Print Date & Time : 19 June 2025 Thursday 11:49 am

বানান ভুলে লক্ষাধিক শিক্ষার্থীর এইচএসসি সনদ স্থগিত

মীর কামরুজ্জামান মনি, যশোর: বানান ভুলের কারণে যশোর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের ২০২১ সালের প্রায় ১ লাখ ২৬ হাজার এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের সনদ প্রদান স্থগিত করা হয়েছে। এ কারণে সার্টিফিকেট পুনর্মুদ্রণের কারণে বোর্ডের অতিরিক্ত ১ কোটি টাকারও বেশি খরচ হবে বলে জানা গেছে। এ ঘটনায় দায়ীদের শনাক্তে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে শিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষ। তবে শিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষ বলছে, ক্ষতির পরিমাণ ৮ থেকে ১০ লাখ টাকার মতো হতে পারে।

জানা গেছে, সনদ মুদ্রণের কাগজ কেনা হয় অস্ট্রেলিয়া থেকে। কোটেশনের মাধ্যমে কাগজ কেনার পর সরকার নিয়ন্ত্রিত সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেস থেকে শিক্ষা বোর্ডের নাম, মনোগ্রামসহ পরীক্ষার নাম ও সাল লেখা হেডলাইন ছাপা হয়ে বোর্ডে আসে। এর নিচের অংশ ছাপা হয় শিক্ষা বোর্ডের কম্পিউটার বিভাগ থেকে। সেখানে শিক্ষার্থীর নাম, পিতা-মাতার নাম, কেন্দ্রের নাম-নম্বর, স্কুল-কলেজের নাম, প্রাপ্ত জিপিএসহ পরীক্ষার নাম এবং ফলপ্রকাশের তারিখসহ অন্যান্য বিষয় উল্লেখ করা হয়।

নিচের অংশ ছাপার জন্য চূড়ান্ত প্রস্তুতির পর একটি নমুনা সনদ প্রস্তুত করা হয়। এরপর পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ বিভাগসহ দায়িত্বপ্রাপ্তরা নমুনা প্রিন্ট করে তার ভুলভ্রান্তি পর্যবেক্ষণ করে থাকেন। এরপর চূড়ান্ত হলে তারপর সনদগুলো প্রিন্ট করা হয়। ২০২১ সালের এইচএসসি পরীক্ষার ক্ষেত্রে এসব পদ্ধতি অনুসরণ করাও হয়। এরপরও রোল নম্বরের পর যেখানে পরীক্ষার নাম লেখা হয়েছে, সেখানে ‘হায়ার’ শব্দটি ভুল বানানে লেখা থাকা অবস্থায় প্রিন্ট হয়ে যায়। এটি আর কারও চোখে না পড়ায় সনদ প্রিন্ট হওয়ার পর বোর্ডে আরও কয়েকটি পর্যায় অনুসরণ করে তা পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের স্বাক্ষর পায়। এসব পর্বের মধ্যে ‘কমপেয়ার্ড’কারীর স্বাক্ষর, চেককারীর স্বাক্ষর। এ সময় মূল ফলাফলের সঙ্গে মিলিয়ে নিয়ে তারা স্বাক্ষর দেন; একই সঙ্গে প্রতিটি সার্টিফিকেটের জন্য ফাইল নোট রাখা। প্রতিটি হাতের ছোঁয়ার সঙ্গে এর জন্য বোর্ড থেকে একটি নির্দিষ্ট হারে সম্মানীও রয়েছে এসব কাজে। এক কথায় একটি সার্টিফিকেট বহু হাত ঘুরে পরীক্ষা পর্যবেক্ষণ শেষে সনদ গ্রহণকারীর কাছে যায়। ১৯৬৩ সালে বোর্ড চালু হওয়ার পর থেকে এ পদ্ধতি অনুসৃত হয়ে আসছে।

২০২১ সালের এইচএসসির ক্ষেত্রেও একই পদ্ধতি অনুুসরণ করা হচ্ছিল, কিন্তু সাধারণ কর্মচারীদের হাতে চেক-কম্পেয়ার্ড হওয়ার কোনো এক সময় ভুলটি নজরে আসে। তবে কার বা কীভাবে নজরে আসে, এ বিষয়টি কেউ জানতে চাননি। সবাই বলছেন ‘ভুল’ হয়েছে। যাই হোক এখন সব সার্টিফিকেট পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের দপ্তরে তার স্বাক্ষরের অপেক্ষায় রয়েছে।

বোর্ডের কর্মকর্তারা জানান, ইতোমধ্যে ভুলটি নজরে আসে এবং শুরু হয় আলোচনা। একপর্যায়ে শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকসহ উচ্চ পর্যায়ে আলোচনা হয়। সেখানে খতিয়ে দেখা হয় কীভাবে এর থেকে উত্তরণ হয়। এটি প্রস্তাব ছিল ভুল বানানে হায়ার লেখা স্থান ব্লক করে সঠিক বানান লিখে সেটি সরবরাহ করা হয়। সেভাবে ব্লক করে প্রায় সব সার্টিফিকেট প্রস্তুত হয়েছে।

নাম প্রকাশ না শর্তে একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী জানান, সেখানে কলঙ্কিত বা কালিযুক্ত সার্টিফিকেট না দেয়ার পক্ষে বেশিরভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারী অবস্থান নেন। এমনকি অনেকেই স্বাক্ষর না করার পক্ষে অবস্থান নেয়ার চেষ্টা করেন বলে সূত্র জানায়। ফলে সার্টিফিকেট প্রস্তুতের বিভিন্ন পর্যায় পার হওয়ার পরও এখনও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের স্বাক্ষর হয়নি। পরে বোর্ড কর্তৃপক্ষ সনদ প্রদান স্থগিত করেছে।

এ বিষয়ে যশোর শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক মধাব চন্দ্র রুদ্র সার্টিফিকেটের ভুল বানানের কথা স্বীকার করে জানান, যে কোনোভাবে ভুল রয়ে গেছে। এ সার্টিফিকেট প্রদান স্থগিত করা হয়েছে। তিনি বলেন, ২০২১ সালে পাস করা ১ লাখ ২৫ হাজার ৭৪১ জন শিক্ষার্থীর জন্য এ সার্টিফিকেট তৈরি করা হচ্ছিল।

জানা গেছে, প্রতিটি সার্টিফিকেটের জন্য শিক্ষা বোর্ডের ৮৯ টাকা করে খরচ হয়। সে হিসাবে ১ কোটি ১১ লাখ ৯০ হাজার ৯৪৫ টাকা গচ্চা যাবে শিক্ষা বোর্ডের।

এ ব্যাপারে যশোর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. আহসান হাবীব ‘হায়ার’ বানান ভুল হয়েছে বা সার্টিফিকেটে সমস্যা হয়েছে জানিয়ে বলেন, আপাতত সার্টিফিকেট প্রদান স্থগিত করা হয়েছে। ক্ষতির পরিমাণ হয়তো ৮ থেকে ১০ লাখের মতো হতে পারে। এ ঘটনায় দায়ীদের শনাক্তে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ভুল যে বা যাদের কারণে হয়েছে প্রত্যেককে এর দায় বহন করতে হবে, বোর্ড কোনো আর্থিক ক্ষতির শিকার হবে না। তিনি জানান, শিক্ষার্থীদের ফ্রেশ সার্টিফিকেট দেয়া হবে। সার্টিফিকেট পেতে তাদের কিছুটা দেরি হলেও তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।