রোহান রাজিব: দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে সরকার ব্যাপক হারে ঋণ নিচ্ছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাস ২২ দিনে এসব ব্যাংক থেকে ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬৫ হাজার ৪৩২ কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১২ গুণের বেশি। বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার ফলে তারল্য সংকটে ভুগছে ব্যাংক খাত। নিয়মিত ধার করে চলছে বেশিরভাগ ব্যাংক। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে সরকারের ব্যাংকঋণের এমন চিত্র উঠে এসেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, গত ২২ এপ্রিল শেষে সরকারের ব্যাংকঋণের মোট স্থিতি দাঁড়িয়েছে চার লাখ ৩৯ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকায়, গত ৩০ জুন শেষে যা ছিল তিন লাখ ৯৩ হাজার ৭৭৮ কোটি টাকা। এ হিসাবে অর্থবছরের প্রথম ৯ মাস ২২ দিনে সরকারের নিট ব্যাংকঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৫ হাজার ৫৫৭ কোটি টাকায়। অথচ গত ১ জুলাই থেকে ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের নেয়া ঋণের স্থিতি ঋণাত্মক ধারায় ছিল প্রায় ছয় হাজার ৬৩৪ কোটি টাকা।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ সময়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে নেয়া ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে তিন লাখ এক হাজার ৫৭০ কোটি টাকায়, যা গত ৩০ জুন শেষে ছিল দুই লাখ ৩৬ হাজার ১৩৮ কোটি টাকা। ফলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে সরকারের ঋণ বেড়েছে ৬৫ হাজার ৪৩২ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে এ ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র পাঁচ হাজার ৩৩৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাস ২২ দিনে গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ঋণ বেড়েছে ১২ দশমিক ২৬ গুণ।
অন্যদিকে এ সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নেয়া ব্যাংকঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৩৭ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা, যা গত ৩০ জুন শেষে ছিল এক লাখ ৫৭ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ কমেছে ১৯ হাজার ৮৭৫ কোটি টাকা। আর এই ঋণের পুরোটাই পরিশোধ করা হয়েছে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে গত বছরের আগস্টের পর থেকে টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দেয়া পুরোপুরি বন্ধ রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এছাড়া সঞ্চয়পত্র থেকেও কোনো ঋণ পাচ্ছে না সরকার। এমন পরিস্থিতিতে সরকারের ব্যাংকঋণ এবার বাণিজ্যিক ব্যাংকনির্ভর হয়ে পড়েছে। তবে বেশিরভাগ ব্যাংক তারল্য সংকটে থাকায় সরকারকে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দিতে তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছে না। আবার দিলেও বেশি সুদ দাবি করছে। ফলে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নসহ দৈনন্দিন খরচ মেটাতে শিডিউলের বাইরে গিয়েও স্বল্পমেয়াদি ট্রেজারি বিলের অকশন করতে বাধ্য হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে স্বল্পমেয়াদি ট্রেজারি বিলের সুদের হারও বাড়ছে।
প্রতিবছর বড় অঙ্কের ঘাটতি রেখে বাজেট পেশ করে আসছে সরকার। এই ঘাটতি মেটানো হয় দুটি উৎস থেকেÑঅভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক খাত। বৈদেশিক খাত থেকে প্রয়োজনীয় অর্থ সহায়তা পাওয়া না গেলে অভ্যন্তরীণ উৎসের ওপরই বেশি নির্ভর করতে হয় সরকারকে। অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে রয়েছে ব্যাংক ব্যবস্থা ও সঞ্চয়পত্র। চলতি অর্থবছরে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে এক লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ নেয়া হবে ৮৬ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা। স্বল্পমেয়াদি ঋণ নেয়া হবে ৪৫ হাজার ৮১৫ কোটি টাকা। অর্থবছরের শুরুতেই এসব ঋণ নেয়ার শিডিউল ক্যালেন্ডার ঠিক করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, এবার বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে নেয়া ঋণের ৩৬ হাজার ২৯৯ কোটি টাকাই নেয়া হয়েছে ট্রেজারি বিলের বিপরীতে। সর্বনিম্ন ১৪ দিন থেকে সর্বোচ্চ ৩৬৪ দিন মেয়াদে এই ঋণ নিতে পেরেছে সরকার। বাকি ঋণগুলো দেয়া হয়েছে দীর্ঘমেয়াদি বন্ডের বিপরীতে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাজারে টাকার প্রবাহে লাগাম টানতে সংকোচনমুখী নীতিতে রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আবার ডলার বিক্রির কারণেও বাজার থেকে টাকা উঠে আসছে। এতে ব্যাংক খাতেও নগদ টাকার টানাটানি রয়েছে। এমন বাস্তবতায় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সরকারকে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দিতে তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছে না। এ কারণে শিডিউলের বাইরে গিয়ে এবার স্বল্পমেয়াদি ট্রেজারি বিলেরও অকশন করে সরকারকে ঋণ দেয়া হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বৃহস্পতিবার ৩৩টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ১২ হাজার ৬৫২ কোটি টাকা তারল্য সুবিধা নিয়েছে। তার আগের দিনে এর পরিমাণ ছিল প্রায় ২০ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকা। গত অর্থবছরও ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার রেকর্ড এক লাখ ২২ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরাসরি সরবরাহ করে ৯৭ হাজার ৬৮৪ কোটি টাকা, যা নতুন টাকা ছাপিয়ে দেয়া হয়েছিল। আর বাকিটা নেয়া হয়েছিল বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে।
এদিকে এবার সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে মাত্র ১৮ হাজার কোটি টাকা। জাতীয় সঞ্চয়পত্র অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে কোনো ঋণ পায়নি সরকার। উল্টো এ সময়ে নিট বিক্রির পরিমাণ ঋণাত্মক হয়েছে আট হাজার ৮৯২ কোটি টাকা। অর্থাৎ এই ছয় মাসে যত টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে, তার চেয়ে আট হাজার ৮৯২ কোটি টাকা বেশি ভাঙানো হয়েছে।