভাবনের দিকে গুরুত্ব দিতে হবে। আর ভালো ব্যবস্থাপনার জন্য স্বচ্ছতা হচ্ছে মূল বিষয়। এজন্য বাংলাদেশকে বিশ্বাসযোগ্য তথ্য সংগ্রহ, প্রকাশ এবং ধারাবাহিক উন্নতির দিকে যেতে হবে।

আলোচনায় জানানো হয়, যুক্তরাষ্ট্রের ফিসকাল ট্রান্সপারেন্সি ইনোভেশন ফান্ডের (এটিআইএফ) আওতায় বাংলাদেশের অবস্থা অনুসন্ধানের জন্য একটি গবেষণা করে পিআরআই। এ গবেষণার অভিজ্ঞতাই তুলে ধরা হয় আলোচনায়। এ সময় আহসান এইচ মনসুর বলেন, আর্থিক স্বচ্ছতার জন্য আইএমএফ চারটি মূল বিষয় অনুসরণ করার কথা বলেছে। এগুলো হলো আর্থিক ব্যবস্থার (ফিসকাল রিজিম) দায়িত্ব, কর্তব্য ও সংজ্ঞা স্পষ্ট করা, উš§ুক্ত বাজেট প্রক্রিয়া, বাজেট সংক্রান্ত তথ্যের সহজপ্রাপ্যতা এবং বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারের মধ্যে সমন্বয়। এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কিছু অগ্রগতি থাকলেও অনেক বিষয়ে আরও উন্নতির সুযোগ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের ২০১৫ সালের ফিসকাল ট্রান্সপারেন্সি প্রতিবেদন অনুসারে বাংলাদেশ বাংলাদেশ আর্থিক স্বচ্ছতার ন্যূনতম মানদণ্ড পূরণ করছে না। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজেট পার্টনারশিপের (আইবিপি) সূচকেও বাংলাদেশের অবস্থান হচ্ছে পাঁচটি শ্রেণির মধ্যে মধ্যবর্তী অবস্থানে। বাংলাদেশের স্কোর ২০০৮ সালে ছিল ৪২, যা ২০১৫ সালে তা ৫৬ হয়েছে। বাংলাদেশ বাজেট ও আর্থিক খাতের বেশ কিছু তথ্য উš§ুক্ত করলেও প্রতিরক্ষা ও সরকারি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যয়ের ক্ষেত্রে তথ্য প্রকাশ করছে না। এজন্য কার্যকর গণবিতর্ক হচ্ছেনা। এছাড়া বাজেটের অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্রে সুষম ও স্বচ্ছ বণ্টন হচ্ছে না বাংলাদেশে। যে এলাকায় প্রভাবশালী মন্ত্রী আছে সে এলাকায় বরাদ্দ বেশি যাওয়ার ঘটনা ঘটছে। যুক্তরাষ্ট্রের এ প্রতিবেদন যাচাই করার জন্যই এ গবেষণা পরিচালনা করে পিআরআই।

গবেষণায় আহসান এইচ মনসুর বলেন, বেশ কিছু ভালো দিক রয়েছে বাংলাদেশের বাজেটের। ব্যাপক আধুনিকায়ন হয়েছে বটে। কিন্তু সব তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে না। প্রতিরক্ষা বাজেটের তথ্য জনগণের সামনে স্পষ্ট হওয়া দরকার, যা ভারত করছে। তবে যেকোনো ধরনের রাষ্ট্রীয় ব্যয় সংসদে অনুমোদন হতে হয় বাংলাদেশে। এটা ভালো ব্যবস্থা। কিন্তু সম্পূরক বাজেট নিয়ে সংসদে আলোচনা হয় না। এটা আলোচনায় আনা দরকার।

গবেষণায় আরও বলা হয়, সেনাকল্যাণ ফান্ড, ক্ষুদ্র কৃষক উন্নয়ন ফাউন্ডেশন, বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ, স্বাস্থ্য খাতের মেডিক্যাল কলেজসমূহের মতো একস্ট্রা বাজেটারি ফান্ডগুলোর ব্যয়ের বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে না। এছাড়া এডিবিসহ বাজেট বাস্তবায়নের বিভিন্ন দিকে টাকার অঙ্কে তথ্য দেওয়া হলেও বাস্তবে গুণগত অবস্থা প্রকাশ করার কোনো ব্যবস্থা নেই।