Print Date & Time : 22 June 2025 Sunday 3:21 pm

বাজেট বিরাট অঙ্কের ধাপ্পাবাজি: বিএনপি

 

নিজস্ব প্রতিবেদক: অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের বাজেট প্রস্তাবকে ‘বিরাট অঙ্কের ধাপ্পাবাজি’ বলে আখ্যায়িত করেছে বিএনপি। সেই সঙ্গে ১৫ শতাংশ ভ্যাটের হার কমিয়ে ‘সহনীয় পর্যায়ে আনা’ ও আমানতের ওপর বর্ধিত হারে শুল্ক আরোপের প্রস্তাব বাতিলের দাবি জানিয়েছে দলটি।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর রোববার এক সংবাদ সম্মেলনে তার দলের এ আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া তুলে ধরেন। সূত্র: বিডিনিউজ

মির্জা ফখরুল বলেন, ‘বাজেটে উপেক্ষিত থেকেছে মানবসম্পদ খাত, এমনকি কৃষিও। প্রাধান্য পেয়েছে চোখ ধাঁধানো কিছু মেগা-প্রকল্প। স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ প্রয়োজনীয় ও জনকল্যাণমূলক খাতগুলোকে অবহেলা করা হয়েছে। আমরা মনে করি, এটা নিছক বিরাট অঙ্কের প্রচারণার ধাপ্পাবাজি ছাড়া আর কিছুই না। এটা মানুষকে বোকা বানানোর বাজেট, এটা প্রতারণার বাজেট।’

‘গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এ সংবাদ সম্মেলনে মির্জা ফখরুল বলেন, বাজেট দেখে তার মনে হয়েছে, কল্যাণমুখী লক্ষ্যগুলো অর্থমন্ত্রীর বিবেচনায় আসেনি। এ কারণে আমরা আশাহত ও ক্ষুব্ধ। জনগণের কাছে সরকারের কোনো দায়বদ্ধতা নেই বলেই এ বঞ্চনার বাজেট জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। এ বাজেট আমরা প্রত্যাখ্যান করছি।’

বিএনপি বলছে, বাজেটের কিছু কিছু প্রস্তাব দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনাকে বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারে।

মির্জা ফখরুল বলেন, ‘লোকের চোখে দৃশ্যমান উন্নয়ন করতে গিয়ে, দ্বিগুণ চারগুণ অর্থ ব্যয় করে একদিকে সম্পদের অপচয় ঘটানো হচ্ছে, অন্যদিকে দুর্নীতির সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে। প্রকল্প গ্রহণের স্বচ্ছতা বজায় রাখা হচ্ছে না। প্রকল্প ব্যয়ে স্বচ্ছতা নেই, ব্যয়ের গুণগত মান বজায় রাখা হচ্ছে না।’

তিনি বলেন, মুহিতের এ বাজেটে ব্যয়ের গুণগত মান বাড়ানোর কোনো দিক নির্দেশনা নেই, বিদায়ী বছরের তুলনায় এডিপির (বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি) আকার আসন্ন অর্থবছরে ৩৮ দশকি ছয় শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। এক লাফে ৩৮ দশমিক পাঁচ শতাংশ ব্যয় বৃদ্ধি অলীক ও অবাস্তব।

‘একদিকে প্রস্তাবিত বাজেটের অনুন্নয়ন ব্যয় জিডিপির আকারের ১০ দশমিক আট শতাংশ, অন্যদিকে উন্নয়ন ব্যয় জিডিপির সাত দশমিক চার শতাংশ। এ থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, প্রস্তাবিত বাজেটে অতীতের ধারায় অনুন্নয়ন ব্যয়ের প্রাধান্য অব্যাহত থাকছে।’

এত ‘বিশাল আকারের’ বাজেটেও ওই ধারা ভাঙা সম্ভব না হওয়ার বিষয়টি উদ্বেগজনক বলে মনে করছে বিএনপি।

‘বাজেট ঘাটতি পূরণে বিদেশি উৎস থেকে প্রাপ্তি ৮০ শতাংশ বেশি হবে বলে যে প্রত্যাশা অর্থমন্ত্রী করেছেন, তা ‘অসম্ভব ও কল্পনাপ্রসূত’ বলে মন্তব্য করেন ফখরুল।

‘মনে হচ্ছে, বাজেট প্রণয়নকারীরা নিছক হিসাবের অংক মেলাতে গিয়ে তাদের পছন্দসই সংখ্যাটি বসিয়ে দিয়েছেন। একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান মন্তব্য করেছে, অর্থায়নের সব উৎস দেখার পর যখন ব্যয়ের হিসাব মিলছে না, তখন পুরোটাই বৈদেশিক সাহায্য থেকে আসবে বলে ধরে নিয়ে যোগ করে দেওয়া হয়েছে।’

চালের দাম: মির্জা ফখরুল বলেন, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো হিসেব দিয়েছে, খাদ্যশস্য উৎপাদন এবার ২.৫ শতাংশ বেড়েছে।

‘প্রশ্ন হলো, ধান উৎপাদন যদি আগের বছরের বাম্পার ফলনের চেয়ে ২.৫ শতাংশ বাড়ে, তাহলে দাম এত চড়া কেন?

‘বাস্তবতা হচ্ছে, বর্তমানে চালের দাম ৪৮ টাকা হয়ে যাওয়ায় প্রায় দুই কোটি নি¤œবিত্ত পরিবারের খাদ্য নিরাপত্তা মারাত্মক হুমকিতে পড়েছে। একই সঙ্গে সরকার কৃষিখাতে ধনাত্মক প্রবৃদ্ধির যে সম্ভাবনার কথা বলেছে তাও বাস্তবসম্মত নয়। প্রবৃদ্ধিতে ‘তেলেসমাতি’ টানা দ্বিতীয় বছরের মতো বাংলাদেশের সাত সতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জনকে সরকারের ‘পরিসংখ্যানের তেলেসমাতি’ বলছেন ফখরুল।

সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘সরকার পরিসংখ্যানজনিত বিভ্রাট ঘটিয়ে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার বাড়িয়ে দেখানোর সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। প্রশ্নবিদ্ধ জিডিপি প্রবৃদ্ধি দেখিয়ে নীতিনির্ধারকরা এক ধরনের আত্মতুষ্টির রোগে ভুগছেন।’

‘সম্প্রতি প্রকাশিত গ্লোবাল ফাইনান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ২০১৪ সালে বাংলাদেশ থেকে যে পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে, তা জিডিপির চার শতাংশের মতো। এ পাচার হওয়া টাকার একটি বড় অংশ হলো অবৈধ উপায়ে অর্জিত কালো টাকা।’

আমরা মনে করি, পাচার হওয়ার পেছনের কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে দেশে বিনিযোগের সুষ্ঠু পরিবেশের অভাব, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, দেশের অর্থনীতির প্রতি আস্থার অভাব এবং দেশের বাইরে একটি নিরাপদ বলয় তৈরি করে রাখা, যাতে সুযোগ মতো বেরিয়ে যাওয়া যায়। ব্যাংকিং খাতের করুণ অবস্থায় লুটের টাকার একটি নিরাপদ আশ্রয় তৈরি করাও এর উদ্দেশ্য। বিদেশে বাংলাদেশের এত অর্থ চলে যাচ্ছে, অথচ সরকার একেবারেই নীরব, কোনো উদ্যোগ তাদের নেই।’

কর কাঠামো প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ঘাটতি পূরণে বাজেটে জনগণের ওপর বাড়তি করারোপের প্রস্তাবের সমালোচনা করেন বিএনপি মহাসচিব।

তিনি বলেন, ‘সামগ্রিক বিবেচনায় বাজেটে কর কাঠামো অত্যন্ত পশ্চাদমুখী। বেশিরভাগ কর আসবে পরোক্ষ সূত্র থেকে। পরোক্ষ করের বোঝা ধনী-গরিব নির্বিশেষে সব শ্রেণির ভোক্তাদের ওপর সমান হারে বর্তায়। এ ধরনের কর জনকল্যাণবিরোধী।’

বিএনপি মহাসচিব মূল্যস্ফীতির নিরিখে আয়করের সর্বনি¤œ সীমা নির্ধারণ এবং কৃষি যন্ত্রপাতির শুল্ক প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে বলেন, বাজেটের আকার বাড়লেও আনুপাতিক হারে কৃষিতে ভর্তুকি বাড়েনি।

ভ্যাটের আওতামুক্ত পণ্যের তালিকা নিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রস্তাবিত ১৫ শতাংশ ভ্যাট দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সর্বোচ্চ। এবারের বাজেটে আরোপিত ভ্যাট প্রায় সব পণ্যের ওপর প্রযোজ্য। তবে অর্থমন্ত্রী মানুষকে বোকা বানানোর জন্য অপ্রয়োজনীয় পণ্যের লম্বা তালিকা যোগ করে বাহবা কুড়ানোর চেষ্টা করেছেন। এগুলোর মধ্যে জীবন্ত ঘোড়া, খচ্চর, শুকরের মাংস, টার্কি ও বিভিন্ন জীবন্ত পক্ষীসহ বেশি কিছু পণ্যসামগ্রী রয়েছে। বেশ কিছু পণ্য রয়েছে, যেগুলো দেশের সাধারণ মানুষ আদৌ ব্যবহার করে না। এভাবে শূন্য ভ্যাটের তালিকা একটি প্রহসনে পরিণত হয়েছে।’

ফখরুল বলেন, উচ্চহারে ভ্যাট আহরণের ফলে দ্রব্যমূল্য বাড়বে, মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়বে, জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত, নি¤œবিত্ত ও দরিদ্র মানুষ ভয়ানক দুর্ভোগের মধ্যে পড়বে বলে আমরা মনে করি। আমরা বিভিন্ন প্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর আরোপিত ১৫ শতাংশ ভ্যাটের হার সহনীয় পর্যায়ে হ্রাস করার দাবি জানাচ্ছি।’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন সংবাদ সম্মেলনে বলেন, যেভাবে বিভিন্ন পণ্যের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে, তা সাধারণ মানুষের পকেট থেকে ‘জোর করে অর্থ আদায়ের মতো’।

‘অতীতে যেভাবে ইংরেজরা জোরপূর্বক কৃষকদের নীল চাষে বাধ্য করতো, ঠিক সেভাবে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ হয়েছে। একইভাবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। একই পণ্যের ওপর বারবার ট্যাক্স দিতে হবে।’

এক প্রশ্নের জবাবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান বলেন, ‘বিএনপির সময়ের বাজেটগুলো দেখবেন- অনুন্নয়ন খাতে ব্যয় উন্নয়ন খাতের ব্যয়ের তুলনায় শতকরা হারে সর্বনি¤œ পর্যায়ে আমরা রেখেছি। আর এখন বাজেটে অনুন্নয়ন খাতের ব্যয় বেশি রাখা হয়েছে বলেই তা কখনও স্বাস্থ্যকর বাজেট হতে পারে না। এখন আনপ্রোডাক্টিভ খাতে ব্যয় মেটানোর জন্য কী করতে হয়েছে সরকারকে? দরিদ্র মানুষের ওপর করের বোঝা চাপাতে হয়েছে। এটা অত্যন্ত আনহেলদি ট্রেন্ড।’

সাবেক বিএনপি সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বাজেটে যে প্রবৃদ্ধির হার দেখানো হয়েছে, তা ‘প্রশ্নবিদ্ধ’। বাস্তবতা হচ্ছে, গত কয়েক বছরে সাধারণ মানুষের সত্যিকারের আয় কমে গেছে। প্রবৃদ্ধি বাড়লে আয় তো বাড়বে, সেটা তো হচ্ছে না।’

এ বিএনপি নেতা বলেন, বাংলাদেশে ব্যবসা করার খরচ অনেক বেশি। ‘চাঁদাবাজি, দুর্নীতি, আর্থিক খাতে অব্যবস্থাপনার কারণে’ এখানে ব্যবসা থেকে আয় কমে গেছে। এর ফলে বিনিয়োগ হচ্ছে না, টাকা বাইরে চলে যাচ্ছে। অর্থাৎ রিয়েল ইকোনমি পারফর্ম না করার কারণে পুরো চাপটা চলে যাচ্ছে জনগণের ওপরে, যেটা ১৫ শতাংশ ভ্যাট, ব্যাংকের আমানতের ওপর আবগারি শুল্ক ইত্যাদি ইত্যাদি।’