নিজস্ব প্রতিবেদক: ডলার সংকটের মধ্যেও দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বিদেশি হিসাবে (নস্ট্রো অ্যাকাউন্ট) ডলার স্থিতি কমেছে। গত সেপ্টেম্বরে ডলারের স্থিতি ছিল ৬ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলার, যা অক্টোবরে কমে দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৯২ বিলিয়ন ডলারে। সে হিসাবে এক মাসের ব্যবধানে ব্যাংকের নস্ট্রো অ্যাকাউন্টে ডলার স্থিতি কমেছে ৪ দশমিক ০৫ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রেমিট্যান্স আয় কমে গেলে এবং আমদানি অর্থপ্রদান বাড়লে সাধারণত ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার ভারসাম্য কমে যায়।
জানা যায়, ডলারের দর বেঁধে রাখার কারণে প্রবাসী আয় কমছে। এছাড়া ডলারের দর নিয়ে বারবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কারণেও রেমিট্যান্সের ওপর প্রভাব পড়েছে। বৈধ পথের চেয়ে অবৈধ পথে দর বেশি হওয়ায় বেশিরভাগ প্রবাসী আয় হুন্ডিতে চলে যাচ্ছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে প্রবাসী আয়ের ধারা নিম্নমুখী ছিল।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত জুনে প্রবাসী আয়ের পরিমাণ ছিল ২ দশমিক ২০ বিলিয়ন। জুলাইয়ে তা কমে এসেছে ১ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন, আগস্টে ১ দশমিক ৬০ বিলিয়ন, সেপ্টেম্বরে আরও কমে ১ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলারে, যা ছিল ৪১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। যদিও পরের মাস অক্টোবরে বেড়ে হয় ১ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলার। মূলত প্রবাসীদের এখন প্রতি ডলারে সরকারের আড়াই শতাংশ প্রণোদনার পাশাপাশি ব্যাংকগুলোও সমপরিমাণ প্রণোদনা দিচ্ছে। ফলে প্রবাসীরা বৈধ পথে পাঠানো প্রতি ডলারের জন্য ১১৫ টাকার মতো পাচ্ছেন। কোনো কোনো ব্যাংক অবশ্য আরও বেশি দাম দেয়। এর ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে প্রবাসী আয়ে। আবার গত মাসের শুরুতে ব্যাংকগুলো ইচ্ছামতো প্রণোদনা দিয়ে ১২৪ টাকায় প্রবাসী আয় কিনেছিল। এতে শুরুতে রেমিট্যান্স বেড়েছিল। তবে মাঝখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের কড়াকড়িতে আবার কমে গেছে। এখন আবার ব্যাংকগুলো ১২৩ টাকায় কেনায় শেষ দিকে কিছুটা বেড়েছে।
তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে দেশের ব্যাংকগুলোর বিদেশি হিসাবে থাকা ডলারের ধারণ স্থিতি ছিল ছয় বিলিয়নের বেশি। এর পর থেকে দেশে ডলারের সংকট বাড়তে থাকে। ফলে ব্যাংকগুলোর নস্ট্রো হিসাবে ডলারের পরিমাণও টানা কমে যায়। গত অর্থবছরের অক্টোবরে ব্যাংকগুলোর এ রিজার্ভের পরিমাণ ৪ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলারে নেমে যায়। এরপর ধীরে ধীরে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বিদেশি হিসাবে ডলারের স্থিতি বেড়ে ৬ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলারে উঠে যায়। এক মাস পর আবার তা কমে ৫ দশমিক ৯২ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়।
বেসরকারি ব্যাংকের একজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে বৈদেশিক মুদ্রা কমে যাওয়ার পেছনে রেমিট্যান্স আয়ের তীব্র পতনই দায়ী ছিল। আরেকটি কারণ হলÑঋণপত্র নিষ্পত্তিতে বিলম্বিত অর্থপ্রদান বাড়ছে। তাই ডলার ধারণ কমছে।
এদিকে ডলারের পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হয়েছে বলে দাবি বাংলাদেশ ব্যাংক ও ডলারের দর নির্ধারণ করে দেয়া দুই সংগঠন বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) ও অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি)। তাই ধীরে ধীরে দুই সংগঠন ডলারের দর কমাচ্ছে। গত ২২ নভেম্বর প্রথমবারের মতো ডলারের দাম ৫০ পয়সা কমানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সেদিন বাফেদা ও এবিবির পক্ষ থেকে বলা হয়, আমদানি কমেছে এবং রপ্তানি বাড়ছে। এছাড়া চলতি হিসাবে এখন ঘাটতি নেই। এজন্য ডলারের দাম ৫০ পয়সা করে কমানো হবে।
পরদিন ২৩ নভেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে বাফেদা ও এবিবি ডলারের দাম ৫০ পয়সা কমানোর যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সেটিকে সঠিক ও সময়োপযোগী বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, চাহিদা ও জোগানোর ওপর নির্ভর করে ডলারের দাম নির্ধারিত হয়। ডলার খরচ হয় সেবা ও পণ্য ক্রয় এবং ঋণ ও বিদেশি দায় মেটাতে। এখন আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে তদারকি বাড়ানো হয়েছে। অন্যদিকে বিদেশি দায় কমে এসেছে। সামনে বিদেশি ঋণ আসবে, এতে রিজার্ভ বাড়বে। এ কারণে ডলারের দাম কমানোর সিদ্ধান্তটি যথাযথ।
এরপর গত মঙ্গলবার সব পর্যায়ে ডলারের দাম আরও ২৫ পয়সা কমানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, যা আজ থেকে কার্যকর হবে। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রবাসী ও রপ্তানি আয় কেনায় ডলারের দাম পড়বে ১০৯ টাকা ৭৫ পয়সা আর আমদানিতে পড়বে ১১০ টাকা ২৫ পয়সা। তবে নির্ধারিত দামে ডলার কেনাবেচা হচ্ছে কম। গত বৃহস্পতিবারও কিছু ব্যাংক ১২৩ টাকায় প্রবাসী আয় কিনেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিছু ব্যাংককে বেশি দামে ডলার কেনার সুযোগ দিচ্ছে। ফলে প্রবাসী আয় বাড়ছে। সদ্য বিদায়ী নভেম্বরে প্রবাসী আয় ১৯০ কোটি ডলার হতে পারে।
অন্যদিকে এসব ব্যাংক থেকে ডলার কিনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ বাড়ানোর চেষ্টা করলেও তা বরং কমছে। গত এক সপ্তাহে রিজার্ভ কমেছে ১২ কোটি ডলার। ফলে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাবপদ্ধতি অনুযায়ী গত বুধবার রিজার্ভ কমে ১ হাজার ৯৪০ কোটি বা ১৯ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে।
ডলারের দাম কমছে, তাহলে সংকট কি কেটে গেলÑএমন প্রশ্নের জবাবে বেসরকারি খাতের একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ‘দাম যেহেতু কমছে, সংকট তো মনে হয় কেটে যাচ্ছে। তবে ১২২-১২৩ টাকার নিচে প্রবাসী আয় পাওয়া যাচ্ছে না। এজন্য আমরা ডলার কিনতে পারছি না। গত মাসের চেয়ে প্রবাসী আয় বেশ কমে গেছে। এর ফলে চাহিদামতো ঋণপত্র খুলতে পারছি না। আমাদের মতো আরও অনেক ব্যাংকের অবস্থা একই রকম।’