নিজস্ব প্রতিবেদক: আগামী অর্থবছরের বাজেট নির্বাচনী বাজেট। নির্বাচনী বছর হওয়ায় বাজেটে নতুন কোনো পরিবর্তন বা সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হবে না। পুরোনো ভালো যেসব উদ্যোগ রয়েছে তার প্রতি দৃষ্টি দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।
গতকাল রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) পরামর্শক কমিটির ৩৯তম সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন এনবিআর চেয়ারম্যান মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া। সভা সঞ্চালনা করেন এফবিসিসিআই’র সভাপতি মো. শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন।
অর্থমন্ত্রী বলেন, ১০ বছর আগেও এনবিআরে কর দিতে এসে করদাতাকে হয়রানির শিকার হতে হতো। এখন তা অনেক কমে এসেছে। গত দেড় বছর আগে যেখানে করদাতার সংখ্যা ছিল ১৪ লাখ, এখন তা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩০ লাখে। কর দেওয়ার ক্ষেত্রে ভয় দারুণভাবে কমে গেছে। এর ওপর নির্ভর করে এ বছর আমরা ট্যাক্সের ক্ষেত্রে কিছু বড় বড় পরিবর্তন করার চেষ্টায় আছি। মন্ত্রী ই-কমার্স ব্যবসাকে আইটিএস খাতের অন্তর্ভুক্ত করারও ঘোষণা দেন। পাশাপাশি পণ্য সরাসরি রফতানির ক্ষেত্রে নগদ সহায়তার বিষয়টি নিশ্চিত করা হবে বলে তিনি ব্যবসায়ীদের আশ্বস্ত করেন। একই সঙ্গে বেকারি ও কৃষিজাত পণ্যে ভ্যাট প্রত্যাহার করা হতে পারে বলেও আভাস দিয়েছেন তিনি। তবে পোলট্রিতে কোনো প্রণোদনা দেওয়া সম্ভব হবে না বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী।
তিনি বলেন, কটন ইন্ডাস্ট্রির ওপর হয়রানি গত ১০ বছর আগে যেমন ছিল এখন অনেক কম। গত ১০ বছরে এনবিআর মানুষের অনেক কাছে চলে এসেছে। ১০ বছর আগে তারা ছিল বেশ উঁচুতলার মানুষ। তাদের কাছে যাওয়ার ক্ষেত্রে অনেক অসুবিধা ছিল। এখন তা অনেক কমে গেছে।
এগ্রো প্রোসেসিং খাতে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। ভিয়েতনাম এ খাতে ৩০০ বিলিয়ন রফতানি করলেও বাংলাদেশ করে মাত্র ৩০০ মিলিয়ন। এ খাতকে আরও ছাড় ও এ খাতের জন্য একটি ব্যাংক দাবি করেন বাংলাদেশ এগ্রো প্রসেসর অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ফখরুল ইসলাম। এর জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ এগ্রো প্রসেসিং খুবই ভালো। আমরা অর্ধেক প্রস্তুত কোনো জিনিস দেশে নিয়ে আসি। সেটাতে মূল্য নির্ধারণ করতে আমরা খুব ওস্তাদ। এগ্রো প্রসেসিং অনেক এগিয়েছে। এ খাতকে আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাত হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। এছাড়া আগামী বাজেটে কৃষি যন্ত্রপাতি আমদানি ও উৎপাদনে সুবিধা অব্যাহত থাকবে।
রিহ্যাব সভাপতি সামছুল আলামিন বলেন, নিবন্ধন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ফ্ল্যাট নিবন্ধন কমে গেছে। দেশের পরিবেশ বিপর্যয় হচ্ছে, এমন অজুহাতে পাথর তোলা হচ্ছে না। ফলে বিদেশ থেকে পাথর আমদানি ৭০-৮০ শতাংশ বেড়ে গেছে। পাথরের ওপর ভ্যাট ও ট্যাক্স রয়েছে ৬৯ শতাংশ। তা প্রত্যাহার না হলে উন্নয়ন ব্যাহত হবে। এর জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, আমাদের প্রচুর পাথর আমদানি করতে হবে। আমরা এখন পায়রা, পদ্মার জন্য পাথর আমদানি করছি। দেশে পাথর সেভাবে নেই। পাথর ওপর ৬৯ শতাংশ কর থাকবে না। পুরোনো মামলা নতুন করে সামনে এনে সময়ের হিসাব না করে হয়রানি করা হয় ব্যবসায়ীদেরÑএমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে অর্থমন্ত্রী বলেন, পুরোনো মামলা নতুন করে সামনে আনার ক্ষেত্রে আমরা নির্দিষ্ট একটি সীমা রাখব, সেই সীমার পর পেছনের মামলায় আমরা যাব না।
বিজিএমই’র ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ময়েন উদ্দিন আহমেদ মিন্টু বলেন, পোশাক শতভাগ রফতানিমুখী খাত হওয়ায় ভ্যাটের আওতামুক্ত হলেও প্রতি মাসে ভ্যাট রিটার্ন দিতে হয়। এ হয়রানি থেকে মুক্তি দিতে হবে। যারা বন্ড ফাঁকি দেয় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেন তিনি।
বাংলাদেশ অটো রি-রোলিং মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মাসাদুল আলম মাসুদ বলেন, রডের দাম বাড়ার কারণ হলো আন্তর্জাতিক বাজারে স্ক্র্যাপের মূল্য বৃদ্ধি। স্ক্র্যাপ ৩১২ ডলার থেকে ৪২৭ ডলার হয়েছে। এছাড়া ডলার, বিদ্যুৎ, পরিবহন ও ব্যাংক ঋণ বেড়ে যাওয়ায় মূল্য বেড়েছে। স্ক্র্যাপের আমদানি শুল্ক কমানো হলে রডের দাম কমবে। এছাড়া ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারা বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য করপোরেট কর কমানো ও দেশীয় শিল্প সুরক্ষায় কিছু পণ্যে আমদানি শুল্ক বৃদ্ধিসহ বেশ কিছু প্রস্তাব দেন।
বিডার চেয়ারম্যান কাজী আমিনুল ইসলাম বলেন, আমদানিমুখী দেশ থেকে রফতানিমুখী দেশে পরিণত হবে, সেজন্য দেশীয় প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা ও নগদ সহায়তা বৃদ্ধি এবং রফতানিতে গার্মেন্ট শিল্পের বিকল্প শিল্প গড়ে তুলতে হবে। একই সঙ্গে তিনি করের হয়রানি থেকে বাঁচতে অনলাইন সিস্টেমস চালু এবং স্বচ্ছ ও সুষম কর ব্যবস্থাপনা চালুর দাবি জানান।
সভায় এফবিসিসিআই’র পক্ষ থেকে আয়করে ৮১, ভ্যাটে ৯৭ ও শুল্কে ১৬৬-সহ মোট ৩৪৪টি প্রস্তাব দেওয়া হয়। প্রস্তাব তুলে ধরে এফবিসিসিআই’র সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, আগামী বাজেট হবে চার লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার। নির্বাচনকে সামনে রেখে উচ্চাভিলাষী বাজেট প্রণয়ন ও অতিমাত্রায় রাজস্ব নির্ধারণ হলে অর্থনীতির ওপর প্রভাব পড়বে। সেজন্য করনেট বৃদ্ধি করার প্রস্তাব করেন তিনি। জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে। সেজন্য করমুক্ত আয়সীমা আড়াই লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে সাড়ে তিন লাখ করা, করপোরেট কর দুই দশমিক পাঁচ শতাংশ কমানো এবং মূসক নিবন্ধনকারী তালিকাভুক্ত কোম্পানির করহার ট্রেডিং কোম্পানির চেয়ে দুই দশমিক পাঁচ শতাংশ কম রাখা, সারচার্জ সীমা তিন কোটি টাকা পর্যন্ত বর্ধিত করা, আমদানির ক্ষেত্রে অগ্রিম আয়কর প্রত্যাহার এবং লভ্যাংশের ওপর দ্বৈত কর প্রত্যাহারের প্রস্তাব করেন তিনি।
সভাপতি দেশীয় শিল্পের বিকাশ, বর্ধিত হারে উৎপাদন, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান এবং ভোক্তাদের স্বার্থ সংরক্ষণে শুল্ক স্তর ১, ২, ৫, ১০ এবং ২৫ শতাংশের পবিবর্তে ১, ২, ৩, ১০, ২৫ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব করার পাশাপাশি দেশীয় শিল্পের মৌলিক কাঁচামাল এবং রসায়নিক জাতীয় পণ্যের ক্ষেত্রে পাঁচ শতাংশের পরিবর্তে তিন শতাংশ শুল্ক স্তর নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়। এছাড়া তিনি স্টিল ও লোহাজাতীয় পণ্য, চিনি, সিমেন্ট ক্লিংকার, পেট্রোলিয়াম-জাতীয় পণ্যসহ ৪৭টি পণ্যে স্পেসিফিক ডিউটি অব্যাহত রাখা এবং সুতা, জীবনরক্ষাকারী ওষুধ, ভিটামিন, শস্যবীজ, কাঁচা পণ্যসহ ৩১২টি পণ্যের ওপর শূন্য শুল্কহার অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করেন।
মহিউদ্দিন বলেন, সবাইকে হয়রানি না করে যারা মিথ্যা ঘোষণা, আন্ডার ইনভয়েসিং, মানিলন্ডারিং ও কালোবাজারি করে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিন। এতে আমরা সহযোগিতা করব। তিনি নতুন ভ্যাট আইন ও ভ্যাট অনলাইন বাস্তবায়নে কমিটি গঠনের সুপারিশ করেন।
সভাপতির বক্তব্যে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, করপোরেট কর সুষম করতে আমরা কাজ করছি। ন্যূনতম কর বাড়িয়ে নয়, ন্যূনতম করহার শ্রেণি আরও কমিয়ে সবাইকে করের আওতায় আনতে চাই। করের ভীতি দূর করতে আমরা কাজ করছি। বন্ডের হয়রানি বা যেসব সমস্যা রয়েছে, তা দূর করা হবে। নতুন পণ্য নিয়ে আসতে চাইলে বন্ড সুবিধা দেওয়া হবে। এডিআরের মাধ্যমে মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করে রাজস্ব আহরণ করা হবে।