নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশের পুঁজিবাজারে ইস্যু ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি অবৈধভাবে প্লেসমেন্ট ব্যবসা, প্লেসমেন্ট শেয়ার নিয়ে কারসাজি ও ইস্যু ম্যানেজারের দায়িত্বে থাকা কোম্পানি এবং যেসব কোম্পানি রাইট শেয়ার ইস্যু করেছে, সেগুলোর শেয়ার নিয়ে কারসাজি করে আসছে বেশ কিছু ইস্যু ম্যানেজার প্রতিষ্ঠান। একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানগুলো কোনো কোম্পানির জন্য ইস্যু ম্যানেজার হচ্ছে। আবার কোনো কোম্পানির জন্য আন্ডাররাইটার হিসেবে কাজ করেছে। সেই কারণেই সম্প্রতি বানকো ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ হামদুল ইসলাম ও তার সঙ্গে শেয়ার কারসাজিতে জড়িত থাকায় ৬ জনকে মোট ২৬ কোটি টাকা জরিমানা করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
হামদুল ইসলামকে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (পাবলিক ইস্যু) রুলস, ২০১৫ এর রুল ৩(২) (ডি) ভঙ্গের দায়ে ১০ কোটি টাকা জরিমানা করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এছাড়া, পুঁজিবাজারের সব ধরনের কার্যক্রম থেকে আগামী ৫ বছর নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
২০১৫ সালের পাবলিক ইস্যু রুলসের ৩(২)(ডি)-তে বলা হয়, ইস্যু ম্যানেজার ইস্যুয়ারের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে পারবে না এবং শেয়ার ধারণ করতে পারবে না, যা ২০১৭ সালের ১৮ জুলাই সংশোধনীতে বলা হয়, ইস্যু ম্যানেজার ও এর সঙ্গে সম্পৃক্ত কোনো ব্যক্তি ইস্যুয়ারের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারবে না এবং শেয়ার ধারণ করতে পারবে না।
ইস্যু ম্যানেজারের সংজ্ঞায় সিকিউরিটিজ ও এক্সচেঞ্জ কমিশন (মার্চেন্ট ব্যাংকার ও পোর্টফোলিও ম্যানেজার) বিধিমলিা ১৯৯৬ এর ২(ঞ) ধারায় বলা হয়েছে, মার্চেন্ট ব্যাংকার অর্থ এমন ব্যক্তি যিনি এ বিধিমালার অধীন করপোরেট উপদেষ্টা, পোর্টফোলিও ম্যানেজার, অবলেখক এবং ইস্যু ব্যবস্থাপক হিসেবে যাবতীয় কাজ করার জন্য নিবন্ধন সনদপ্রাপ্ত হইয়াছেন। আর ব্যক্তি অর্থ কোম্পানি, সংবিধিবদ্ধ সংস্থা।
সে হিসাবে একই আইন অঙ্গ করে ব্যবসা ও কারসাজি করে রীতিমতো ‘আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ’ হচ্ছে বেশ কিছু ইস্যু ম্যানেজার এবং বাজার-সংশ্লিষ্ট অনেকেই। তবুও তাদের ক্ষেত্রে নেই কোনো নজরদারি এবং নেই কোনো জরিমানা। প্রতিনিয়ত প্লেসমেন্ট, রাইট শেয়ার বা আন্ডার রাইটার হয়ে কারসাজির সঙ্গে প্রত্যেক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত থাকলেও, নজদারিতে না এনে এবং শাস্তি না দিয়ে তাদের যেন ছাড় দিচ্ছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
পর্যালোচনায় দেখা যায়, সম্প্রতি প্রত্যক্ষভাবে মালিকানায় সম্পৃক্ত থাকার পরেও ইউনিয়ন ইন্স্যুরেন্সকে পুঁজিবাজারে আনার জন্য ইস্যু ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করেছে সোনার বাংলা ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট। একইভাবে বিডি থাই ফুডের শেয়ার ধারণ করেও সাউথইস্ট ব্যাংক, সাউথইস্ট ব্যাংক ক্যাপিটাল সার্ভিসেস ও আলমগীর কবিরের নিয়ন্ত্রণাধীন বিএলআই ক্যাপিটাল কোম্পানিটির ইস্যু ব্যবস্থাপনার কাজ করেছে। এতে আইনে কোনো সমস্যা হয়নি।
ইউনিয়ন ইন্স্যুরেন্সের খসড়া প্রসপেক্টাস অনুযায়ী, কোম্পানিটি থেকে সোনার বাংলা ইন্স্যুরেন্সে বিনিয়োগ করা হয়েছে। যার সাবসিডিয়ারি কোম্পানি সোনার বাংলা ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট। অর্থাৎ ইউনিয়ন ইন্স্যুরেন্সের মালিকানা সোনার বাংলা ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্টেও রয়েছে। এ বিবেচনায় মালিকানাধীন ইস্যু ম্যানেজারের তত্ত্বাবধানে শেয়ারবাজারে এসেছে ইউনিয়ন ইন্স্যুরেন্স। যে বিষয়ে বিএসইসির কোনো বাধা বা আইনগত সমস্যা হয়নি।
অপরদিকে বিডি থাই ফুড অ্যান্ড বেভারেজও রয়েছে একই সমস্যা। চলতি বছরের ২৪ জানুয়ারি লেনদেন শুরু হওয়া কোম্পানিটিকে শেয়ারবাজারে আনতে ইস্যু ব্যবস্থাপনার কাজ করেছে বিএলআই ক্যাপিটাল লিমিটেড। যার শেয়ার ধারণ করছে বে লিজিং অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট। এতে বে লিজিংয়ের সাবসিডিয়ারি বা অধীন কোম্পানি হচ্ছে বিএলআই ক্যাপিটাল। সেই সঙ্গে বে লিজিং, বিএলআই ক্যাপিটাল ও সাউথইস্ট ব্যাংকের কয়েকজন পরিচালকের মাঝে শেয়ার ধারণের সম্পর্ক রয়েছে। যারা আবার বিডি থাই ফুডেরও শেয়ার ধারণ করেছে। এ বিষয়ের পরও পুঁজিবাজারে এসেছে বিডি থাই ফুড।
বিডি থাই ফুডে আইপিও পূর্ব বা প্লেসমেন্ট শেয়ারহোল্ডার হিসেবে রয়েছেনÑ বিএলআই ক্যাপিটালের পরিচালক হূমায়ন কবির, সাউথইস্ট ব্যাংকের চেয়ারম্যান মো. আলমগীর কবির, সাউথইস্ট ব্যাংক ও সাউথইস্ট ব্যাংক ক্যাপিটাল সার্ভিসেস। এদের সবার শেয়ার ৩ বছর লক-ইন থাকবে। এর মধ্যে বিডি থাই ফুডের ১ লাখ শেয়ার ড. হূমায়ুন কবির, ২০ হাজার শেয়ার আলমগীর কবির, ৬২ লাখ শেয়ার সাউথইস্ট ব্যাংক ও ৩২ লাখ শেয়ার সাউথইস্ট ব্যাংক সার্ভিসেস ধারণ করছে। আর তাদেরই সম্পৃক্ত থাকা বিএলআই ক্যাপিটাল ইস্যু ব্যবস্থাপনার কাজ করেছে বিডি থাই ফুডের।
কিন্তু লাভেলো আইসক্রিম, সি পার্ল, বিবিএস কেবলস ইত্যাদি কোম্পানিতে শেয়ার ধারণ না করেও ১০ কোটি টাকার আর্থিক ও ৫ বছরের নিষেধাজ্ঞার শাস্তি দেয়া হয়েছে বানকো ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হামদুল ইসলামকে। এছাড়া তার আত্মীয়স্বজন বানকো ফাইন্যান্সের মালিকানায় না থাকলেও ওইসব কোম্পানির প্লেসমেন্ট কেনার দায়ে, তাদের ১৬ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়েছে। আইন অনুযায়ী, ইস্যু ম্যানেজার বানকো ফাইন্যান্স। যার সঙ্গে সম্পৃক্ত ওই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও মালিকরা। কিন্তু বিএসইসি বানকো ফাইন্যান্সের ইস্যুয়ার কোম্পানির শেয়ার হামদুল ইসলামের আত্মীয়স্বজন কেনার জন্য জরিমানা করেছে। যার কোনোটি থেকেই হামদুল ইসলাম শেয়ার কেনেননি।
বাজার-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে পুঁজিবাজারে একটি পক্ষের ব্যবসা চলছে। যার সঙ্গে বিএসইসির কর্মকর্তাদেরও সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে বিভিন্ন সময়ে জানা যায়। যে কারণে একই আইন ভঙ্গের কারণে কাউকে সর্বোচ্চ শাস্তি দেয়া হয়, আবার কাউকে ‘নামমাত্র’ জরিমানার মাধ্যমে ছেড়ে দেয়া হয়, যা একাধিকবার ক্ষেত্রে দেখা গেছে, শত কোটি টাকার বেশি কারসাজি করে লাভবান হলেও জরিমানা খুবই কম।
বানকো ফাইন্যান্স ও অন্যদের বিষয়ে তারা বলেন, বাজার ও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে আইন ও শাস্তি সবার জন্য এক হওয়া প্রয়োজন, যেটা হচ্ছে না। বিএসইসি সবার সঙ্গে সমান আচরণ করছে না বলে তারা জানিয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. রেজাউল করিম শেয়ার বিজকে বলেন, জরিমানার বিষয়ে বিস্তারিত আমার জানা নেই। কমিশন জরিমানা করলেও সেটা আদেশ জারি না হওয়া পর্যন্ত শুধু সংশ্লিষ্ট বিভাগ সে বিষয়ে জানে। তাই কোন আইন ভঙ্গের কারণে এবং বিস্তারিত বিষয়টি না জানা পর্যন্ত কিছু বলা সম্ভব হচ্ছে না। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তা বা যে কমিশনার দায়িত্বে আছেন তারা বলতে পারবেন বলে তিনি জানান।
পরে এনফোর্সমেন্ট বিভাগের দায়িত্ব থাকা কমিশনার আব্দুল আলিমের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য ফোন করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি এবং হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ দেয়া হলে তিনি দেখলেও কোনো উত্তর দেননি।