বারবার নৌ-দুর্ঘটনার কারণ ও প্রতিকার

মো. জিল্লুর রহমান: ছোটবেলায় অনেকেই টাইটানিক নামীয় বিশাল জাহাজের গল্প শুনেছি। বিশেষ করে জেমস ক্যামেরনের ‘টাইটানিক’ সিনেমার পরে এই টাইটানিককে যেন আমরা নতুনভাবে ভিন্নরূপে দেখতে পেয়েছি। সেই ডুবে যাওয়ার দৃশ্য দেখেছে অথচ কাঁদেনি এমন একটি লোকও খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন। প্রায় ১১০ বছর আগে ১৯১২ সালের ১৫ এপ্রিল আটলান্টিক মহাসাগরে টাইটানিক নামের বিশাল জাহাজটি ডুবে যায়। আর এই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান এক হাজার ৫১৭ জন। ইতিহাসে একসঙ্গে এত প্রাণহানি বিরল এক ঘটনা। কিন্তু আসল টাইটানিক জাহাজ কেন ডুবেছিল, সেটা আমাদের অনেকের কাছেই অজানা। ডিজাইনার থমাস অ্যান্ড্রু তখন দাবি করেছিলেন টাইটানিক কোনোদিন ডুববে না। কিন্তু ইতিহাসের কী নির্মম পরিহাসÑনির্মাণত্রুটির কারণে প্রথম যাত্রায়ই এটি ডুবে গিয়েছিল!

সম্প্রতি ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে ইঞ্জিনের ত্রুটি ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় অন্তত ৩৮ যাত্রীর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে এবং ৭২ জন আহত হয়েছেন। যাত্রীদের অনেকেই প্রাণ বাঁচাতে লঞ্চ থেকে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা দ্রুত নৌকা নিয়ে লঞ্চের আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন। প্রাথমিক অনুসন্ধান ও প্রত্যক্ষদর্শী যাত্রীদের বরাত দিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশ, মূলত ত্রুটিপূর্ণ ইঞ্জিন বিস্ফোরণে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত এবং নৌযানে এ ধরনের মর্মান্তিক অগ্নিকাণ্ড নিকট অতীতে বিরল ঘটনা। ত্রুটিপূর্ণ নৌযানই যে দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে, সেটা এ মর্মান্তিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় আবারও প্রমাণিত হয়েছে। গণমাধ্যমের খবরে প্রকাশ, ঢাকা থেকে যাত্রার শুরুতেই এর ইঞ্জিনের ত্রুটি লক্ষ করা গেলেও লঞ্চ কর্তৃপক্ষ বিষয়টিতে মোটেও কর্ণপাত করেনি, বরং অর্থের লোভে দীর্ঘ নৌযাত্রা অব্যাহত রাখে এবং এ কারণেই পথিমধ্যে লঞ্চটি মর্মান্তিক অগ্নিকাণ্ডের শিকার হয়। ফলে অকালে ঝরে যায় কতগুলো নিরীহ-নিরপরাধ মানুষ, থেমে যায় তাদের জীবনপ্রদীপ। ইতিহাসে এটি স্থান করে নেয় আরও একটি নির্মম নৌ-দুর্ঘটনা হিসেবে।

বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় নৌ-দুর্ঘটনাটি ঘটে ২০০৩ সালের ৮ জুলাই ঢাকা থেকে ভোলার লালমোহনগামী এমভি নাসরিন-১ নামের লঞ্চটি চাঁদপুরের মেঘনা ও ডাকাতিয়া নদীর মোহনায়। আইডব্লিউটিএর তথ্যমতে, অতিরিক্ত যাত্রী ও মালবোঝাই করার কারণে লঞ্চটির তলা ফেটে গিয়েছিল। যাত্রীর তথ্য নিয়ে মতভেদ থাকলেও ওই দুর্ঘটনায় সরকারি হিসাবে প্রায় ৬৫০ মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছিল। যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্যমতে, মৃত্যুর হিসাবে এই লঞ্চডুবিকে দেশের সবচেয়ে বড় নৌ-দুর্ঘটনা বলা হয়ে থাকে। নদীমাতৃক দেশ হওয়ায় অন্য যোগাযোগ মাধ্যমের তুলনায় নিরাপদ এবং ব্যয়সাশ্রয়ী হওয়ায় দেশের যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের একটি বড় অংশ এখনও নৌপথেই হয়ে থাকে। যাতায়াতে সবচেয়ে আরামদায়ক ও নিরাপদ মনে করা নৌপথেও এসব দুর্ঘটনা ঘটে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যান্ত্রিক ত্রুটি, মুখোমুখি সংঘর্ষ ও চালকের অসাবধানতাসহ বিভিন্ন কারণে এসব দুর্ঘটনা ঘটে। তাতে প্রাণহানি ঘটে অনেক যাত্রীর।

বেসরকারি সংস্থা কোস্ট বিডির গবেষণা অনুযায়ী, গত ২০ বছরে বাংলাদেশের নৌপথে বড় ১২টি দুর্ঘটনা ঘটেছে, যাতে কমপক্ষে দেড় হাজার মানুষ মারা গেছেন। জানা যায়, ১৯৮৬ সালে অ্যাটলাস স্টার নামে একটি লঞ্চ ডুবে ২০০ যাত্রী মারা গিয়েছিলেন। বিআইডব্লিউটিএ তথ্যমতে, লঞ্চটি ধারণক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন এবং খারাপ আবহাওয়ার কারণে ডুবে গিয়েছিল। এছাড়া ২০০০ সালের ২৯ ডিসেম্বর ঈদুল আজহার রাতে চাঁদপুরের মতলব উপজেলার ষাটনল এলাকায় মেঘনা নদীতে এমভি জলকপোত এবং এমভি রাজহংসী নামের দুটি যাত্রীবাহী লঞ্চের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে রাজহংসী লঞ্চ পানিতে তলিয়ে যায়, সে সময় ওই লঞ্চের ১৬২ যাত্রী নিহত হয়েছিল। অন্যদিকে ২০০২ সালের ৩ মে চাঁদপুরের ষাটনলসংলগ্ন মেঘনা নদীতে ডুবে যায় সালাহউদ্দিন-২ নামের যাত্রীবাহী লঞ্চ। এতে ভোলা ও পটুয়াখালীর প্রায় ৪০০ যাত্রী মারা গিয়েছিলেন। ওই দুর্ঘটনার পর নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের করা একটি তদন্ত কমিটির নকশামতো লঞ্চ নির্মাণ না করায় মালিককে এবং অতিরিক্ত যাত্রী বহনের জন্য মাস্টারকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। এতে ওই লঞ্চের মালিককে জরিমানা এবং মাস্টারকে চাকরিচ্যুত করা হলেও অন্যদের শাস্তি হয়নি। একইভাবে ২০১৪ সালের ৪ আগস্ট ২৫০ জনের বেশি যাত্রী নিয়ে পদ্মা নদীতে ডুবে যায় পিনাক-৬ নামের একটি লঞ্চ। দুর্ঘটনার পর ওই লঞ্চটি তোলা সম্ভব হয়নি এবং এর ধ্বংসাবশেষও কখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। ডুবে যাওয়া লঞ্চ থেকে ৪৯ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছিল, এছাড়া ৫০ যাত্রীর খোঁজ মেলেনি। তবে বাকি যাত্রীরা সাঁতরে এবং জেলেদের সহায়তায় তীরে উঠতে পেরেছিলেন।

স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) আন্দোলনের পরিসংখ্যান বলছে, ২০২০ সালে সারাদেশে ৭০টি নৌ-দুর্ঘটনা ঘটে এবং এসব দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় ২১২ জনের এবং আহত ও নিখোঁজ হন আরও অন্তত ১০০ জন। আরেক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাব বলছে, ২০১৯ সালে সারাদেশে লঞ্চ, ট্রলার ও নৌকাডুবির ঘটনা ঘটে ১১৬টি। এর মধ্যে সংঘর্ষ ও ধাক্কার কারণে ডুবে যায় ৪৪টি নৌযান। অন্যদিকে নৌ-পরিবহন অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ১৯৯১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত দেশে ৬০৮টি নৌ-দুর্ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে ২২৪টি ছিল যাত্রীবাহী নৌযান। এসব দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় তিন হাজার ৬৩৩ জনের। আর উল্লিখিত সময়ে শুধু লঞ্চ দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় এক হাজার ৭৮১ জনের।

নৌ-পরিবহন অধিদপ্তর ‘ডমেস্টিক ফেরি সেফটি ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক উপস্থাপনায় ১৯৯১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত দুর্ঘটনার তথ্য বিশ্লেষণ করে যাত্রীবাহী লঞ্চ দুর্ঘটনার জন্য পাঁচটি প্রধান কারণ চিহ্নিত করে। এতে উল্লেখ করা হয়, দেশে ৪৩ শতাংশ লঞ্চ দুর্ঘটনা ঘটেছে অন্য নৌযানের সঙ্গে ধাক্কা লেগে। লঞ্চ দুর্ঘটনার দ্বিতীয় প্রধান কারণ অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন। মোট দুর্ঘটনার ২৫ শতাংশ ঘটেছে অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহনের কারণে। অন্যদিকে বৈরী আবহাওয়ার কারণে ২৩ শতাংশ, আগুন ও বিস্ফোরণের কারণে ছয় শতাংশ এবং বাকি তিন শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটেছে লঞ্চের তলা ফেটে গিয়ে। এসব ঘটনার বাইরে মানবসৃষ্ট ভুল, নৌরুট ও বন্দরের দুর্বল ব্যবস্থাপনা, যাত্রীদের মধ্যে প্রয়োজনীয় সচেতনতার অভাব রয়েছে। নৌ-পরিবহন অধিদপ্তরের উপস্থাপনায় আরও বলা হয়, দেশের নৌ-রুটগুলোয় চলাচল করা নৌযানের ফিটনেস সনদ না থাকা, নৌ-চ্যানেলের প্রয়োজনীয় নাব্য ও প্রশস্ততা না থাকা, চালকের অদক্ষতা ও অনেক চালকের লাইসেন্স না থাকা, চালকদের নৌযান সংঘর্ষের ঘটনা প্রতিরোধ সম্পর্কে প্রয়োজনীয় জ্ঞান না থাকা, বেপরোয়া ও দ্রুতগতিতে চলাচল এবং অন্য নৌযানকে ‘ওভারটেক’ করার প্রবণতায় ধাক্কা লেগে লঞ্চ দুর্ঘটনা বেশি ঘটছে।

অন্যদিকে নির্বিঘ্ন ও নিরাপদ নৌপথ নিশ্চিতের জন্য ‘অভ্যন্তরীণ শিপিং অধ্যাদেশ, ১৯৭৬’ রয়েছে, যেখানে নৌযান বা পরিবহন-সংক্রান্ত আইন এবং অমান্যকারীর শাস্তির বিধান-সংক্রান্ত সব বিষয় লিপিবদ্ধ আছে। অথচ এসব বিষয়ে যানচালক, যানমালিক বা যাত্রী কেউ তেমন অবগত নন। তাই যানমালিক, চালক ও যাত্রীদের স্বেচ্ছাচারী চলাচলের কারণে আমাদের বারবার দুর্ঘটনার মর্মান্তিক দৃশ্য দেখতে হচ্ছে।

নৌ-দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেয়া এখন সময়ের দাবি। একে অপরকে না দুষে সম্মিলিত প্রচেষ্টাই দুর্ঘটনা থেকে উত্তরণের পথ। নৌ-পরিবহনসংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোকে প্রশাসনিকভাবে আরও সক্রিয় হতে হবে। নৌ-চালক, মাস্টার, বন্দর তত্ত্বাবধায়ক ও যান মালিকদের কর্মকাণ্ডও জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। শিক্ষণ বা লাইসেন্সবিহীন চালক ও যানগুলোকে চিহ্নিত করে তাদের নৌ-পরিবহন-সংক্রান্ত কাজ থেকে বিরত রাখতে হবে। আইন অমান্যকারীদের ভ্রাম্যমাণ আদালত বা সংশ্লিষ্ট বিভাগের সহায়তায় আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। বিআইডব্লিউটিএ বা এ-জাতীয় কোনো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মাস্টার, চালক ও যান চালনায় সম্পৃক্ত সবাইকে বার্ষিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। বছরে একবার হলেও নৌযানের ফিটনেস পরীক্ষা করতে হবে। বড় যাত্রীবাহী নৌকা, লঞ্চ, স্টিমারসহ সব নৌযান ওয়াটারপ্রুফ কক্ষ নিশ্চিত করতে হবে। যাত্রীবাহী বড় জাহাজ বা জলযানে জীবনরক্ষাকারী ছোট নৌকাসহ আনুষঙ্গিক উপকরণ আছে কি না, যাত্রার আগেই তা পরীক্ষা করতে হবে।

যাত্রার অব্যবহিত আগে দুর্ঘটনার কবল থেকে উদ্ধার পাওয়ার উপায়-সংক্রান্ত নির্দেশনা যাত্রীদের উদ্দেশে প্রদান করতে হবে। কারণ অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, লঞ্চে বা ফেরিতে দুর্ঘটনা থেকে বাঁচার সরঞ্জাম থাকা সত্ত্বেও যাত্রীসাধারণের অজ্ঞতার কারণে তা অব্যবহƒত থেকে যায়। সাঁতার না জানা যাত্রীদের জীবনরক্ষাকারী জ্যাকেট সরবরাহের ব্যবস্থাও করতে হবে। অতিরিক্ত যাত্রী বহন কঠোরভাবে দমন করতে হবে। এক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি যাত্রীদের নিজেদেরও সচেতন হতে হবে। কারণ ঈদ বা পূজাপার্বণে ঘরমুখো মানুষের ঢল দেখে বোঝা যায়, যাত্রীদেরও দোষ কোনো অংশে কম নয়। নৌযান কর্তৃপক্ষের বাধা উপেক্ষা করেও অনেকে অতিরিক্ত যাত্রী হিসেবে ভ্রমণ করে দুর্ঘটনার পথকে ত্বরান্বিত করে থাকে। তাছাড়া দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকায় অধিকতর দক্ষ ও প্রশিক্ষিত চালকসহ ভালো মানের যান চলাচলের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিশ্চিত করতে হবে।

নদীমাতৃক বাংলাদেশে ছোট-বড় সাত শতাধিক নদী জালের মতো ছড়িয়ে রয়েছে। দেশে এখনও ৩০ শতাংশের বেশি লোক সুদীর্ঘ প্রায় ২৪ হাজার ১৪০ কিলোমিটার নদীপথ ব্যবহার করে। বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি নগর, বড় শহর বা বাণিজ্যিক এলাকাগুলো কোনো না কোনো নদীকে কেন্দ  করে গড়ে উঠেছে। বিশেষত বাংলাদেশের সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলে নৌপথই হলো গণপরিবহন বা পণ্য পরিবহনের প্রধান মাধ্যম। এখনও অনেক এলাকা রয়েছে, যেখানে সড়ক বা রেলপথের সুবিধা না থাকায় নৌপথই যোগাযোগের একমাত্র অবলম্বন। আমাদের দেশের মতো নি¤œ আয়ের দেশে ভাড়ার স্বল্পতার কারণে মানুষ যাত্রা হিসেবে নৌপথ বেছে নেয়, এটাই স্বাভাবিক। তবে নিরাপদ নৌপথ তার হারানো ঐতিহ্য ফিরে পেলে সড়কপথে যানবাহনের ওপর চাপ, দূষণ ও দুর্ঘটনাও উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পাবে।

নৌ-যাত্রা সুরক্ষার দায়িত্ব মিনিস্ট্রি অব শিপিং (এমওএস), ডিপার্টমেন্টে অব শিপিং (ডিওএস) ও বাংলাদেশ ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআইডব্লিউটিএ)। মিনিস্ট্রি অব শিপিংয়ের ওপর নৌপথ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা-সংক্রান্ত নীতি প্রণয়নের দায়িত্ব ন্যস্ত। আর সরকারের ক্ষমতাবলে সব ধরনের নৌযানের নিরাপত্তা নিশ্চিতসহ যানের ফিটনেস পরীক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত আছে ডিপার্টমেন্ট অব শিপিং (ডিওএস)। অপরদিকে বিআইডব্লিওটিএ নৌপথ ও যান নোঙর-সংশ্লিষ্ট স্থানের নিরাপত্তা ও আবহাওয়া-সংক্রান্ত তথ্যাদি পাঠানো নিশ্চিতকরণে নিয়োজিত রয়েছে। লোকবল ও প্রয়োজনীয় আধুনিক যন্ত্রপাতির সংকটের কারণে বিভাগগুলোয় আশানুরূপ কাজের অগ্রগতিতে বিঘ্ন ঘটছে বলেও জানা যায়। বিআইডব্লিউটিএ’র তথ্যমতে, দেশে নিবন্ধিত নৌযানের সংখ্যা মাত্র ৯ হাজার ৭২৫টি। এর বাইরে অনিবন্ধিত বহু নৌযান নৌপথে নিয়মিত যাতায়াত করছে এবং এদের দ্বারাও অনেক দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে মানুষ।

দুঃখের বিষয়, প্রতিবছর নৌ-দুর্ঘটনা শত শত মানুষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনার চিত্র তুলনামূলকভাবে বেশি দৃশ্যমান হলেও নৌ-দুর্ঘটনার ফলাফল তীব্রতর ও অধিক ভয়াবহ। যেমন ৫০ যাত্রী নিয়ে একটি বাস দুর্ঘটনা-কবলিত হলে সর্বোচ্চ ১০ থেকে ১২ জনের মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া যায়। কিন্তু একই সংখ্যক যাত্রী নিয়ে কোনো লঞ্চ দুর্ঘটনার শিকার হলে যাত্রীসংখ্যার অর্ধেকের বেশি মৃত্যুর খবরই আসে। নৌ-দুর্ঘটনায় শোকের মাতম আরও বেশি এই কারণে যে, সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতদেহ উদ্ধার বা শনাক্ত করা গেলেও নৌ-দুর্ঘটনায় অনেক মৃতদেহ পানির নিচ থেকে উদ্ধার করা সম্ভবপর হয় না। চিরদিনের মতো সলিল সমাধি লাভ করে দুর্ঘটনাকবলিত মানুষেরা। তারা হারিয়ে যায় চিরদিনের মতো। স্বজনরা শেষ দেখা বা কবরের চিহ্ন দেখতে পায় না।

আমাদের দেশে অতীতের দুর্ঘটনার কারণ বিশ্লেষণ করলে চালকদের অদক্ষতা আর অবহেলিত দুর্ঘটনার মাত্রা বেশি বলে প্রতীয়মান হয়। পাশাপাশি বৈরী আবহাওয়া ও যান্ত্রিক ত্রুটিজনিত কারণও অন্যতম, যার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতাও কম দায়ী নয়। ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে এমভি অভিযান-১০-এর যান্ত্রিক ত্রুটির বিষয়টি এরই মধ্যে উঠে এসেছে। নদীমাতৃক আমাদের এদেশে নদীকে কেন্দ্র করেই হাজার হাজার মানুষ জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে। এছাড়া দেশের অধিকাংশ মানুষের যাতায়াতের একটি অন্যতম মাধ্যম নৌপথ। তুলনামূলকভাবে খরচ কম এবং আরামদায়ক হওয়ায় দেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ যাতায়াতের জন্য নৌপথকে বেছে নেয়। সম্প্রতি যাতায়াতের সবচেয়ে নিরাপদ ও আরামদায়ক এ পথটি এখন সড়কের মতো অনিরাপদ হয়ে উঠেছে। একের পর এক ঘটছে দুর্ঘটনা। এসব দুর্ঘটনায় শতশত মানুষের আহত হওয়ার পাশাপাশি প্রাণহানিও ঘটছে। নৌযান দুর্ঘটনায় দোষীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসার পাশাপাশি যাত্রীদের সচেতন ও সতর্ক থাকতে হবে। নৌপথের দুর্ঘটনাজনিত কারণে আমরা আর স্বজন হারানোর হাহাকার বা আর্তনাদ শুনতে চাই না। নৌপথ ও নৌযান যেন হয় নিরাপদ ও স্বস্তির, এটিই প্রত্যাশা

ব্যাংক কর্মকর্তা ও মুক্ত লেখক

rbbbp@gmail.com

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০