Print Date & Time : 17 June 2025 Tuesday 3:44 am

বাড়ছে থ্যালাসেমিয়া রোগী: প্রয়োজন আরও স্বেচ্ছা রক্তদাতা

মনিরুজ্জামান: একটি ঘটনা। ভাই ও বোন দুজনই থ্যালাসেমিয়া রোগী। প্রতি মাসে রক্ত নেয়া লাগে বলে দুজন একসঙ্গে রক্ত নিতে যান। এতে বাবা-মায়েরও সুবিধা হয়। 

একদিন হঠাৎ রক্ত নেয়ার সময় ঘনিয়ে এলে তারা হাসপাতালে গিয়ে রক্ত পেলেন না। এক দিন, দুই দিন, তিন দিন হয়ে গেল। রক্ত নেই। এদিকে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দুজনের অবস্থা ক্রমাগতভাবে খারাপ হতে শুরু করল।

এর মধ্যে একজন ডাক্তার দেখলেন যে তার রক্তের গ্রæপের সঙ্গে মিলে যায়। তিনি সঙ্গে সঙ্গে রক্ত দিলেন। কিন্তু রক্তের ব্যাগ তো একটা, রোগী দুজন। বোন বলছে, ‘ভাইকে রক্ত দিন,’ ভাই বলছে, ‘বোনকে।’ অবশেষে বোনের জেদের কাছে হার মানল ভাই, রক্ত নিল। কিন্তু আরেকটি ব্যাগ রক্ত জোগাড় সম্ভব হলো না। বোনটি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল।

এমন করুণ গল্প নিশ্চয়ই আরও আছে। কারণ আমাদের দেশে বর্তমানে ১০-১২ শতাংশ মানুষ, অর্থাৎ প্রায় দেড় কোটি মানুষ থ্যালাসেমিয়ার বাহক। বছরে প্রায় সাত হাজার থেকে ১৫ হাজার শিশু থ্যালাসেমিয়া রোগ নিয়ে জš§গ্রহণ করে (সূত্র: থ্যালাসেমিয়া সমিতির ওয়েবসাইট)। যারাই এ রোগে আক্রান্ত তাদের প্রতি মাসে দুই থেকে তিনবার রক্ত নিতে হয় বেঁচে থাকার জন্য। 

থ্যালাসেমিয়া কী: থ্যালাসেমিয়া একটি বøাড ডিজঅর্ডার। অনেকেই একে রক্তের ক্যানসার ভেবে ভুল করেন। তবে এটি বংশগত জিনঘটিত একটি রোগ। এতে  রক্তে অক্সিজেন পরিবহনকারী হিমোগেøাবিন উৎপাদনে ত্রæটি দেখা দেয়, যার ফলে রক্তে অক্সিজেন স্বল্পতা (অ্যানিমিয়া) ঘটে।

থ্যালাসেমিয়া রোগের উপসর্গ কী: হলদে ত্বক বা জন্ডিস, দেহে অতিরিক্ত আয়রন জমা হওয়া, স্পিøন বা প্লীহা বড় হয়ে যাওয়া, শারীরিক বৃদ্ধি হ্রাস পাওয়া, পেট বাইরের দিকে প্রসারিত হওয়া, গাঢ় রঙের মূত্র প্রভৃতি থ্যালাসেমিয়ার রোগীর উপসর্গ। সাধারণত জšে§র ছয় মাস বয়স থেকেই এই উপসর্গগুলো দেখা দিতে শুরু করে। তবে থ্যালাসেমিয়া রোগীর উপসর্গ আর বাহকের উপসর্গ এক নয়। কেউ থেলাসেমিয়ার বাহক কি না, তা বাহ্যিকভাবে বোঝার কোনো উপায় নেই। এর জন্যে রক্ত পরীক্ষা করাতে হবে।

থ্যালাসেমিয়ার রোগী ও বাহক এক নয়: থ্যালাসেমিয়ার রোগী ও বাহক হওয়া একেবারেই ভিন্ন ব্যাপার। একজন থ্যালাসেমিয়া বাহক সমাজের আর ১০ জনের মতোই স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠে। তাদের ভয়ের কোনো কারণ নেই। তবে থ্যালাসেমিয়া রোগী হলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে যত দ্রæত সম্ভব।

থ্যালাসেমিয়া মানেই জীবন শেষ নয়: থ্যালাসেমিয়ার বাহকদের কোনো চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না। থ্যালাসেমিয়া রোগীদের শরীরে রক্তের হিমোগেøাবিন ঠিকমতো তৈরি হয় না, যে কারণে একটা নির্দিষ্ট সময় পরপর তাদের রক্ত নিতে হয়। সাধারণত প্রতি মাসে এক থেকে চার ব্যাগ রক্ত রোগীরা নিয়ে থাকেন। যেহেতু বারবার রোগীকে রক্ত নিতে হয়, তাদের শরীরে আয়রনের ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সেক্ষেত্রে বিশেষ ওষুধ সেবনের প্রয়োজন হয়। আর আধুনিক যুগে থ্যালাসেমিয়া রোগের যুগান্তকারী চিকিৎসা হচ্ছে অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন (ইগঞ: ইড়হব গধৎৎড়ি ঞৎধহংঢ়ষধহঃ), যা খুবই ব্যয়বহুল।

কীভাবে এই রোগ প্রতিরোধ সম্ভব: থ্যালাসেমিয়া একটি প্রতিরোধযোগ্য রোগ। এই রোগ প্রতিরোধের প্রধান হাতিয়ার হচ্ছে সচেতনতা। একজন থ্যালাসেমিয়া বাহক যদি আরেকজন থ্যালাসেমিয়া বাহককে বিয়ে করেন, তাহলে তাদের সন্তানের থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে ২৫ শতাংশ। তাই বিয়ের আগেই বর-কনের থ্যালাসেমিয়ার পরীক্ষা করে নেয়া উচিত।

একজন থ্যালাসেমিয়া বাহক যদি আরেকজন সুস্থ মানুষকে বিয়ে করে, তাহলে সন্তানের থ্যালাসেমিয়া হওয়ার কোনো আশঙ্কা থাকে না।

প্রয়োজন স্বেচ্ছা রক্তদাতাদের সংখ্যা বৃদ্ধি: প্রতিরোধ বিষয়ে সচেতনতার পাশাপাশি স্বেচ্ছা রক্তদাতার সংখ্যা বৃদ্ধিও প্রয়োজন। কারণ থ্যালাসেমিয়া রোগীসহ যেকোনো রোগীকেই ভালো রাখা একটি মানবিক সমাজের দায়িত্ব। এ দায়িত্ব শুধু পরিবারের পক্ষে পালন করা সম্ভব না। যেহেতু থ্যালাসামিয়া রোগীর সংখ্যা বাড়ছে, সেহেতু স্বেচ্ছা রক্তদাতার সংখ্যাও বাড়া প্রয়োজন। স্বেচ্ছা রক্তদাতা বাড়া প্রয়োজন আরেকটি কারণেও। বাড়ছে জনসংখ্যা। ফলে দুর্ঘটনা, সন্তান প্রসব ইত্যাদি নিত্যনৈমিত্তিক এমন ঘটনাও বাড়ছে, যেখানে সরাসরি রক্ত বা রক্ত উপাদান প্রয়োজন। তাই সুস্থ-সবল মানুষ বিশেষত তরুণদের সচেতন হতে হবে। হতে হবে আরেকটু মানবিক, আরেকটু মমতাময়। যেন মানুষের প্রয়োজনে নিয়মিত রক্ত দিতে তারা আনন্দ পান। যেন ডাকার আগেই তারা ছুটে যান মানুষের পাশে, এক ব্যাগ রক্তদান করে একটি জীবনকে বাঁচানোর জন্য।

এই লেখার শুরুতে যে ভাইবোনের গল্পটি বলা হলো, তারা আসলে কোয়ান্টাম বøাড ল্যাবের অনুপ্রেরণা। যে ডাক্তার সেদিন রক্ত দিয়েছিলেন, তিনি ছিলেন একজন কোয়ান্টাম পরিবারের একজন সদস্য। তার কাছ থেকে এই মর্মান্তিক ঘটনা জানার পরই কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন উদ্যোগ নেয় নিরাপদ রক্তের প্রয়োজনে মানুষের পাশে এসে দাঁড়ানোর।

২০০০ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে দুই যুগের পথ চলায় কোয়ান্টাম গড়েছে প্রায় পাঁচ লাখ স্বেচ্ছা রক্তদাতার সংগঠিত ডোনার পুল। জীবন বাঁচানোর জন্য এ পর্যন্ত কোয়ান্টাম বিতরণ করেছে ১৬ লাখ ইউনিটেরও বেশি রক্ত ও রক্ত উপাদান।

থ্যালাসেমিয়া রোগীদের জন্যে কোয়ান্টাম ল্যাবে আছে বিশেষ কার্ড করার ব্যবস্থা। যেন ল্যাবে এলেই তারা সরাসরি রক্ত পেয়ে যান। সাধারণত থ্যালাসেমিয়ার রোগীদের প্রতি মাসে রক্ত জোগাড় করতে খরচ পড়ে যায় ১০ থেকে ৩০ হাজার টাকা। অনেক স্বল্প আয়ের মানুষের পক্ষে এ খরচ বহন করা সম্ভব হয় না। তাদের বিনা মূল্যে বা ন্যূনতম প্রসেসিং খরচে বছরের পর বছর ধরে রক্ত সরবরাহ করে যাচ্ছে কোয়ান্টাম বøাড ল্যাব। এই পর্যন্ত তিন লাখ ১৪ হাজার ইউনিট রক্ত থ্যালাসেমিয়া রোগীদের সরবরাহ করেছে কোয়ান্টাম। শুধু তা-ই নয়, হাজার হাজার ব্যাগ রক্ত থ্যালাসেমিয়া রোগীদের বিনা মূল্যে দেয়া হয়েছে। জরুরি রক্তের প্রয়োজনে কোয়ান্টাম ল্যাবে যোগাযোগ করা যাবে।

চিকিৎসক