Print Date & Time : 21 June 2025 Saturday 11:44 am

বাজেট নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত

লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায়ে সংশয় রয়েছে

এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম

উপদেষ্টা, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার

প্রস্তাবিত বাজেটের লক্ষ্যমাত্রাগুলো গ্রহণযোগ্য। খাতওয়ারি লক্ষ্যমাত্রা ঠিকই আছে। কিন্তু বাজেট বাস্তবায়ন নিয়ে আমি গভীর সন্দিহান। করোনা মহামারিতে অর্থনীতি পুরো সচল ছিল না। চলতি বছরে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় হয়নি। আগামী অর্থবছরেও বলা যায়, রাজস্ব আদায় ও ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা কোনোভাবে বাস্তবায়ন হবে না। তাই রাজস্ব আহরণ নিয়ে আমি গভীরভাবে শঙ্কিত।

অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে ১০ হাজার কোটি টাকা রাখা হয়েছে। স্বাস্থ্য খাতেও কিছুটা বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু গতবার দেখা গেছে, এটির বাস্তবায়ন হয়নি পুরোটা। দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। আশা করি, এবার সরকার এ বিষয়ে নজরদারি বাড়াবে।

অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ও দরিদ্র কমিয়ে আনার বিষয়ে সরাসরি কিছুই বলা হয়নি। ব্যবসায়ীদের কিছু ছাড় দেয়া হয়েছে। করোনা মহামারির জন্য ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এসবের কারণে যদি কিছুটা দরিদ্র কমে। উদ্যোক্তাদের কর ছাড়ের সুবিধায় কর্মসংস্থান হবে কিছুটা বলা যায়। আবার সামাজিক নিরাপত্তা খাতেও বরাদ্দ রাখা হয়েছে। অবশ্য সামাজিক নিরাপত্তা খাতের ব্যয়ের বড় অংশই যাবে সরকারি কর্মকর্তাদের পেনশন ও মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতায়। এদিক দিয়ে কিছুটা সহায়ক হবে।

কৃষি ও স্বাস্থ্য খাতকেও গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। বাজেটে বেশ কিছু প্রণোদনা ও ভর্তুকির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, এগুলো ইতিবাচক। বিশাল এ বাজেট বাস্তবায়নে প্রশাসনিক অদক্ষতা দূর করতে হবে এবং প্রশাসনকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে। এ বাজেট বাস্তবায়ন হবে কিনা, তা নিয়ে সবচেয়ে বেশি চিন্তা রয়েছে। 

বাজেট বাস্তবায়ন মানুষের আয় বৃদ্ধির কৌশল নেই

. সালেহউদ্দিন আহমেদ

সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক

প্রস্তাবিত বাজেট ব্যবসাবান্ধব করার চেষ্টা করেছে সরকার। একাধিক খাতে কর ছাড় দিয়েছে। করোনাকালে ছয় লাখ কোটি টাকার মতো বাজেটের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু অর্থ জোগাড় করাটা সরকারের জন্য খুবই চ্যালেঞ্জিং হবে।

করোনাকালে একটি বিশেষ বাজেটের প্রয়োজন। কর-সংক্রান্ত বিষয় সরাসরি উল্লেখ করেছে সরকার। কিন্তু অর্থ কোথা থেকে আসবে ও বাস্তবায়ন কীভাবে হবে সে বিষয়ে কোনো ধারণা দেয়া হয়নি বাজেটে। বিশেষ করে করোনাকালে নতুন করে মানুষ দরিদ্র হয়েছে। তাদের কাছে কীভাবে অনুদান যাবে, তা বলা হয়নি। করোনাকালে মানুষ আয় হারিয়েছে। বেকারত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। কর্মসংস্থান হচ্ছে না। এখন মানুষের কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। এসব ইস্যুতে কীভাবে কাজ করবে তা বলেনি সরকার।

শিল্পের পণ্য উৎপাদনে বেশকিছু করছাড় দেয়া হয়েছে। কিন্তু শ্রমঘন খাত হিসেবে বিবেচিত ক্ষুদ্র, মাঝারি প্রতিষ্ঠানে কীভাবে আর্থিক সহায়তা পৌঁছানো হবে, মানুষের আয় বৃদ্ধিতে কৌশলটি বলা হয়নি বাজেটে। টেলিভিশন উৎপাদনকারী ইলেকট্রনিকস ব্যবসায়ীরা তো বড় ব্যবসায়ী। কিন্তু তাদের বিষয়ে তেমন কিছু বলা হয়নি; তাদের তেমন সুবিধা দেয়া হয়নি।

বর্তমানে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হচ্ছে স্বাস্থ্য খাত। করোনা মহামারির দ্বিতীয় ঢেউ চলছে। প্রথম ঢেউ সামাল দিতেও বরাদ্দ ছিল। এবারও বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। কিন্তু অর্থ খরচ করা হয়নি পুরোটা। এবারের বাজেটে স্বাস্থ্যসেবার মান বৃদ্ধি ও সবার জন্য সেবা পাওয়া নিশ্চিতে কিছুই বলেনি। স্বাস্থ্য বিমা ইস্যুটি গতবার আলোচনায় ছিল। এবার কিছুই বলা হয়নি। স্বাস্থ্যসেবা এখনও রজধানীকেন্দ্রিক। অথচ করোনার প্রভাব সারাদেশেই রয়েছে। স্বাস্থ্যসেবার বিকেন্দ্রীকরণের কোনো উদ্যোগ নেই বাজেটে। উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে অবকাঠামো আছে। কিন্তু চিকিৎসক, স্বাস্থ্য উপকরণ, মেশিনারিজ ও জনবল বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হবে কিনা তা বলা হয়নি। স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে শুধু বরাদ্দ বাড়ানোর বিষয়ে বলা হয়েছে। কিন্তু কীভাবে এ অর্থ খরচ হবে, প্রতিষ্ঠানগুলোকে কীভাবে সক্ষমতা বাড়ানো হবে, সেবার মান বাড়ানো যায় কীভাবে, তা বলা হয়নি।

অর্থসংস্থানের বিষয়ে ব্যাংকঋণ ও বৈদেশিক উৎসের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বর্তমানের রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করেনি। সরকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) থেকে কিছু প্রকল্প স্থগিত করতে পারত। সেই অর্থ দিয়ে স্বাস্থ্যসহ অন্যান্য খাতে প্রকল্প নেয়া যেত। ব্যবসাকে উৎসাহ দেয়ার জন্য পদক্ষেপ নিয়েছে। কর্মসংস্থান হচ্ছে না।

দুর্নীতি ও অপচয় রোধে কিছুই বলা হয়নি। প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধিতে কিছুই বলা হয়নি। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মদক্ষতা বাড়ানোর বিষয়ে কোনো নিদের্শনা নেই। এত বড় বাজেট বাস্তবায়নে সরকারি কর্মচারীদের মধ্য থেকে সৎ, দক্ষদের উৎসাহ দেয়ার মতো কিছুই নেই। তাহলে কারা এই বাজেট বাস্তবায়নে সরকারের সহযোগী হবে? এক কথায় বলতে গেলে সবাইকে নিয়ে একটি সর্বজনীন কর্মউদ্যোগ নেয়ার কোনো প্রয়াস নেই এ বাজেটে। কর্মকৌশল না থাকায় বাজেট বাস্তবায়ন খুবই চ্যালেঞ্জিং হবে। নইলে কাগুজে হিসাবেই থেকে যাবে বাজেট পরিকল্পনা।

পুঁজিবাজারের প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটেছে বাজেটে

শিবলী রুবাইয়াতউলইসলাম

চেয়ারম্যান, বিএসইসি

২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট সন্তোষজনক হয়েছে। সার্বিক দিক বিবেচনা করে এটাকে ভালো বাজেট বলতে হবে। এই বাজেটে পুঁজিবাজার নিয়ে আমাদের বেশ কিছু প্রত্যাশা ছিল। যার বেশিরভাগই পূরণ হয়েছে। আমাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যাশা ছিল করহার কমানো। যার প্রতিফলন বাজেটে রয়েছে।

আমরা বলেছিলাম, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির করহার আরও কমাতে। বর্তমানে এ করহার ২৫ শতাংশ রয়েছে। চেয়েছিলাম এটি কমিয়ে ২০ থেকে ২২ শতাংশে আনা হোক। এটা প্রত্যাশার কাছাকাছি গেছে। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির করহার করা হয়েছে ২২ দশমিক ৫০ শতাংশ। এটা ভালো সিদ্ধান্ত। কারণ করহার কমলে কোম্পানিগুলো পুঁজিবাজারে আসতে আগ্রহী হয়। বাজেটে তালিকাভুক্ত কোম্পানির করহার কমানোর ফলে এখন দেশি-বিদেশি কোম্পানি পুঁজিবাজারে আসতে উৎসাহিত  হবে। এটা দীর্ঘদিনের চাওয়া ছিল।

অর্থমন্ত্রী বলেছেন, পুঁজিবাজারকে গতিশীল ও উজ্জীবিত করার লক্ষ্যে নানা সংস্কারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হবে। এছাড়া আধুনিক পুঁজিবাজারের বিভিন্ন ইন্সট্র–মেন্টের মধ্যে সুকুক ও ডেরিভেটিভস চালু, ওটিসি বুলেটিন বোর্ড চালু, ইটিএফ চালু এবং ওপেন এন্ড মিউচুয়াল ফান্ড তালিকাভুক্ত করা হবে। এগুলো সবই পুঁজিবাজারের ভালো উদ্যোগ।

দশমিক শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য বাস্তবোচিত নয়

. ফাহমিদা খাতুন

নির্বাহী পরিচালক, সিপিডি

আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ২০ শতাংশ ধরা বাস্তবোচিত হয়নি। সেইসঙ্গে করোনাভাইরাস মোকাবিলা এবং মহামারি থেকে ফিরে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করার জন্য যে বাজেট প্রয়োজন ছিল, তাও প্রস্তাবিত বাজেটে নেই।

জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ২০ শতাংশের কথা বলা হয়েছে। এখানে বলা হচ্ছে, ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রবৃদ্ধি দেখানো হয়েছে ৬ দশমিক ১০ শতাংশ। আমরা বলছি এটা অর্থনীতির অন্যান্য যেসব সূচক দেখা যাচ্ছে, সেই সূচকের বিবেচনায় একটু বেশি। এটা বাস্তবায়নের সম্ভাবনা খুব কম। সেটা যেহেতু আরও কম হবে, সেই লো বেঞ্চমার্ক থেকে এই যে ৭ শতাংশের ওপরে প্রবৃদ্ধি হবে, এটা আসলে বাস্তবোচিত না এবং পূরণ হবে না।

এর পরিপ্রেক্ষিতে সামষ্টিক যে কাঠামো অর্থাৎ এখানে রাজস্ব আয়, ব্যয় এবং বিনিয়োগ ইত্যাদির যে কাঠামো দেয়া হয়েছে, তা বাস্তবসম্মত হয়নি বলে আমরা মনে করছি। রাজস্ব কাঠামোতে বড় ধরনের তেমন পরিবর্তন নেই। প্রস্তাবিত বাজেটে বিদ্যমান বছরের তুলনায় রাজস্ব আয় ৩০ শতাংশ বাড়াতে হবে। এটাও অনেকটা বেশি। করোনা মোকাবিলা এবং করোনা থেকে ফিরে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করার জন্য যে বাজেট প্রয়োজন ছিল, সেটা আমরা লক্ষ্য করিনি। সামগ্রিকভাবে আমাদের কাছে মনে হয়েছে, করোনাকালে এ বাজেট দুর্বল অনুমিত এবং বাস্তবায়নের সীমাবদ্ধতা আমাদের চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলবে।

আয়করের সীমা ওপরের দিকে বাড়ানো হয়নি। একইভাবে নিচের দিকের সীমা অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। এর ফলে কর ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। নিচের দিকে আয়করের সীমা আরেকটু বাড়ালে ভোগ ব্যয় বাড়ত। তা বিনিয়োগে সহায়তা করতে পারত। অর্থাৎ পুনরুদ্ধারে সহায়তা করতে পারত।

সরকারি ব্যয়ের বর্ধিত যে বরাদ্দ, এখানে দেখা যাচ্ছে, প্রায় এক-তৃতীয়াংশ জনপ্রশাসনে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। জননিরাপত্তার ক্ষেত্রেও একটা বর্ধিত বরাদ্দ দেখা যাচ্ছে। খাতওয়ারি বিষয়ের মধ্যে সবার আগে আসে স্বাস্থ্য খাত। স্বাস্থ্য খাতের মূল বিষয় এখন টিকাদান। করোনা কতদিন থাকবে কেউ জানে না। করোনা থেকে মুক্তি না পেলে অর্থনীতিতে চাঞ্চল্য ফিরে আসবে না। সে জন্য টিকাদান কর্মসূচি সবার জন্য সম্প্রসারণ করতে হবে। টিকাদানের জন্য বাজেটে ১০ হাজার কোটি টাকা রাখা হয়েছে, এটা পর্যাপ্ত নয়।