মহসিন মিলন, বেনাপোল (যশোর): বারি কুল চাষ করে ভাগ্য বদলে ফেলেছেন যশোরের শার্শা উপজেলার প্রায় ৫০০ নারী ও পুরুষ। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) উদ্ভাবন করা আপেল কুল, বাউকুল, ঢাকা-৯০, নারিকেল কুল, নাসিম টক কুল, থাইকুল, বলসুন্দরি কুল, সিডলেস কুল, কাশ্মীরি জাতের কুলসহ কয়েক জাতের চাষ করেছেন তারা। মাত্র চার মাসে লাখ টাকার ফলন দেখে জীবন বদলের স্বপ্ন দেখছেন আরও অনেকে। সরকারিভাবে তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা ও কুল রপ্তানির উদ্যোগ নিলে অধিক লাভবান হবেন বলে মনে করেন কুলচাষিরা।
উপজেলাজুড়ে কুলচাষ হলেও সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে বেনাপোল, বাগআঁচড়া, উলাশি ও কায়বা ইউনিয়নে। বেনাপোল, কাগজপুকুর, উলাশি, নাভারন, হাড়িখালী, বাগআঁচড়া ও বেলতলা বাজারে চলে মৌসুমি কুলের বেচাকেনা। এসব স্থানে রয়েছে অনেক কুলের আড়ত। এখান থেকে প্রতিদিন অন্তত দুই ট্রাক কুল ঢাকা ও বরিশালের ফল বাজারে যায় বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
বাগআঁচড়া মাঠপাড়া গ্রামের ইউনুস আলী (৪৫) কুলচাষ করেই স্বাবলম্বী হয়েছেন, যা অন্যদের অনুপ্রাণিত করে। একটি কুলবাগান থেকে করেছেন তিনটি বাগান। গোটা বাগানজুড়ে নাসিম টক, থাই, ঢাকা-৯০, বলসুন্দরি, কাশ্মীরি, আপেল ও নারকেল কুল ধরেছে। ফলের ভারে স্বল্প উচ্চতার গাছগুলো নুইয়ে পড়ছে। নাসিম টককুলের বিক্রি শেষ। নারকেল, বলসুন্দরি ও থাইকুল পুষ্ট হয়ে গেছে, আকারেও বড়। আপেল কুল এখনও পুরোপুরি পুষ্ট হয়নি। এগুলোর বর্ণ অনেকটা বাদামি ও খয়েরি রঙের মিশেল।
ইউনুস জানান, পুষ্ট হলে এগুলো সাদা হয়ে যাবে। আর ঢাকা-৯০ কুল তীব্র শীতের কারণে এখনও অপুষ্ট রয়ে গেছে। ভালো ফলনের জন্য নিয়মিত সেচ ও সার দিতে হয়। নিয়মিত পরিচর্যার জন্য পাঁচ থেকে ছয়জন লোক রাখার পাশাপাশি শ্রম দিতে হয়। বিঘাপ্রতি সব মিলিয়ে খরচ পড়ে প্রায় ৩০ হাজার টাকা। আর ফলন পাওয়া যায় ৯০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা। এ বছর তার ১১ বিঘা জমিতে খরচ হয়েছে তিন লাখ টাকার কিছু বেশি। মৌসুম শেষে তিনি বিক্রি করে পাবেন ১১ লাখ টাকা। এ মৌসুমে ইতোমধ্যে ঢাকা ও বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন জেলার ফলের আড়তে ট্রাকযোগে কুল পাঠানো শুরু করেছেন।
ইউনুস আলীর মতো অনেক কৃষকের মতে, কুল একটি লাভজনক ফসল। একসঙ্গেই সব কুল পাকা শুরু হয়। পাকা কুল সংরক্ষণের কোন ব্যবস্থা নেই। তাই অনেক সময় বাধ্য হয়ে কম দামে বিক্রি করতে হয়। আমের মতো কুল যদি রপ্তানি করা যায় তবে সবাই লাভবান হবে। এ ব্যাপারে সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে বলে মনে করেন তারা।
ইউনুসের কুলবাগানে কথা হয় ওই বাগানের শ্রমিক মনির হোসেন, মাসুম বিল্লাহ ও সাগর হোসেনের সঙ্গে।
মনির হোসেন বলেন, ‘মাসে ১০ হাজার টাকা বেতনে কাজ করি। এই ফলের বাগানে কাজ করতি (করতে) আমার বেশ ভালোই লাগে। মাস শেষে যে বেতন পাই তা দিয়ে আমার সংসার বেশ চলে যায়। আমি আমার ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখাচ্ছি। আমারও ইচ্ছে আছে ভবিষ্যতে এমন সুন্দর একটা ফলের বাগান করার।’
সামটার খোরশেদ আলম, শাহাজান আলী, কাশিয়াডাঙ্গা গ্রামের রেক্সোনা খাতুন, শ্যামলাগাছির মনি বেগম, গাতিপাড়ার আহসান হাবিব, গোগার সহিদুল ইসলাম, গাতিপাড়ার সফিউদ্দিনও সফল কুলচাষি।
দ্বিতীয় শস্য বহুমুখীকরণ প্রকল্পের আওতায় প্রদর্শনী প্লটের মাধ্যমে সামটার শাহাজান আলী দেড় বিঘা জমিতে কুল চাষ করেছেন। নিজেই জমির দেখভাল করেন। অন্য ফসল চাষ করে চারজনের সংসার চালানো কঠিন। তাই বিকল্প হিসেবে গত বছর এই কুলের চাষ শুরু করেছেন তিনি। কুল চাষ করে তাদের সংসারে সচ্ছলতা ফিরে এসেছে বলে জানিয়েছেন তিনি। এ পর্যন্ত ৯০ হাজার টাকার কুল বিক্রি করেছেন। আরও ৫০ হাজার টাকার কুল বিক্রির আশা করছেন। এ বছর তার খরচ হয়েছে ৩৫ হাজার টাকা। আগামী ১০ বছর আর বড় কোনো খরচ নেই বাগানে। এখন বছর বছর শুধু টাকা আসবে। তাই তার এখন শুধু স্বপ্ন দেখার পালা।
উলাশির কাঠুরিয়া গ্রামের কুলচাষি খোরশেদ আলম বলেন, এই মাঠে এ বছর নতুন করে আট বিঘা জমিতে কুল গাছ লাগিয়েছিলাম। একদিন বাদে ৪০০ কেজি করে কুল পাচ্ছি। প্রতি কেজি কুল বিক্রি করছি ৩৫ থেকে ৫০ টাকায়। প্রতি বিঘায় এক লাখ টাকার কুল বিক্রি করার আশা করছেন তিনি।
শার্শার নাভারন-সাতক্ষীরা সড়কের হাড়িখালী মোড়ে রয়েছে তার ‘বিসমিল্লাহ ফলভাণ্ডার’। ৪৫ জন কুলচাষি তার মাধ্যমে ঢাকা ও বরিশালে ফল পাঠান।
শার্শা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সৌতম কুমার শীল জানান, উপজেলায় এবার পাঁচশ’র বেশি কৃষক অন্তত দেড় হাজার বিঘা জমিতে কুলচাষ করেছেন। চাষিদের কৃষি বিভাগ থেকে নানা পরামর্শ দিচ্ছে ও সহায়তা করে আসছে।