জুবায়ের আহমেদ: বাংলাদেশের মানুষের আদি পেশা কৃষি। সময়ের বিবর্তনে সরকারি-বেসরকারি চাকরির পাশাপাশি ব্যবসায়ীর সংখ্যা বাড়লেও কৃষিকাজ এবং দৈনন্দিনভিত্তিতে আয় রোজগারকারী নাগরিকের সংখ্যাই বাংলাদেশে বেশি। সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীরা নিজেদের চাকরিজীবী এবং একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী নিজেকে ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচয় দিলেও রিকশাচালক, সিএনজিচালক, নির্মাণ শ্রমিক ও দৈনন্দিন ভিত্তিতে কাজ করা বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত থাকা নাগরিকদের অনেকেই নিজেদের পেশাগত পরিচয় দিতে লজ্জাবোধ করে। তাদের সন্তানরা আরও বেশি সংকোচবোধ করে বাবার পেশার কথা বলতে গিয়ে। বৈধ কোনো পেশাই ছোট না হলেও শ্রেণি-বৈষম্যের প্রকটতার কারণে রিকশা-ভ্যানচালক, সিএনজিচালক কিংবা দৈনন্দিনভিত্তিতে নিয়োজিত থাকা সব পেশাজীবী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের সমাজে নিচু শ্রেণির মানুষ হিসেবে বিবেচিত হতে হয়।
সময়ের বিবর্তনে দেশে শিক্ষিত জনসংখ্যা বাড়ছে। শিক্ষিত নাগরিকরা সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে নিয়োজিত হচ্ছে কিংবা কেউ কেউ ব্যবসা করছে। যারা লেখাপড়া করেনি কিংবা স্বল্প শিক্ষিত, তাদের মধ্যে অধিকাংশই কথিতমতে ছোট পেশায় নিয়োজিত হচ্ছে। শ্রেণি বিভাজন করা ঠিক না হলেও শিক্ষার হার বাড়ার পাশাপাশি শিক্ষানুসারে নাগরিকরা বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত হওয়ার ফলে শ্রেণি বিভাজনের হারও বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। চাকরিজীবীদের মধ্যেও কে কর্মকর্তা, কে কর্মচারী কিংবা কে বড় কর্মকর্তা, কে ছোট কর্মকর্তা, ব্যবসায়ীদের মধ্যে কে বড় ব্যবসায়ী কিংবা কে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী তা নির্ণয়ের মাধ্যমে পেশাগত বিভাজনের পাশাপাশি মানুষের মাঝেও বিভাজন করা হচ্ছে। চাকরিজীবী ও ব্যবসায়ীরা কুলিন শ্রেণির নাগরিক হওয়ার বিপরীতে রিকশাচালক, সিএনজিচালক, বাস-ট্রাক-মাইক্রোবাসের ড্রাইভার, কৃষক ও কুলি-দিনমজুররা দেশের নিন্মশ্রেণির নাগরিক হয়ে গেছে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রকৃত সত্য ও বাস্তবতা হলো ব্যবসা করে অর্থবিত্তের মালিক হওয়া কিংবা উচ্চশিক্ষিত হয়ে বড় চাকরির সুবাদে উঁচু স্থানে ওঠা নাগরিকদের অধিকাংশই কৃষক কিংবা দরিদ্র পরিবার থেকেই উঠে এসেছে, এই চিরন্তন সত্য তারা ভুলে যায়, তাদের সন্তানরাও ভুলে যায়। বড় ব্যবসায়ী, জজ-ব্যারিস্টারের পিতা যেমন সন্তানের জন্য গর্ব, তেমনি ড্রাইভার, কৃষক, দিনমজুর পিতাও সন্তানের গর্ব হওয়া উচিত।
বাবার বড় পেশা ও অর্থবিত্ত নিয়ে যেমন সন্তানরা গর্ব করে, তেমনি একেবারেই দরিদ্র পরিবারের সন্তানরা লেখাপড়া করে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর অনেকেই বাবার পেশা নিয়ে সংকোচে থাকে। বাবার পেশাগত পরিচয় প্রকাশ করতে কুণ্ঠাবোধ করে। তবে অনেকেই সফল হওয়ার পর দরিদ্র বাবার পেশা ও কঠোর পরিশ্রমকে শ্রদ্ধাচিত্তে স্মরণ করে এবং প্রকাশের মাধ্যমে বাবার পরিশ্রমের স্বীকৃতি দেয় এবং বাবার কষ্ট লাগব করে। কেউ কেউ নিজেই কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে লেখাপড়া চালিয়ে নিয়ে সফল হয়ে নিজের পুরোনো পেশা ও পরিশ্রমের কথা প্রকাশ করে। সম্প্রতি সরকারি মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় বরিশালের বানারীপাড়ার রিকশাচালক পিতার কন্যা সাদিয়া আফরিন হারিছা পিতার পেশা নিয়ে নিজের গর্বের কথা প্রকাশ করেছেন এবং ডাক্তার হয়ে পিতার কষ্ট লাগব করার পাশাপাশি মানুষের সেবা করার আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। পিতার কষ্টের দিনগুলোর কথা সাবলীলভাবে বর্ণনা করেছেন। হারিছা লেখাপড়া শেষ করে ডাক্তার হবেন, বাবার কষ্ট লাগব করবেন কিংবা মানুষের সেবা করবেন, তা ভবিষ্যতের বিষয় হলেও মেডিকেলে চান্স পেয়ে রিকশাচালক বাবাকে নিয়ে যেভাবে আবেগঘন মন্তব্য করেছেন এবং বাবার পেশা নিয়ে গর্ব প্রকাশ করেছেন, তা প্রশংসার দাবি রাখে। প্রকৃতপক্ষে এমনটাই হওয়া উচিত সকল সন্তানের ক্ষেত্রে। বাবা-মায়ের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলেই তো সন্তানরা সফলতার সিঁড়ি খোঁজে পায়।
বৈধ কোনো পেশাই ছোট নয়। ধর্মীয়ভাবেও হালাল উপায়ে রোজগার করা প্রত্যেকেই সমান। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব, মানুষ বৈধ যে পেশাতেই নিয়োজিত থাকুক না কেন, মানুষের পরিচয় শুধুই মানুষ। তারপরও আমরা শিক্ষা, পেশাগত এবং অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় শ্রেণিবিভাজন করি। এই শ্রেণিবিভাজন এতটাই প্রকটরূপ ধারণ করেছে যে, পিতার ক্ষুদ্র পেশা নিয়ে আমাদের সংকোচ থাকে। আমাদের চারপাশের পরিবেশও আমাদের মনে করিয়ে দেয়, আমার বাবা রিকশাচালক, সিএনজিচালক কিংবা দিনমজুর। অথচ বাংলাদেশ অবিভক্ত ভারতের অধীনে থাকাকালে, পাকিস্তানের অধীনে থাকাকালে কিংবা স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরও এ দেশের সিংহভাগ নাগরিক দারিদ্র্যের সঙ্গে বসবাস করেছে। আমাদের পূর্বপুরুষরা খুবই দারিদ্র্যের সঙ্গে বসবাস করেছে। সাত পুরুষ ধরেই অর্থবিত্তের মালিক ও শিক্ষিত, এমন পরিবার দেশব্যাপী খুব বেশি নেই। তবুও আমাদের শিক্ষা ও অর্থের অহংকার কমে না বরং বাড়ছেই দিন দিন। বাবার পেশা নিয়ে যখন আমাদের সংকোচে থাকতে হয়, লজ্জা পেতে হয় সেখানে হারিছা কর্তৃক রিকশাচালক পিতাকে নিয়ে গর্বিত হওয়া আমাদের স্বপ্ন দেখায়। সব পরিশ্রমী পিতাদের পরিশ্রম সার্থকতা পায়।
শিক্ষার্থী
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব জার্নালিজম অ্যান্ড ইলেকট্রনিক মিডিয়া (বিজেম), ঢাকা