তাপস কুমার, নাটোর: নাটোর-বগুড়া মহাসড়কের পাশে সিংড়ার নিংগইন এলাকা। পথ অতিক্রমকালে শুঁটকির ঘ্রাণ উপেক্ষা করা কঠিন। ফিরতি পথে অনেকেই ঢুঁ মেরে যান চলনবিল অধ্যুষিত সিংড়া উপজেলার একমাত্র শুঁটকি পল্লিতে। ভোজনপ্রিয়দের কাছে এখনও স্বাদে-ঘ্রাণে অতুলনীয় চলনবিলের শুঁটকি। তবে মাছ সংরক্ষণাগার থাকলে চলনবিলের মাছকেন্দ্রিক অর্থনীতির নতুন দিগন্ত উম্মোচন হবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার ভোরের আলো ফোটার পরপরই যাওয়া সিংড়ার সেই শুঁটকির রাজ্যে। তখনও ফাঁকা নাটোর-বগুড়া মহাসড়ক। ততক্ষণে শুঁটকি পল্লিতে একে একে আসা শুরু করেছেন চার চাতালের মাছ কাটা-বাছাইয়ের শ্রমিকরা। বাঁশের মাচায় ছৈইয়ে ঢাকা চালার নিচে স্তূপ করে রাখা আধা-শুকনো চিংড়ি, টেংরা, পুঁটি, খলসে, বাতাসি, চেলা, মলা, টাকি, বাইম, শোল, বোয়াল, গজার, মাগুর, শিং, কইসহ বাহারি মাছের শুঁটকি।
শেরকোল ইউনিয়নের পুঁটিমারী গ্রামে ষাটোর্ধ জহির উদ্দীন পুঁটি মাছ বিক্রি করতে এসেছেন শুঁটকি পল্লিতে। সকালের সূর্যালোক স্বচ্ছ-সাদা পুঁটি মাছের ওপর ঠিকরে পড়ে চক চক করছিল।
জহির উদ্দীন জানালেন, পানি শুকিয়ে বিলে এখন শুধু কাদা। তাছাড়া আগের মতো মাছও নেই। কয়েক দিনে তার খলইয়ে কেজি দশেক পুঁটি উঠেছে। লবণ মেখে দুদিন পর প্রতি কেজি ১০০ টাকা দরে বিক্রি করেছেন তিনি।
তার কাছ থেকে কেনা পুঁটিগুলো পানিতে ধোয়া শেষে লবণ মাখছিলেন শুঁটকি পল্লির চার চাতালের একটির মালিক নাসির উদ্দীন। তিনি জানান, কয়েক বছর আগেও শুঁটকির মৌসুমে দিনে অন্তত ৫০ কেজি মাছ কিনতেন। এখন মাছ পাওয়া যায় মোটের ওপর ২০ থেকে ২৫ কেজি। মাছের অভাবে আগের মতো শুঁটকি তৈরি হয় না বলেও তিনি জানান।
অপর চাতাল মালিক আনোয়ার হোসেন জানান, ‘চলনবিলে মাছের সংকটের কারণে শুঁটকি তৈরিতে দ্বিগুণ খরচ হচ্ছে। মাছ বেশি বা কম হোক শ্রমিকদের নির্ধারিত টাকাই মজুরি দিতে হয়। সব মিলিয়ে শুঁটকি তৈরিতে খুব একটা লাভ হয় না।’
স্থানীয় মাছের পাশাপাশি দক্ষিণাঞ্চল থেকেও অল্পকিছু মাছ আসে শুঁটকি পল্লিতে। এর মধ্যে রূপচাঁদা, লইট্টা, বড় ছুরি, ইলিশ, বড় ও মাঝারি চিংড়ি রয়েছে। মহাসড়কের পাশেই বসে শুঁটকির দোকান। সেখানে মাছভেদে প্রতি কেজি শুঁটকির দাম সাড়ে ৪০০ টাকা থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত। এর মধ্যে রূপচাঁদা শুঁটকি প্রতি কেজি দুই হাজার টাকা, লইট্টা ৭০০, ছুরি এক হাজার ১০০, ইলিশ ৭০০ থেকে এক হাজার ৬০০, মলা ও কাচকি ৭৫০, শৈল দেড় হাজার, টাকি ৭০০, পুঁটি ২৫০ টাকায় বিক্রি হয়।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, প্রক্রিয়াজাতকরণে কেমিক্যাল ব্যবহার না করায় স্বাদ অক্ষুণ্ন থাকে। এজন্য খুচরা ক্রেতাও আসে প্রচুর। সিংড়ার শুঁটকির মূল ক্রেতা সৈয়দপুরের ব্যবসায়ীরা। প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ মণ শুঁটকি বিক্রি হয়। এছাড়া রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, দিনাজপুর, কক্রবাজার, রাজশাহী, কুষ্টিয়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের পাইকাররা শুঁটকি কিনে নিয়ে বিক্রি করেন।
শুঁটকি উৎপাদনে জড়িতরা বলেন, ‘চলনবিলে দেশীয় মাছ কমছে। তবে ভরা বর্ষায় কিছু মাছ বংশবিস্তার করে বিলের পানিতে। তখন বাজারেও সস্তায় বিক্রি হয় মাছগুলো। চলনবিলের চাহিদা মিটিয়ে মাছগুলো বাইরে চলে যায়। বিভিন্ন এলাকার পাইকাররা কম দামে বিলের মাছগুলো কিনে বাইরের বাজারে চড় দামে বিক্রি করে।
শুঁটকির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, ‘একটি মাছ সংরক্ষণাগার থাকলে বর্ষার সস্তা মাছগুলো সংরক্ষণ করে শীতের শুরুতে শুঁটকি তৈরি করা যেত। মাছ সংরক্ষণাগারই উšে§াচন করতে পারে চলনবিলের মাছকেন্দ্রিক অর্থনীতির নতুন দিগন্ত।’
জেলা মৎস কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘সিংড়ার শুঁটকি পল্লিতে প্রতি মৌসুমে ৩০০ টন শুঁটকি উৎপাদন হয়। গত অক্টোবর পর্যন্ত ১৫২ মেট্রিক টন পর্যন্ত শুঁটকি উৎপাদন হয়েছে। তবে বিগত কয়েক বছর চলনবিলে পানি কম থাকায় মাছের জন্য অনুকূল পরিবেশ থাকছে না। এর ফলশ্রুতিতে মাছ এবং মাছ থেকে শুঁটকির পরিমাণ কমে গেছে।’
নাটোর-৩ (সিংড়া) আসনের সংসদ সদস্য ও আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, ‘সিংড়ার কৃষি ও মৎস্য সম্পদের সংরক্ষণে ইতোমধ্যে সমন্বিত উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ শুরু হয়েছে। এতে মাছ সংরক্ষণের জন্য নির্দেশনা ও অবকাঠামোগত সুবিধা বিদ্যমান থাকবে।’ পরিকল্পনা প্রণীত হলে বাস্তবায়নের মাধ্যেম শুঁটকিসহ মাছকেন্দ্রিক অর্থনীতিতে বিপ্লব সূচিত হবে বলেও মনে করেন তিনি।