পাহাড়, চূড়া কিংবা দুর্গম ঝরনা অনেক পর্যটকের কাছে বেশ প্রিয়। এসব স্থানে বেড়াতে যাওয়াটাও পছন্দের, ভীষণ আনন্দের। এর চেয়েও তৃপ্তিকর হচ্ছে, কোনো পাহাড়ি পাড়ায় রাতযাপন। সেখানে যদি
পাহাড়ি পরিবারের সঙ্গে তাদেরই ঘরের এক কোণে অজানা ভাষায় কিচির-মিচির শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়া যায়, তাহলে সে অনুভূতিটা কেমন হবে! অনেকের কাছে মনে হবে স্বর্গীয়।এমন একটি স্থান বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তঘেঁষা চৈক্ষ্যংপাড়া।
বান্দরবানের আলীকদম উপজেলার একটি ইউনিয়ন চৈক্ষ্যংপাড়া। এখান থেকে মিয়ানমার সীমান্তে হেঁটে যেতে প্রায় ২৫ মিনিট লাগে। মিয়ানমারের নিকটবর্তী জনবসতি পিখিয়ংপাড়ার অবস্থান চৈক্ষ্যংপাড়ার কাছে। তাই দৈনন্দিন জীবনযাপন থেকে শুরু করে বিয়ে-শাদির মতো সামাজিক ব্যাপারেও এ পাড়ার লোকেরা সীমান্তের ওপারের পাড়ার প্রতি অনেকাংশে নির্ভরশীল। তাদের নিত্যযোগাযোগ হয়।
চৈক্ষ্যংপাড়া মূলত উচ্চতম পাহাড় সাকা হাফাংয়ের জন্য খ্যাত। পাহাড়ের সঙ্গে মেঘের ভেলার খেলার অপূর্ব দৃশ্য দেখতে এখানে আসেন অনেক পর্যটক।
এ পাড়ার কিছু পথ বেশ প্রশস্ত। আর বাকিগুলো প্রায় সরু। এখানকার উঁচু উঁচু সব গাছ জঙ্গলে ঢাকা। বেশিরভাগ গাছ শতবর্ষী। গাছগুলো উঁচু হলে কী হবে, এর ফঁকা দিয়ে সূর্য ঠিকই তার উপস্থিতি জানান দেয়। এখানে সবচেয়ে ভালো লাগার কাজ করে জানা-অজানা পাখির কিচিরমিচির। আশেপাশের পাহাড়গুলো দেখলে মনে হয় যেন সবুজ কার্পেটে মুড়িয়ে দিয়েছে কেউ। এখানের থিংদলতেপাড়ার অধিবাসীরাও বাস করেন। এ পাড়ায় রয়েছে সবুজে ছাওয়া বিশাল একটি মাঠ। এ মাঠে গবাদিপশু অবাধ বিচরণ করে। বলা যায়, গোয়াল মাঠ। অন্যপাশে পাড়ার শিশু-কিশোরদের খেলার জায়গা রয়েছে।
চৈক্ষ্যংপাড়ার ঘরগুলো কাঠের তৈরি। কাঠের দোতলা ঘরই বেশি চোখে পড়ে। তবে বেশিরভাগ বাঁশ ও ছাউনি দিয়ে তৈরি। দেখতে বেশ। অধিবাসীরা মিলেমিশে বাস করেন। তারা অতিথি আপ্যায়নে বেশ আন্তরিক। ঘরের ভেতরে বেশ পরিপাটি।
চৈক্ষ্যংপাড়ায় ঘুরতে এলে এদের সঙ্গেই থাকতে হবে। এখানকার লোকজন শিকারে পটু। শিকার করা রামছাগলের মাংস দিয়ে তাদের ভোজনটা বেশ জমে ওঠে। শিকারের সময় তারা সীমান্তও অতিক্রম করে। অর্থাৎ, মিয়ানমারের জঙ্গল থেকে মাঝেমধ্যে বানর শিকার করে।
এখান থেকে দেখা যায় বাংলাদেশের উচ্চতম পাহাড় সাকা হাফংয়ের চূড়া। চারপাশের ভাসমান তুলার মতো মেঘ থেকে মাথা উঁচিয়ে সদর্পে তার উপস্থিতি জানান দেয়। অবশ্য মেঘ আড়াল করে রাখে তার কিছুটা। এ দৃশ্য অপূর্ব দৃষ্টিতে শুধু দেখতেই ইচ্ছে করবে।
চৈক্ষ্যংপাড়ায় জুম নামে এক ধরনের উৎসব ঘটা করে পালন করা হয়। তাও আবার ঘরে ঘরে এ উৎসবের আয়োজন করা হয়। উৎসব উপলক্ষে বিশেষ প্রার্থনার নিয়ম রয়েছে এখানে। শেষ বিকালে পাড়ার ছেলেরা ফুটবল খেলায় মেতে ওঠে। এ খেলাটাই বেশি জনপ্রিয় এখানে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতেই মাঠের এক পাশ থেকে সাকা হাফংয়ের ওপর মেঘের ভেসে বেড়ানো দেখা যায়। বাঁশের বেঞ্চে বসে অনেকে তা উপভোগ করেন। এ সময় শেষ মুহূর্তের সূর্যের সোনালি আভা সাদা মেঘগুলোর ওপরে পড়েÑতখন ভ্রম জাগে যেন মেঘে রং ধরেছে। ক্ষণে ক্ষণে রং পাল্টাচ্ছে ভাসমান সাদা মেঘের ভেলা। সন্ধ্যায় পাড়ার মেয়েরা কেউ বাইরে থাকে না। অন্ধকার হলেই তারা রাতের খাবার সেরে ফেলে। সাধারণত শিকার করা কোনো পশু বা পাখি দিয়ে রাতের ভুরিভোজের আয়োজন করা হয়।
এখানে বিদ্যুৎ সুবিধা পৌঁছায়নি। তাই টেলিভিশন দেখারও কোনো সুযোগ নেই। তবে দু-একজনের কাছে পোর্টেবল ডিভিডি প্লেয়ার রয়েছে। রাতের ভোজন শেষে পাড়ার প্রায় সবাই তাদের কাছে ভিড় জমায়। ঘরের এক কোণে সবাই জড়ো হয়ে পোর্টেবল ডিভিডি প্লেয়ারে মিউজিক ভিডিও শোনে। শুনতে শুনতে পাড়ার ছেলে-বুড়োর অনেকে গুটিসুটি মেরে এককোণে ঘুমিয়ে যান। আবার অনেকে চোখ বড় বড় করে নিবিষ্ট মনে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকেন।