ইসমাইল আলী: ২০০৯ সালের পর থেকে প্রতি বছর বড় অঙ্কের লোকসান দিচ্ছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। এ ঘাটতি পূরণে বিদ্যুৎ খাতে ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে ভর্তুকি দিচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়। সে বছর ৯৫০ কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়া হয়। আর ২০১৮-১৯ অর্থবছর পিডিবিকে ভর্তুকি দেওয়া হয় প্রায় সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা।
চলতি অর্থবছর বিদ্যুৎ খাতে ৯ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি লাগতে পারে। অথচ সংশোধিত বাজেটে এ খাতে কোনো বরাদ্দ দেখানো হয়নি। যদিও চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে জনপ্রশাসন, কৃষি, প্রতিরক্ষা, জনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা এবং সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণ খাতে ভর্তুকি ও প্রণোদনা বাবদ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৩১ হাজার ৯৮৩ কোটি টাকা।
এদিকে চলতি অর্থবছরের মতো আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটেও বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ শূন্য দেখানো হয়েছে।
তথ্যমতে, উচ্চ মূল্যে বিদ্যুৎ কিনে কম মূল্যে বিক্রি করায় ২০১০-১১ অর্থবছর থেকে চলতি অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় ৬৫ হাজার কোটি টাকা লোকসান গুনেছে পিডিবি। এজন্য গত কয়েক বছর ধরে ভর্তুকি চাইলেও তা ঋণ হিসেবে দেওয়া হতো পিডিবিকে। তিন শতাংশ সুদে পরিশোধের শর্তে এ ঋণ দিয়ে আসছিল অর্থ মন্ত্রণালয়।
এদিকে ২০১৬ সালের নভেম্বরে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির শুনানি শেষে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলালিটি কমিশন (বিইআরসি) পিডিবির ঘাটতিকে ভর্তুকি হিসেবে প্রদানে অর্থ মন্ত্রণালয়কে নির্দেশে দেয়। এর ভিত্তিতে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকি চায় পিডিবি। অর্থ মন্ত্রণালয়ে কয়েক দফা চিঠিও দেয় সংস্থাটি। এর পরিপ্রেক্ষিতে ওই অর্থবছর প্রথম দফা পিডিবিকে ৯৫৬ কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়া হয়। আর গত অর্থবছর ১০ হাজার ৪৬৭ কোটি টাকা ভর্তুকি পায় সংস্থাটি।
যদিও গত ১ মার্চ থেকে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির কারণে চলতি অর্থবছর এ খাতে ভর্তুকি কিছুটা কম লাগতে পারে। তবে এরই মধ্যে ভর্তুকির কিছু অংশ ছাড় করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। করোনা পরিস্থিতির কারণে মাঝে কিছুটা বিলম্বিত হয়েছিল এ প্রক্রিয়া। তবে বাকি অর্থ ছাড় করতে এরই মধ্যে পিডিরিব পক্ষ থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। অথচ বাজেটে ভর্তুকি বিষয়ে কোনো তথ্যই উল্লেখ নেই।
জানতে চাইলে পিডিবির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে শেয়ার বিজকে বলেন, পিডিবির ঘাটতি মেটাতে ২০১৭-১৮ অর্থবছর প্রথম ভর্তুকি ছাড় করে অর্থ মন্ত্রণালয়। এখনও এ প্রক্রিয়া চালু আছে। এছাড়া আগামী অর্থবছরের জন্যও সম্ভাব্য ভর্তুকির তথ্য বাজেট প্রণয়নের আগেই অর্থ মন্ত্রণালয় দেওয়া হয়েছে। সে অনুযায়ীই অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে বলে পিডিবিকে নিশ্চিত করা হয়েছে। তবে বাজেটে এ বিষয়ে পৃথক বরাদ্দ রাখা হয়নি কেনÑতা বলতে পারব না। যতদূর শুনেছি অর্থ মন্ত্রণালয়ের থোক বরাদ্দের মধ্যে বিদ্যুতের ভর্তুকির অর্থ রাখা আছে।
উল্লেখ্য, চলতি অর্থবছরের জন্য বিদ্যুৎ খাতে সংশোধিত বরাদ্দ রয়েছে ২৩ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে উন্নয়ন প্রকল্পে বরাদ্দ ২৩ হাজার ৬৭২ কোটি টাকা ও অনুন্নয়ন ব্যয় ৪২ কোটি টাকা। আর আগামী অর্থবছরের এ দুই খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে যথাক্রমে ২৪ হাজার ৮০৪ কোটি ও ৪৯ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে বিদ্যুৎ খাতে বরাদ্দ ২৪ হাজার ৮৫৩ কোটি টাকা।
এদিকে চলতি অর্থবছরের জন্য সংশোধিত বাজেট যাচাই-বাছাই করে দেখা যায়, ভর্তুকি ও প্রণোদনা খাতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১৮ হাজার ৬৭১ কোটি টাকা, কৃষি মন্ত্রণালয়ের জন্য আট হাজার এক কোটি, সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণ খাতে তিন হাজার ৯৯৪ কোটি টাকা, জনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বিভাগের জন্য ৮৪৫ কোটি এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য ৪৭২ কোটি টাকা।
আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে ভর্তুকি ও প্রণোদনা খাতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২২ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা, কৃষি মন্ত্রণালয়ের জন্য ৯ হাজার ৫০১ কোটি, সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণ খাতে চার হাজার ৮৫৫ কোটি, জনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বিভাগের জন্য ৮৭৪ কোটি এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য ৪৮৭ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে ভর্তুকি প্রস্তাব করা হয়েছে ৩৮ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকা।
পিডিবির তথ্যমতে, ২০১৮-১৯ অর্থবছর পিডিবির লোকসান দাঁড়ায় আট হাজার ১৪১ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। এর আগের (২০১৭-১৮) অর্থবছর পিডিবির লোকসান ছিল ৯ হাজার ২৮৪ কোটি ৬২ লাখ টাকা। সংস্থাটির ইতিহাসে এটি ছিল সর্বোচ্চ লোকসান। আর ২০১৬-১৭ অর্থবছরে চার হাজার ৪৩৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তিন হাজার ৮৭৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ও ২০১৪-১৫ অর্থবছরে সাত হাজার ২৮২ কোটি ৯৯ লাখ টাকা লোকসান দিয়েছিল সংস্থাটি। এছাড়া ২০১৩-১৪ অর্থবছরে পিডিবি লোকসান গুনে ছয় হাজার ৮০৯ কোটি ২৫ লাখ টাকা, ২০১২-১৩ অর্থবছর পাঁচ হাজার ৪৩ কোটি ৮৪ লাখ টাকা, ২০১১-১২ অর্থবছরে ছয় হাজার ৬৯৩ কোটি ৩৪ লাখ টাকা ও ২০১০-১১ অর্থবছরে চার হাজার ৬২০ কোটি ৬৪ লাখ টাকা।
লোকসানের ঘাটতি পূরণে ২০১৭-১৮ অর্থবছর পর্যন্ত অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে ৫০ হাজার ৭৪০ কোটি ৪৯ লাখ টাকা ঋণ সহায়তা নিয়েছিল পিডিবি। এর মধ্যে তিন শতাংশ সুদে বাজেটারি সহায়তা বাবদ দেওয়া হয়েছে ৪৩ হাজার ১৬০ কোটি ১২ লাখ টাকা। আর বিনা সুদে সরকারি ঋণ ছিল সাত হাজার ৫৮০ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। এতে পিডিবির ব্যালেন্স সিটের অবস্থা খুবই করুণ হয়ে পড়েছে।
বিপুল এ আর্থিক চাপ সামাল দিতে প্রদত্ত পুরো ঋণ মওকুফের আবেদন করে পিডিবি। এ ঋণ মওকুফের প্রক্রিয়াও চলছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। এজন্য পিডিবির সব আর্থিক হিসাব যাচাই-বাছাই করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এক্ষেত্রে করণীয় নির্ধারণে একাধিক আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়। এদিকে চলতি অর্থবছর পিডিবির লোকসান দাঁড়াত প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা। বিদ্যুৎ খাতে এর পুরোটাই ভর্তুকি হিসেবে দেবে অর্থ মন্ত্রণালয়।