মো. মাঈন উদ্দীন: একটি দেশের বাজেটের কর্মকাণ্ড অনেক ব্যাপক। বাজেটের লক্ষ্য শুধু সরকারের আয় ও ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করা নয়। এর লক্ষ্য হলো গ্রহণযোগ্য একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট হবে বাংলাদেশের ৫১তম বাজেট। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের মূল বাজেটের আকার ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। এতে মোট দেশজ ও উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ৭ দশমিক ২ শতাংশ। এর আগে ২০২০-২১ অর্থবছরের আকার ছিল ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য সরকার ৬ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার বাজেট ঘোষণার প্রস্তুতি নিচ্ছে। নতুন বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) লক্ষ্যমাত্রা ৭ দশমিক ৫ শতাংশ ধরা হচ্ছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের এক সূত্রে জানা গেছে, আগামী ৯ জুন বৃহস্পতিবার ২০২২ জাতীয় সংসদে নতুন অর্থবছরের বাজেট পেশ করবেন অর্থমন্ত্রী। চলতি অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি ধরা হয়েছিল ২ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা। সম্প্রতি আর্থিক মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিময় হার সংক্রান্ত সমন্বয় কমিটির বৈঠক সূত্রে জানা গেছে আগামী বাজেটে ঘাটতি ধরা হবে ২ লাখ ৪৩ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে গত ফেব্রæয়ারিতে দেশে মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ১ শতাংশ। যেখানে চলতি অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। আসন্ন অর্থবছরের মূল্যস্ফীতির হার ৫ দশমিক ৫ শতাংশ ধরা হচ্ছে বলে জানা গেছে। বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, আগামী অর্থবছরের মোট আয় ধরা হবে ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। যেখানে চলতি অর্থবছরে আয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা। সেই অনুযায়ী আসন্ন বাজেটে প্রাক্কলিত আয়ের পরিমাণ বাড়ছে ৪৪ হাজার কোটি টাকা। চলতি বাজেটে ২০২০-২১ অর্থবছরে মূল বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ধরা হয়েছে ২ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরের জন্য তা ২ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা হতে পারে। এদিকে সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক’ প্রতিবেদনে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি সম্পর্কে পূর্বাভাস দিয়েছে। সংস্থাটির মতে ২০২৩ সালে বাংলাদেশের জিডিপিতে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে এবং ২০২৭ সালে তা বেড়ে ৬ দশমিক ৯ শতাংশ হতে পারে। বিশ্বব্যাংক বলেছে, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে। আর এডিবি দিয়েছে ৬ দশমিক ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস। গত ফেব্রæয়ারিতে দেশের মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৬ দশমিক ১ শতাংশ। আইএমএ পূর্বাভাস দিয়েছে পুরো বছরজুড়ে মূল্যস্ফীতি হতে পারে প্রায় ৬ দশমিক ৪ শতাংশ। বাজেটের সামাজিক নিরাপত্তা খাত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই খাতে উপকারভোগীদের সঠিকভাবে সুফল পাওয়ার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার ঘাটতি রয়েছে। জানা গেছে আসন্ন বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে উপকারভোগীর সংখ্যা ও আওতা বাড়ানো হবে। বর্তমানে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ১২৩টি কর্মসূচি রয়েছে। সরকারের ৩০টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ এ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। চলতি অর্থবছরে ৫৭ লাখ উপকারভোগী বয়স্ক ভাতা পাচ্ছে। আগামী অর্থবছরে আরও ১১ লাখ যোগ হয়ে ৬৮ লাখ হতে পারে। স্বামী পরিত্যক্ত বিধবা ভাতা আওতা নতুন করে ১০০ উপজেলাকে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে, যা একটি ভালো উদ্যোগ। ফলে ২০২২-২৩ অর্থবছরে উপকারভোগী উপজেলার সংখ্যা হচ্ছে ৩৬২। চলতি অর্থবছরে বয়স্ক ভাতার জন্য বরাদ্দ রয়েছে ৩ হাজার ৪৪৪ কোটি টাকা আগামী বাজেটে তা ৩ হাজর ৯৪৪ কোটি টাকা হতে পারে। এখনও বয়স্কদের ৫০০ টাকা করে ভাতা দেয়া হয়, যা বর্তমান বাজার মূল্যের সঙ্গে বেমানান। তাই ৫০০ টাকা থেকে ভাতার পরিমাণ বাড়ানো উচিত। পাশাপাশি প্রাথমিক চিকিৎসা সুযোগ-সুবিধা ও চিকিৎসা ব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণ করা উচিত। বর্তমানে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সন্তোষজনক হলেও সাধারণ মানুষের মাঝে তার সুফল সমভাবে পৌঁছছে না। সমাজের বহু মানুষের প্রকৃত আয় বাড়েনি। তাছাড়া মূল্যস্ফীতি মানুষের প্রকৃত আয়কে কমিয়ে দিয়েছে। দ্রব্যমূলের ঊর্ধ্বগতিতে প্রান্তিক মানুষ হিমশিম খাচ্ছে। মাথাপিছু আয় ধরে দেশ নিন্ম মধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছেছে ঠিকই কিন্তু সমাজে আয়-বৈষম্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তাই বাজেটে বৈষম্য দূর করতে কর ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। ধনীদের কর ফাঁকির পথ বন্ধ করতে হবে। প্রত্যক্ষ করের আওতা বাড়াতে হবে। দেশের জন্য প্রবৃদ্ধি একটি গুরুত্বপূর্ণ ঠিকই, তবে এ প্রবৃদ্ধিকে সমতাভিত্তিক উন্নয়নের মাধ্যমে বিস্তার ঘটাতে হবে। তাই আগামী বাজেটে এর প্রতি গুরুত্ব দেয়া উচিত। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাজেটের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক। শিক্ষাব্যবস্থার সিলেবাস ও কারিকুলাম পরিবর্তন নয়; বরং সঠিক মেধাসম্পন্ন জাতি গঠন ও মানসম্পন্ন শিক্ষাব্যবস্থা গঠন করার জন্য বাজেটে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ থাকা উচিত। মানসম্পন্ন শিক্ষার জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ করা উচিত। শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকা উচিত। কভিড মহামারিতে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুর্বলতাগুলো আরও স্পষ্ট হয়েছে। এখন দরকার সঠিক পরিবর্তন ও বাস্তবভিত্তিক প্রয়োগ ও যথাযথ বরাদ্দ। বাজেটে তার প্রতিফলন দেখানো উচিত। দেশের প্রবৃদ্ধি যেটুকু বেড়েছে সে হারে কর্মসংস্থান বাড়েনি। বর্তমানে যে প্রবৃদ্ধি নিয়ে কথা বলা হয়, তা কর্মসংস্থানবান্ধব নয়। লাখ লাখ যুবক বর্তমানে চাকরিহারা, বেকার এবং প্রয়োজনীয় পুঁজির অভাবে ব্যবসাবাণিজ্যে সংযুক্ত হতে পারছে না। কর্মসংস্থান সৃষ্টি, কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানোর ক্ষেত্রে আগামী বাজেটসহ পরবর্তী বাজেটগুলোতে সুস্পষ্ট নজরদারি থাকা উচিত। বিদেশেও কর্মসংস্থান বর্তমানে কাক্সিক্ষত হারে বাড়ছে না। কভিড সংক্রমণ কমে আসার পর মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগের সুযোগ তৈরি হলেও দেশ এ ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে। কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য বেসরকারি বিনিয়োগের প্রতি জোর দিতে হবে। এজন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ ব্যবস্থার তদারকি বাড়াতে হবে। ব্যাংকের কৃত্রিম আয় বন্ধ করে বিনিয়োগের আদায়ের হার বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও কার্যকর ভ‚মিকা পালন করা উচিত। কিছু কিছু ব্যবসায়ী মনে করেন ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে তা না দিয়ে পারা যায় কি না সে চিন্তা করে। কভিডের দোহাই, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ব্যবসা পরিস্থিতি ভালো নাÑএসব কথা বলে ব্যাংকের ঋণ পরিশোধে গড়িমসি করেন। অর্থনীতি টেকসই করতে হলে সব শ্রেণি-পেশার ব্যক্তিদের পারস্পরিক সহযোগিতা-সমর্থন করা উচিত। প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, ব্যবসাবাণিজ্যের প্রসার ঘটছে। কিন্তু ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের প্রসার তেমন ঘটেনি। অনেক ক্ষেত্রে দেশ এখনও আমদানিনির্ভর। তাই অভ্যন্তরীণ অনুঘটকগুলোর প্রতি বিশেষ নজর দেয়া উচিত। কভিড-পরবর্তী সময় আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তাই এ বাজেট গতানুগতিক না হয়ে ব্যতিক্রম বাজেট হওয়া উচিত। বাজেট হওয়া উচিত কর্মসংস্থানবান্ধব। দেশের মূল্যস্ফীতিকে সহনীয় পর্যায়ে রাখা, বৈষম্য কমানো, উৎপাদনশীলতা ও প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বাড়ানোর কৌশল বাজেটে নিতে হবে। ব্যক্তি খাতের করসীমা ৩ লাখ টাকা থেকে বাড়ানো উচিত। এনবিআর’র তথ্য মতে বর্তমানে ৭৮ লাখ টিআইএনধারী রয়েছে। তাদের মধ্যে আয়কর রিটান দাখিল করেন ৩৫ লাখ। আয়কর রিটার্ন সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি করের আওতা বাড়াতে হবে। স্বল্প আয়ের মানুষের ওপর করের বোঝা না বাড়িয়ে মানুষের কষ্ট ভোগান্তি যাতে না বাড়ে সেদিকে খেয়াল রাখা উচিত। নিত্যপণ্যের ওপরে ভ্যাট কমিয়ে ভ্যাটের আওতা বাড়ানো উচিত। কর সংগ্রহের পদ্ধতিগত উন্নয়ন করতে হবে। এনবিআর’র সক্ষমতা বাড়াতে হবে। আয় বুঝে ব্যয় করার বাজেট প্রণয়ন করতে হবে। মাথাপিছু বিদেশি ঋণের বোঝা ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে। ২০১৬ সালে জুন শেষে মাথাপিছু বিদেশি ঋণ ছিল ২৫৭ মার্কিন ডলার। ২০২১ সালে ডিসেম্বরে তা বেড়ে দাড়ায় ৫৪১ ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে ২০১৬ সালে জুন শেষে দেশে দেশি-বিদেশি ঋণ ছিল ৪ হাজার ১১৭ কোটি ডলার। ২০২১ সালে জুনে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৮ হাজার ১৫৭ কোটি ডলার। ২০২১ সালে ডিসেম্বরে তা দাঁড়ায় ৯ হাজার ৭০ কোটি মার্কিন ডলার। অর্থনীতি ভিত টেকসই করতে হলে অভ্যন্তরীণ কৃষি, শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধি, রপ্তানি বৃদ্ধিসহ ক্রমান্বয়ে আমদানি কমানোর পরিকল্পনা নিতে হবে। বিদেশি ঋণের বোঝা যাতে না বাড়ে সেদিকে নজর দিতে হবে। দ্রæততম সময়ে রপ্তানি বৈচিত্র্যকরণ ও বিদেশে বাজার সম্প্রসারণের প্রতি মনোযোগ দিতে হবে। শুধু তৈরি পোশাকসহ গুটিকয়েক পণ্যের ওপর নির্ভর না থেকে আরও বেশি কৃষি ও কৃষিজাত পণ্যসহ নতুন নতুন রপ্তানি পণ্যের সমারোহ ঘটাতে হবে। আসন্ন বাজেটে এসব বিষয় প্রতিফলন থাকা চাই। এবারের বাজেট প্রণয়ন করতে প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি কর্মসংস্থান বাড়ানো, বৈষম্য হ্রাস ও নিত্যপন্যের দাম প্রান্তিক মানুষের সাধ্যের মধ্যে রাখার প্রতি গুরুত্ব দেয়া উচিত।
ব্যাংক কর্মকর্তা ও মুক্ত লেখক
main706@gmail.com