মো. জিল্লুর রহমান: বিশ্বের অনেক দেশই জুন মাসের তৃতীয় রোববার বাবা দিবস পালন করে আসছে। সে হিসেবে আজ (১৯ জুন) বিশ্ব বাবা দিবস। বিশ্বের অনেক দেশেই বাবা হচ্ছেন পরিবারের প্রধান। পরিবারের প্রধান হিসেবে নানা দায়িত্বের বোঝা থাকে তার কাঁধে। বাবা হওয়ার মতো গুরুদায়িত্বের কারণে তাকেই সইতে হয় বাইরের সব রকম যন্ত্রণা। আবার ঘরের ব্যাপারাগুলোও তাকে ভুলে থাকলে চলে না। ছেলে-মেয়েদের অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থানের নিরাপত্তা দেয়ার পাশাপাশি তাকে সুশিক্ষিত করে গড়ে তোলার বিষয়টিও তার নজরে রাখতে হয়। পরিবারের প্রধান হিসেবে সব ভালো-মন্দের দায়দায়িত্ব তাকেই নিতে হয়। বলা যায়, মা যদি হন মধুবৃক্ষ, তবে বাবা হচ্ছেন পরিবারের প্রধান নির্বাহী বা বটবৃক্ষ। মা যদি হন নদী, তবে বাবা হচ্ছেন নৌকার মাঝি।
বাবার জন্য সন্তানের ভালোবাসা প্রকাশের জন্য বিশেষ কোনো দিনের প্রয়োজন নেই। সীমাবদ্ধ বলয়ে বাবার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসাকে আবদ্ধ করা সম্ভব নয়। বাবার প্রতি সন্তানের ভালোবাসার অবিরাম ধারা বয়ে চলে বছরের প্রতিটি দিন; অবিরাম ও অনন্তকাল। জীবনের ঘানি টানতে টানতে বাবা একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়েন, বয়সের ভারে ন্যুব্জ হন, বার্ধক্য তাকে গ্রাস করে। তখন তিনি হয়ে পড়েন অনেকটা অসহায় ও দুর্বল। রোগ-ব্যাধি তাকে আরও বিপর্যস্ত করে তোলে। এ সময় বাবা চান সন্তান যেন তার পাশে থাকে সব সময়, যেমন তিনি ছিলেন সন্তানের পাশে তার সব প্রয়োজনে, যখন সন্তানের ছিল শিশু অবস্থা। সন্তানের কাছ থেকে অবহেলা কিংবা দুর্ব্যবহার পেলে বাবার হƒদয় ভেঙে চুরমার হয়ে যায়; আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে ওঠে, যখন তার প্রিয় সন্তান তাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠায়।
আল কোরআনে বলা হয়েছেÑযে সম্পদই তোমরা খরচ কর, তার প্রথম হকদার হলেন মা-বাবা। কিন্তু এখন অনেক তথাকথিত সন্তান মা-বাবার জন্যে অর্থ ব্যয়কে অপচয় বলে মনে করে। তারা প্রথমে চিন্তা করে, তার নিজের সন্তানের ভবিষ্যৎ রয়েছেÑতাকে ভালো স্কুলে পড়াতে হবে, দামি পোশাক পরাতে হবে। সব সন্তানের মা-বাবাও একইভাবে তাদের জন্য চিন্তা করেন, কষ্ট করেন। নিজে না খেয়ে সন্তানকে ভালো খাওয়ান। নিজের সব প্রয়োজনকে তুচ্ছ করে সন্তানের প্রয়োজন পূরণ করেন, নিজের সব আরাম-আয়েশ বিসর্জন দিয়ে ছেলেমেয়েদের আরামের চেষ্টা করেন। সন্তানের অসুস্থতায় তারা নির্ঘুম রাত কাটান। তাদের ত্যাগের প্রতিদান দেয়া সম্ভব নয়, অনুভব করা সম্ভব। তাই সব সময় বাবা-মাকে আন্তরিক ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধার সঙ্গে বিশেষভাবে স্মরণ করে রাখার জন্যই মা দিবসের মতো বাবা দিনটিকে পালন করছি। সৃষ্টিকর্তার কাছে দোয়া চলুক প্রতিদিন। রাব্বির হাম-হুমা কামা রাব্বায়ানি সাগিরা, অর্থাৎ ‘হে আমাদের পালনকর্তা! তাদের উভয়ের প্রতি রহম করুন; যেমনিভাবে তারা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন।’ (সুরা বনি ইসরাইল: আয়াত ২৪)। ইসলামের দৃষ্টিতে বাবার চেয়ে মায়ের মর্যাদা তিনগুণ বেশি। কিন্তু তারপরও জীবন গঠনে মায়ের চেয়ে বাবার ভূমিকা কোনো অংশেই কম নয়। মা বহুকষ্টে সন্তানকে পেটে ধারণ করেন, কিন্তু বাবা সমগ্র পরিবারকে ছায়ার মতো আগলে রাখেন।
পরিবার হলো অন্যতম সামাজিক প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানের অন্যতম শিক্ষক হচ্ছেন মা-বাবা। এজন্য বলা হয়ে থাকে, ‘একজন সন্তানের জন্য পারিবারিক সুশিক্ষাটি খুব বেশি জরুরি এবং সেটি অবশ্যই আদর্শ শিক্ষা।’ প্রাতিষ্ঠানিক ও ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষা পরিবার থেকেই দিতে হয়। আর এর সঙ্গে যোগ হবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ডিগ্রি। গুণীজনরা বলেন, পরিবারই হচ্ছে শিশুর প্রথম বিদ্যাপীঠ। মা-বাবার কাছেই শিশুর শিক্ষাদীক্ষা শুরু। মূলত শিশুরা বাবা-মায়ের কাছেই লেখাপড়া, নৈতিকতা, আদর্শ বা দেশপ্রেম সম্পর্কে জানতে শুরু করে। তাই মা-বাবাই হচ্ছেন শিশুর প্রথম আদর্শ শিক্ষক। কিংবা মা-বাবাকেই শিশুরা তাদের প্রথম আদর্শ গুরু হিসেবে মানতে শুরু করে। আর সে কারণে শিশুর বেড়ে ওঠায় মা-বাবার ভূমিকা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বা প্রয়োজন।
একটা শিশুর বেড়ে উঠতে সাধারণত বাবা-মা দুজনের অবদানই গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত বাবারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পরিবারের অর্থনৈতিক চাপটা সামাল দিয়ে থাকেন, ঘর সামলানোর কঠিন কাজে থাকেন মায়েরা। তবে গবেষকরা জানিয়েছেন, যেসব বাবারা তার সন্তানের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত থাকেন, তাদের সন্তানরা বেশি সুখী এবং আত্মবিশ্বাসী বোধ করেন। সন্তানকে আত্মবিশ্বাসী করে গড়ে তুলতে চাইলে বাবাকে নিতে হবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। যদিও আশার কথা এই যে, বর্তমানে অনেক বাবা পরিবারে সন্তান লালনপালনে সরাসরি অবদান রাখছেন। অনেক বাবাই শিশুর খাদ্য থেকে শুরু করে সার্বিক যতœ করে থাকেন। মা-বাবা কর্মজীবী হলে শেয়ার করেই শিশুর যতœ নিতে হয়।
সন্তান যখন ধ্বংসের পথে ধাবিত হয়, তখন বাবা-মাকে এজন্য শক্ত হাতে সংসারের হাল ধরতে হবে। সন্তানের প্রতি বাবা হিসেবে যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে হবে। যার ঔরসে সন্তানের পৃথিবীতে আগমন, সেই বাবা সন্তানের জন্য যেন এক নিবিড় ছায়া, যার কাজ দুঃখ-কষ্ট থেকে দূরে সরিয়ে রেখে সন্তানকে ভালোবাসার আর্দ্রতা উপহার দেয়া। রক্তের বাঁধনে বাঁধা চমৎকার সম্পর্ক বাবা ও সন্তানের। সন্তান ও বাবার সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হচ্ছে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। সন্তানের ভালোবাসায় বাবা ভক্ত, আর সন্তানের সুশিক্ষা ও শ্রদ্ধায় বাবা সিক্ত।
আমরা যদি প্রত্যেকে নিজের জীবনটাকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে চেষ্টা করি, তাহলে বাবা গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হিসেবে চোখের সামনে এবং মনের পর্দায় ছায়া ফেলেন। বাবা যে বাবাই। তার সঙ্গে অন্য কারও তুলনা চলে না। যার কারণে এই পৃথিবীর রং, রূপ ও সৌন্দর্য দেখার সুযোগ লাভ করেছি, সবাই সেই ‘বাবা’ শব্দটির সঙ্গে অপার স্নেহ আর মমতার অদ্ভুত এক মিশেলে আর দৃঢ় বন্ধনে জড়িয়ে থাকি। ছেলে কিংবা মেয়ের জীবনে সবচেয়ে প্রিয় ও সর্বাধিকবার উচ্চারিত শব্দগুলোর মধ্যে ‘বাবা’ই অন্যতম। শিশু পৃথিবীতে আসার পর আধো আধো বোলে যখন কথা বলতে শুরু করে, তখন তার মুখ থেকে ‘বাবা’ ও ‘মা’ শব্দ দুটি প্রথম উচ্চারিত হয়। বাবা যেন সন্তানের কাছে এক মহীরুহ। সন্তানের মুখে ‘বাবা’ ডাক শুনে যে কোনো বাবাই পুলকিত হন। বিয়ের পর স্বামী-স্ত্রী মধুর ভালোবাসা তৈরি হয় ঠিকই, কিন্তু ঘর আলোকিত করে শিশুসন্তান এবং ‘মা’ বা ‘বাবা’ ডাক ওই স্বামী-স্ত্রীর মুখ উজ্জ্বল করে, হƒদয়ে অন্য রকম শিহরন তৈরি করে দাম্পত্য জীবনকে সার্থক প্রমাণ করে।
বাবাকে সন্তানের রোল মডেল হতে হয়। যেমন আপনি যদি রাতের বেলা ব্রাশ করে, ফ্রেশ হয়ে শুতে যান, আপনার সন্তানও তাই করবে। শিশু বাবাকে অনুসরণ করে থাকে। তাই তার বই পড়ার মতো ভালো অভ্যাস গড়তে হলে আপনাকেও বই পড়তে হবে, তার রোল মডেল হতে হবে। তবে বাবা এক কঠিন যোদ্ধার নাম। যে যোদ্ধা শত কষ্টের পরও একাই তার পরিবারকে ঠেলে নিয়ে চলেন। কিন্তু পরিবারের বাকিদের কখনোই বুঝতে দিতে চান না যে তার কষ্ট হচ্ছে। বাবারা একেকটি পরিবারের বটবৃক্ষ, যারা কি না বছরের পর বছর পরিবারের সদস্যদের আগলে রাখেন সব বিপদ-আপদ থেকে। এই বটবৃক্ষের ছায়াতেই তো আমরা বাঁচি।
বাবা পরিবারের বটবৃক্ষ। তপ্ত দায়িত্বগুলো কাঁধে তুলে নিয়ে পরিবারকে সারাজীবন ছায়া দিয়ে যায়। বাবারা রাগ করেন না, তাদের কষ্টগুলো শুধু হাওয়ায় মিশে যায়, অনেকটা আড়ালে-আবডালে। কেউ তার খবর রাখে না, খবর রাখার প্রয়োজন বোধ করে না। কখনও কোনো সন্তান বাবাকে বলতে শুনেছে কিÑ‘আমি ভালো নেই।’ এ প্রশ্নের নেই। আশ্চর্যের বিষয় যে, একজন মানুষ কীভাবে এত সহ্য করেন! বুকে ব্যথা বা শারীরিক অসুস্থতা নিয়েও তার পক্ষে বাজার করতে যাওয়া অসম্ভব কিছু নয়। মা হয়তো শাড়ির আঁচলে মুখ লুকিয়ে দু’ফোঁটা অশ্রু লুকাতে পারেন; কিন্তু বাবা? কোথায় লুকান, কেউ কি জানে? প্রকাশ্যে তার চোখে জল আসাও নিষেধ, তিনি যে বাবা! শার্ট বা পাঞ্জাবির হাতায় কপালের ঘাম মুছতে মুছতেই চলে যায় বাবাদের বেলা। নিজে ছেঁড়া কাপড় পরেও সন্তানের জন্য ভালো কাপড়টি কিনতে কার্পণ্য করেন না। বড় জোর ক্ষণিকের তরে কিছুটা গম্ভীরমুখে বসে থাকতে পারেন। তার তো ভেঙে পড়লে চলবে না। যার কাছে ছায়া নেই, শুধু সেই বোঝে কী নিদারুণ তপ্ত দিবস এই পৃথিবীর, কত রুদ্ধশ্বাস ও দায়িত্বে ভরা এই বন্ধুর পথ। বিচ্ছেদের যন্ত্রণা কত ভয়ংকর সেসব সন্তানেরাই জানে।
বাবারা সবসময় তাদের সন্তানের জন্য নিজেদের জীবনকে উৎসর্গ করে দিতে পছন্দ করেন। যুগে যুগে অনেক বাবা তাদের সন্তানের জীবনকে সুন্দর করার জন্য নিজেদের জীবনকে বিসর্জন দিয়েছেন। তাদের দৈহিক পরিশ্রম এবং মানসিক পরিশ্রম দিয়ে যে অর্থ উপার্জন করেছেন, তা সম্পূর্ণই ব্যয় করেছেন তাদের সন্তানের মঙ্গলের জন্য। বাবাদের কোনো দিবস নেই, বাবাদের জন্য কোনো দিবসের প্রয়োজন নেই। বাবাদের জন্য নিরন্তর ভালোবাসা। ভালো থাকুক সব বাবারা, আড়ালে-আবডালে, এপারে-ওপারে, ইহকাল ও পরকালে সবসময়।
ব্যাংক কর্মকতা ও মুক্ত লেখক
zrbbbp@gmail.com