আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট উপস্থাপন হচ্ছে আজ। জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অঙ্কের বাজেট উপস্থাপন করবেন। এ বাজেট নিয়ে মতামত ব্যক্ত করেছেন চট্টগ্রামকেন্দ্রিক তিন ব্যবসায়ী
বাজেটে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতকে প্রাধান্য দিতে হবে
মোহাম্মদ মহসিন
ভাইস চেয়ারম্যান
পিএইচপি ফ্যামিলি
মহামারি করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে গত তিন মাসে আমাদের ভারী শিল্পে উৎপাদিত পণ্যের বিক্রয় ৯০ শতাংশের মতো কমেছে। উৎপাদন এখন নাম মাত্র হচ্ছে। বিশেষ করে কাঁচামালের সংকট প্রকট। যদিও গ্লাসের কাঁচামাল সিলেট থেকে বালি পাওয়া যাচ্ছে। এটা দিয়ে উৎপাদন চালিয়ে যাচ্ছি। এছাড়া পুরোনো ও পরিত্যক্ত কাচকে ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে খরচ বেশি হচ্ছে। তবু উৎপাদন তো চালিয়ে যেতে হবে। কিন্তু ইস্পাত উৎপাদনের কাঁচামালের বেশ সংকট আছে। এভাবে চলছে আমাদের উৎপাদন। এ করোনা সংক্রমণ আমাদের বিশ্বাস, আস্থা ও শিক্ষা ইত্যাদি সবকিছুতে আঘাত করেছে। আমরা প্রতিনিয়ত শিখছি। এ বিষয়ে তো আমাদের নলেজ ছিল না। সাধারণত আমরা হরতাল কিংবা ডেঙ্গু হলে কিছুদিন অপেক্ষা করতাম। কিন্তু করোনায় সহজে মুক্তি নেই। এ জন্য আমাদের আসন্ন বাজেটে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতকে প্রাধান্য দিতে হবে। এর জন্য রোডম্যাপ তৈরি করতে হবে। ভালো পরিকল্পনা ছাড়া বরাদ্দ বাড়ানো হলেও এতে ভালো সুফল আসবে না। আমাদের অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিতে হবে। এটাও বিবেচনায় রাখতে হবে আমাদের ভালো মানসম্মত ডাক্তার, নার্স ও টেকনিশিয়ানের অভাব রয়েছে। এ খাতে আমাদের বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এছাড়া নিজস্ব উদ্যোগে কমিউনিটি হাসপাতাল বাড়াতে হবে। আগের নিজের সুরক্ষা নিজেকেই নিতে হবে।
প্রণোদনা তেলের মাথায় তেল দেওয়া মতো। আমাদের ছোট ছোট অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান আছে, তাদেরও বাঁচিয়ে রাখতে হবে। অর্থনীতিতে তাদের ভূমিকা কিন্তু কম নয়। এছাড়া প্রণোদনা বাস্তবায়নের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আরও সচেতন হতে হবে। সঠিকভাবে ফলোআপে রাখতে হবে।
বাজেটে চলমান মেগা প্রকল্প কাজের ধারাবাহিকতা থাকতে হবে
মাহবুবুল আলম
সভাপতি
চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি
জীবন ও জীবিকার মধ্যে সুসমন্বয় করে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে হবে। করোনার প্রভাবে নিঃসন্দেহে মহামারি মোকাবিলায় বাজেটে বিশেষ কিছু থাকবে। পাশাপাশি দেশে যেসব মেগা প্রকল্পের কাজ চলছে তার ধারাবাহিকতাও থাকতে হবে। বৃহত্তর চট্টগ্রামের কথাই যদি বলি বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর, চট্টগ্রাম বন্দরের বে টার্মিনাল, কর্ণফুলী টানেল, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর, কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন সম্প্র্রসারণ এসব প্রকল্পের কাজ যাতে নিরবচ্ছিন্ন গতিতে চলে তার প্রতিফলন থাকতে হবে বাজেটে।
ইস্পাত শিল্পের কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ অগ্রিম কর ধার্য করা আছে। নিয়মানুযায়ী পরবর্তী সময়ে বাজারজাতকরণ এবং বিক্রির ক্ষেত্রে ওই কর সমন্বয় করার বিধান আছে। কিন্তু তা বাস্তবায়ন হয় না। তাছাড়া ইস্পাত শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিভিন্ন ব্যবসায়ী গ্রুপের হাজার হাজার কোটি টাকা দীর্ঘদিন ধরে আটকে আছে রাজস্ব বিভাগে। অথচ ওই টাকা ছয় মাসের মধ্যে সমন্বয়ের বাধ্যবাধকতা রয়েছে আইনের মাধ্যমে। ফলে ব্যবসায়ীরা মূলধন সংকটের পাশাপাশি ব্যাংকঋণের সুদহারের বোঝা টানতে টানতে দেউলিয়া হওয়ার উপক্রম, যা স্বাভাবিক ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে বড় অন্তরায়। তাই কোনো কারণে টাকা যদি ছয় মাসের বেশি সময় আটকে থাকে তার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা কী সুবিধা পাবেন আইনে এমন ব্যাখ্যা থাকা প্রয়োজন।
অন্যদিকে বিক্রির ওপর সোর্স ভ্যাটও সমন্বয় করা হয় না অগ্রিম কর থেকে। এসব প্রতিকূলতার পরিপ্রেক্ষিতে ৫ শতাংশ অগ্রিম কর ৬০ দিনের মধ্যে সমন্বয় করে ব্যবসায়ীদের ফেরত দেওয়ার বিধান করা অত্যাবশ্যক।
গত জুন ক্লোজিংয়ে এনবিআরের অনুরোধ সাপেক্ষে ইস্পাত ব্যবসায় জড়িত ব্যবসায়ীরা অগ্রিম ট্যাক্স জমা দেন। কিন্তু তা এখনও সমন্বয় করা হয়নি। তাই ব্যবসায়ীদের পরিচালন মূলধন সংকটে পড়তে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে আমরা মনে করি, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে জমা থাকা অগ্রিম ট্যাক্স অনতিবিলম্বে সমন্বয় করা অত্যাবশ্যক।
ব্যক্তি পর্যায়ের ক্রেতাদের ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন থাকে না। ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন থাকা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। যদিও এটি আইন করা হয়েছে তা একেবারেই অযৌক্তিক। এ প্রথা শুধু ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে। এ ছাড়া ট্রেডিং ভ্যাট সমন্বয় করা যাবে না মর্মে এসআরও করা হয়েছে। কিন্তু বলা হচ্ছে মালামাল পরিবহনের ওপরও ভ্যাট দেওয়ার জন্য। এক্ষেত্রে ডিলারদের ৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হয়। এসব বিষয় পুনর্বিবেচনা করে ব্যবসায়িক পরিবেশ উন্নয়নে কস্ট অব ডুয়িং বিজনেস কমানোর লক্ষ্যে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
আশা করি, প্রতিবছরের মতো জাতীয় অর্থনীতি, কর্মসংস্থান, উৎপাদন, বিপণন ও ভোক্তাদের স্বার্থে এনবিআর এসব প্রস্তাব বিবেচনা করবে।
বাজেটে করপোরেট করহার কমিয়ে আনতে হবে
আসিফ ইব্রাহিম
চেয়ারম্যান
চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ
আসন্ন জাতীয় বাজেটে তালিকাভুক্ত কোম্পানির করহার (করপোরেট করহার) শতকরা ২৫ ভাগ থেকে কমিয়ে ২০ ভাগ করা যেতে পারে। এতে করে যেসব কোম্পানি লিস্টেড না তারা পুঁজিবাজারে আসতে অনুপ্রাণিত হবে। ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত লভ্যাংশের সীমা ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ-এ উন্নীত করা যেতে পারে। একইভাবে ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের করমুক্ত আয় সীমা ২ লাখ ৫০ হাজার থেকে ৩ লাখ ৫০ হাজারে নেওয়া যেতে পারে। এসএমই কোম্পানির জন্য নতুন করহার নির্ধারণ করতে হবে। অর্থাৎ নতুন যেসব কোম্পানি শেয়ার মার্কেটে আসবে তাদের জন্য প্রথমেই কর প্রদানে বাধ্য না করে প্রথম তিন বছরের জন্য শূন্য করে দেওয়া যেতে পারে এবং পরবর্তী সময়ে শতকরা ১৫ ভাগ হারে কর আরোপ করা যেতে পারে। কারণ আমাদের উদ্দেশ্য মার্কেটের গভীরতা বৃদ্ধি এবং ব্যাংকের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে শেয়ারবাজারে যেন নতুন ভালো ভালো কোম্পানি আসে সে ব্যাপারে অনুপ্রেরণা দেওয়া এবং সে জন্য কাজ করা।
এছাড়া জব নিরাপত্তার (প্রোটেকশনের) জন্য যেহেতু কভিড-উত্তর অর্থনীতিতে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে জব হারানোর সম্ভাবনা আছে, তাই সেসব ক্ষেত্রে যেসব কোম্পানির জব রিট্রেন্সমেন্ট করবে না তাদের কিছু ইনসেনটিভ এবং ট্যাক্স কনসেশনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।