বাড়ছে ঋণ অবলোপন কমছে আদায়

জয়নাল আবেদিন: খেলাপি কম দেখানোর সহজ উপায় ঋণ অবলোপন। দীর্ঘদিন থেকে খেলাপির খাতায় পড়ে থাকা ঋণ অবলোপন করে খেলাপি কমাতে উৎসুক ব্যাংকগুলো। তথ্যমতে, গত বছরের প্রথম ৯ মাসে ৯৭৪ কোটি টাকা ঋণ অবলোপন করেছে ব্যাংকগুলো। তবে আদায় নতুন করে হয়েছে অর্ধেকেরও কম। এই প্রক্রিয়ায় খাতা-কলমে খেলাপি ঋণ কমলেও দীর্ঘমেয়াদে ব্যাংকের জন্য ক্ষতি বলে মত বিশেষজ্ঞদের।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য বলছে, ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে তফসিলি ব্যাংকগুলো ঋণ অবলোপন করেছে ৯৭৩ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। তবে এ সময়ে আদায় হয়েছে মাত্র ৪৭২ কোটি টাকা। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে মোট ঋণ অবলোপনের স্থিতি ৫৭ হাজার ৯৭৫ কোটি টাকা। তবে ২০০৩ সাল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আদায়-পরবর্তী অবলোপনকৃত ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৩ হাজার ৬০৯ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। সুতরাং ১৯ বছরে অবলোপনকৃত ঋণ থেকে আদায় হয়েছে মাত্র ১৪ হাজার ৩৬৬ কোটি টাকা।

প্রাপ্ত তথ্যে আরও দেখা যায়, গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংকের অবলোপনকৃত খেলাপি ঋণ ১৭ হাজার ২১৯ কোটি টাকা। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ২৪ হাজার ৯৫৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা, বিদেশি ব্যাংকগুলোর এক হাজার ৭১ কোটি টাকা এবং বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর ৩৬৫ কোটি টাকা।

এদিকে ২০১৯ সালে নতুনভাবে ঋণ অবলোপন করা হয় দুই হাজার ৫৯৬ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। একই বছরে আদায় হয় ৮৩১ কোটি টাকা। ২০২০ সালে অবলোপন করা হয় ৯৭০ কোটি ৫৯ লাখ টাকা, তবে সেই সময়ে আদায় হয় ৭৩৬ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। সুতরাং অবলোপনের খাতায় চলে গেলে সেই ঋণ আদায়ের সম্ভাবনা কমে যায় অনেকগুণ। সব মিলিয়ে গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ থেকে অবলোপনের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৭ হাজার ৯৭৫ কোটি টাকা, যা ব্যাংক খাতের বর্তমান যে পরিমাণ খেলাপি তার ৫৭ দশমিক ৩১ শতাংশ।

নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকের অশ্রেণিকৃত বা নিয়মিত ঋণের বিপরীতে দশমিক ২৫ থেকে পাঁচ শতাংশ হারে প্রভিশন রাখতে হয়। তবে খেলাপির শ্রেণিভেদে ২০ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত প্রভিশন রাখার বিধান রয়েছে। ব্যাংকগুলো তাদের ব্যালেন্স শিটকে খেলাপির এ জঞ্জাল থেকে মুক্ত করতে অবলোপনের পথ বেছে নেয়। তিন বছরের বেশি সময় ধরে পড়ে থাকা মন্দ মানের ঋণগুলোকে অবলোপন করে ব্যাংকগুলো। সেক্ষেত্রে তাদের আয়ের টাকা দিয়ে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হয়।

সংশ্লিষ্ট ব্যাংকাররা জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালার আওতায় ২০০৩ সাল থেকে ব্যাংকগুলো ঋণ অবলোপন করে আসছে। যদিও প্রথমে পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে পড়ে থাকা খেলাপি ঋণ অবলোপন করা যেত, এখন তা তিন বছর হলেই অবলোপন করা যায়। সাধারণত খেলাপি হওয়ার পর যে ঋণ আদায় করার সম্ভাবনা খুবই কম, সে ঋণ অবলোপন করে ব্যাংকগুলো। তবে এ ঋণ পুনঃতফসিল বা পুনর্গঠন করা যায় না।

সাম্প্রতিক সময়ে খেলাপি ঋণ অবলোপনের ক্ষেত্রে নীতিমালায় কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। আগে মামলা ছাড়া ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত অবলোপন করা যেত। আর এখন দুই লাখ টাকা পর্যন্ত মামলা ছাড়াই অবলোপন করা যায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এমন শিথিল নীতিমালার কারণে খেলাপি ঋণ অবলোপন বাড়িয়েছে ব্যাংকগুলো।

গত কয়েক বছরে নানা অনিয়মের ফলে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ অধিক পরিমাণে বেড়ে গেছে। এ কারণে ২০১৯ সালে বিশেষ নীতিমালার আওতায় ১০ কোটি টাকার অধিক কিন্তু ৫০০ কোটি টাকা পর্যন্ত দুই শতাংশ ডাউনপেমেন্টে ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ দেয় সরকার। যদিও কভিডের কারণে ব্যবসায়ীদের ক্ষতি বিবেচনায় দফায় দফায় বিভিন্ন ধরনের সুযোগ দেয়া হয়, যা গত ডিসেম্বরে শেষ হয়েছে। ব্যাংকগুলো আর্থিক প্রতিবেদন পরিচ্ছন্ন দেখাতে কৌশলে মন্দমানের খেলাপি ঋণ অবলোপন করার পথে হাঁটছে। একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০১৫ সালে বড় ঋণগ্রহীতাদের পুনর্গঠন ও পুনঃতফসিলের জন্য ফের সুযোগ চাওয়া হলে কেন্দ্রীয় এ সুযোগ বাতিল করে দেয়।

ঋণ অবলোপন বিষয়ে কোম্পানি আইন বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার মুজাহিদুল ইসলাম শাহিন বলেন, অর্থঋণ আদালতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ মামলা হাইকোর্টের আদেশে স্থগিত থাকায় মামলা বছরের পর বছর নিষ্পত্তি করা যাচ্ছে না। এছাড়া চলমান মামলার বিচারকাজ অযৌক্তিকভাবে মুলতবি রাখা হয়। বিচারকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ না থাকায় এসব মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি করা সম্ভব হচ্ছে না।

তিনি বলেন, স্থগিত মামলাগুলোর একটি তালিকা তৈরি করে আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রধান বিচারপতির কাছে পাঠানো উচিত। আইন মন্ত্রণালয় প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আলাপ করে এসব স্থগিতাদেশের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারে। এছাড়া অর্থঋণ আদালতের বিচারক বৃদ্ধি এবং দক্ষ বিচারক দিয়ে এসব মামলার বিচার পরিচালনার ব্যবস্থা করতে হবে বলে উল্লেখ করেন ব্যারিস্টার তানজীব-উল আলম।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ঋণ অবলোপনের নীতিমালা করা হয়েছিল ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণকে সহজে আদায়ের জন্য। তবে অর্থঋণ আদালতের নানা দীর্ঘসূত্রতার কারণে আদায় প্রক্রিয়া গতিহীন হয়ে পড়েছে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০