Print Date & Time : 19 June 2025 Thursday 5:50 pm

বাড়িভাড়া বৃদ্ধির হার যৌক্তিক পর্যায়ে আনতে হবে

মো. আতিকুর রহমান : দেশে বাড়িভাড়া-সংক্রান্ত একটি আইন রয়েছে। কিন্তু এ আইনের প্রচার না থাকায় অধিকাংশ মানুষ এ ব্যাপারে অজ্ঞ। এর ফলে ঢাকাসহ অন্যান্য শহরে বাড়ির মালিকদের দৌরাত্ম্য সহ্য করে ভাড়াটিয়ারা বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছে। কোনো কারণ ছাড়াই বছর বছর ভাড়া বৃদ্ধি করা যেন রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। অনেক ভাড়াবাড়িতে প্রয়োজনীয় পানি ও গ্যাস পাওয়া যায় না। কিন্তু তাতে কী! ভাড়া বাড়ানোর ক্ষেত্রে তাদের কোনো ধরনের শিথিলতা নেই।

মূলত বাড়িভাড়া আইনের প্রয়োগ, এ আইন বাস্তবায়নে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা এবং সঠিক নির্দেশনার অভাবে বাড়িমালিকরা দিন দিন আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে। অধিকাংশ মানুষ জানে না, কোথায় গেলে এ বিষয়ে সঠিক প্রতিকার পাওয়া যাবে। ফলে দেশে আইন থাকতা সত্ত্বেও বাড়িওয়ালাদের অনৈতিক ভাড়া বৃদ্ধির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাচ্ছে না।

শহরের প্রতিটি ওয়ার্ড বা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিকে বাড়িভাড়া আইন তার এলাকার বাড়িমালিক মেনে চলছে কি না, তা তদারকির দায়িত্ব নিতে হবে। যৌক্তিক মাত্রায় বাড়িভাড়া নির্ধারণের পাশপাশি আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকা রাখতে হবে, যা অধিক জরুরি। কেননা দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে রাজধানীতে নীরবে বাড়ছে এই বাসাভাড়া, যা নিতান্তই দুঃখজনক। বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে বেড়েছে ব্যয়, বাড়েনি মানুষের আয়। ঠিক এ সময়ে বাসাভাড়া বাড়াচ্ছেন বাড়ির মালিক, যা সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। আর এই ভাড়া বৃদ্ধি যেন ভাড়াটিয়াদের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়াবে।

শুধু তা-ই নয়, দেশে পাগলা ঘোড়ার পিঠে চেপে ক্রমেই বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম। পাশাপাশি বেড়েছে সংসারের খরচও, ভাঙতে হচ্ছে সঞ্চয়ও। সবমিলিয়ে চরম হিমশিম খাচ্ছে নগরীর মধ্যবিত্ত ও নি¤œ আয়ের মানুষ। ফলে কেউ ঝুঁকছেন সাবলেটে, কেউ যাচ্ছেন এক রুমের আধাপাকা বা টিনশেডের বাড়িতে। আবার কেউ যাচ্ছেন শহর ছেড়ে গ্রামে, কিংবা ঢাকার আশপাশের নি¤œ ভাড়ার বাড়িগুলোয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খরচের সঙ্গে সমন্বয় করতেই ভাড়াটিয়াদের কেউ ফ্ল্যাট শেয়ারে ঝুঁকছেন, কেউ পরিবার গ্রামে পাঠাতে বাধ্য হচ্ছেন। দ্রব্যমূল্যের দামে অস্বাভাবিকতার কারণে খরচা বেড়ে যাওয়ায় এমনটা হচ্ছে নগরবাসীর। তাই এটি নিয়ন্ত্রণে সরকারকে ভর্তুকি দিতে হবে। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি কমাতে সরকারকে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে।

যদিও অনেকেই বলছেন, নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে বাসাভাড়া কোথাও বাড়ানো হচ্ছে। আবার কোথাও জানুয়ারিতে বাড়ানো হবে বলে বাড়িমালিকরা নোটিস দিচ্ছেন। কভিডের ঘাটতি পোষাতে এবং বর্তমান পরিস্থিতির কারণে ভাড়া বাড়াচ্ছেন বলে জানান কয়েকজন বাড়িমালিক। এতে ঢাকায় এখন বাড়িভাড়ার (টু-লেটে) সাইনবোর্ডের ছড়াছড়ি। শহরজুড়ে সাবলেটের বিজ্ঞপ্তি চোখে পড়ছে বেশি। এদিকে আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে না পেরে কেউ পরিবার গ্রামে পাঠিয়ে মেসে উঠছেন। কেউ শহরের প্রান্তিক এলাকায় বাসা খুঁজছেন। তবে বেশিরভাগেরই পছন্দ সাবলেট বাসা। বাসাভাড়া বৃদ্ধির কারণেই এমন চিন্তা করছেন নগরবাসী।

প্রকাশিত তথ্যমতে, ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) এক পরিসংখ্যান বলছে, গত ২৫ বছরে রাজধানীতে বাড়িভাড়া বেড়েছে ৪০০ শতাংশ। একই সময়ে নিত্যপণ্যের যে দাম বেড়েছে, সেই তুলনায় বাড়িভাড়া বৃদ্ধির হার দ্বিগুণ। সংগঠনটির অন্য এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ঢাকার ২৭ শতাংশ ভাড়াটিয়া আয়ের প্রায় ৩০ শতাংশ, ৫৭ শতাংশ ভাড়াটিয়ার প্রায় ৫০ শতাংশ ও ১২ শতাংশ ভাড়াটিয়া আয়ের প্রায় ৭৫ শতাংশ টাকা ব্যয় করেন বাসাভাড়া পরিশোধে। জ্বালানি তেলের দামও বাড়ানো হয়েছে। ডিজেল-কেরোসিনের দাম লিটারে ৩৪ টাকা বাড়িয়ে ১১৪ টাকা, পেট্রোল ৪৪ টাকা বাড়িয়ে ১৩০ টাকা এবং অকটেন ৪৬ টাকা বাড়িয়ে ১৩৫ টাকা করা হয়েছে। ফলে বাড়তি দামের প্রভাব স্বাভাবিকভাবেই পড়ছে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায়। দৃশ্যমান বাস্তবায়ন হলো বাড়িমালিকরা বছর না ঘুরতেই ভাড়া বাড়াচ্ছেন, যা একটা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। এর হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়া জরুরি।

বর্তমানে পানির বিল, গ্যাসবিল ও বিদ্যুৎবিল বেড়ে যাওয়ার জন্য বিপাকে পড়েছে মধ্যবিত্ত ও নি¤œমধ্যবিত্ত পরিবার।  ফলে বিরাট এক চাপ পরছে সংসারের ওপর, এর পাশাপাশি রয়েছে সংসারের খরচ, সন্তানের পড়াশোনা, ওষুধপত্রসহ নানা খরচ। ফলে অনেকেই বাসা ছেড়ে অন্যত্র  চলে যাচ্ছেন।

কভিডকালে বাড়িমালিকরা ভাড়া কিছুটা কমালেও তা আবার বাড়তে শুরু করেছে। পাশাপাশি আগামী বছরের জানুয়ারি মাস থেকে বাসাভাড়া বাড়ানোর নোটিস দিয়েছেন বাড়িওয়ালা। বর্তমানে অনেকেই কম খরচের ফ্ল্যাট খুঁজছেন। যদি না পান তাহলে সাবলেটে বা এক রুমের আধাপাকা বাড়িতে ওঠার পরিকল্পনা করছেন অনেকেই। যেহেতু ব্যয় বেড়েছে, আয়-রোজগার বা বেতন বাড়েনি, তাই টিকে থাকতে হলে তাকে অবশ্যই স্বল্প খরচের বাসস্থানে উঠতে হবে।

রাজধানীতে বসবাস করেন বেশ কয়েকজন ব্যাচেলর জানান, কয়েক মাস আগেই বাসাভাড়া বাড়ানো হয়েছে। তাই তারাও নতুন বাসা খুঁজছেন। আবার কোথাও কোথাও জানুয়ারিতে বাসাভাড়া বাড়ানো হবে, এমন নোটিসও দিয়েছে বাড়িওয়ালা। তা না হলে বাসা ছেড়ে দিতেও বলা হচ্ছে।

ভাড়াটিয়াদের ভাষ্য, নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে বাসাভাড়া কোথাও বাড়ানো হচ্ছে। আবার কোথাও জানুয়ারিতে বাড়ানো হবে বলে বাড়িওয়ালারা নোটিস দিয়েছে। আর প্রতিদিনই তো কোনো না কোনো পণ্যের দাম বাড়ছে। কমতির দিকে তো কোনোটিই নেই। তাই তাদের সাবলেট পছন্দ। না হলে এত ব্যয়বহুল এই শহরে টিকে থাকা নিয়ে তাদের সংশয় দেখা দিয়েছে।

তারা আরও বলেন, বাসা পরিবর্তন করতে চাইলেই করা যায় না, কারণ বাসা পরিবর্তনে আরও ছয়-সাত হাজার টাকা খরচ হয়ে যায়। পাশাপাশি নতুন বাসায় উঠতে হলে অগ্রিম এক মাসের ভাড়াও দিতে হয়। সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে সাবলেটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন অনেকেই। যদি সাবলেট না মেলে, তাহলে শহরের প্রান্তিক এলাকায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত রয়েছে তাদের।

বর্তমান বাজার পরিস্থিতির কারণে ভাড়া বাড়াচ্ছেন তারা। তবে বেশিরভাগ বাড়িওয়ালা সঠিকভাবে এর সদুত্তর দিতে পারছেন না। পাশাপাশি নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় অনেকে বাসা ছাড়ছেন। তাই প্রত্যেক মাসে দু-একটি ফ্ল্যাট খালি থাকছেই। আবার দুই পরিবার মিলে বাসা নিচ্ছেন অনেকে। সাবলেট দিলে ভাড়াটিয়া পাওয়া যাচ্ছে সহজেই। তা না হলে প্রত্যেক মাসে ফ্ল্যাট খালি থাকছেই। তাই সাবলেট দিতে ও নিতে আগ্রহী ভাড়াটিয়া ও বাড়িওয়ালারা।

যদিও দ্রর্বমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে শুধু শহর নয়, গ্রামগঞ্জের মানুষও খরচ মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন। এর মধ্যে নগরের বাসিন্দারা তো আরও বিপাকে। তাই তারা খরচের সঙ্গে সমন্বয় করতেই বাসাভাড়াও কমাতেও চাচ্ছেন। তাই কেউ কেউ কারও সঙ্গে ফ্ল্যাট শেয়ার করছেন, কেউ কেউ কম দামি ফ্ল্যাটে উঠছেন। আবার অনেকে পরিবার গ্রামে পাঠাচ্ছেন। তাই দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারকে ভর্তুকি দিতে হবে। পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি কমাতে সরকারকে ভূমিকা রাখতে হবে। যদি এমনটা না করা হয় তাহলে এর সংখ্যা বাড়তেই থাকবে।

ভাড়াটিয়া পরিষদের সংশ্লিষ্টদের ভাষ্যমতে, বাড়িওয়ালারা সৃজনশীল পদ্ধতিতে বাসাভাড়া বাড়াচ্ছেন। যেমন জানুয়ারিতে একবার বাড়াবে, আবার ছয় মাস গেলেই বাসাভাড়া বাড়াবে। তারা ভাড়াটিয়াদের মানুষই মনে করে না। মন চাইলেই তারা ভাড়া বাড়িয়ে দেয়। এতে করে কেউ ফ্ল্যাট শেয়ার করে থাকছেন। এমনকি অনেকেই গ্রামে পরিবার পাঠাতে বাধ্য হচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে ভাড়া নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্টদের উদ্যোগ গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়ন করা অধিক জরুরি।

মুক্ত লেখক