আবুজার গিফারী : আইনের ছাত্র হিসেবে প্রত্যেকের আকাক্সক্ষা একজন ভালো আইনজীবী হওয়া; দেশসেরা আইনজীবী হয়ে দেশের মানুষের পক্ষে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ও ন্যায়ের পক্ষে কাজ করা। যে সমাজে ভালো আইনজীবীর বসবাস, সে সমাজের মানুষের অধিকার কখনোই ভূলুণ্ঠিত হয় না। বরং সে সমাজের মানুষ নিজেদের অধিকার নিয়ে সর্বদা সচেতন থাকে। অধিকারবঞ্চিত মানুষেরাই জানে অধিকার ফিরে পেতে কতটা বেগ পোহাতে হয়। দুধ ও পানির মিশ্রণ থেকে পানি থেকে দুধ আলাদা করা যত কঠিন, তার চেয়ে বেশি কঠিন হলো অন্যায় থেকে ন্যায়কে আলাদা করা। আর এই কঠিনতম কাজটি তথা ন্যায়কে প্রতিষ্ঠিত করতে প্রয়োজন ভালো আইনজীবী। বার কাউন্সিল হলো সেই আইনজীবী তৈরির আঁতুড়ঘর।
আগে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন পড়ানো হতো। কিন্তু আজ পর্যায়ক্রমে জাহাঙ্গীরনগর, জগন্নাথ, খুলনাসহ প্রায় ১৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন পড়ানো হয়। ফলে আগের চেয়ে আইনে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের সংখ্যাও বেশ বেড়েছে। এদিকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় আইনে পড়ার ভালো সুযোগ না থাকায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আইনে শিক্ষার্থী ভর্তি করার বেশ সুযোগ পেয়েছে। একইসঙ্গে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় দু’বছরের সান্ধ্যকালীন এলএলবি ও এক বছরের এলএলএম কোর্স সম্পন্ন করার সুযোগ থাকায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা ক্রমাগতভাবে বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে দেশে ১০৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এগুলোর মধ্যে অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনে শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হয়। সুতরাং আমাদের কাছে সহজেই অনুমেয় যে, প্রতিবছর কয়েক হাজার শিক্ষার্থী এলএলবি ও এলএলএম শেষ করছে। এখান থেকে বেশ কিছু শিক্ষার্থী যাচ্ছে বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিসে। বাকিরা অধিকাংশই আইনজীবী পেশাকেই বেছে নিচ্ছে।
সাধারণত কেউ যদি আইন পেশায় কর্মজীবন শুরু করতে চায়, তাহলে তাকে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের অধীনে অনুষ্ঠিত এমসিকিউ, রিটেন ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। কিন্তু ২০১২ সালের আগে এ নিয়ম ছিল না। তখন শুধু রিটেন পরীক্ষা দিয়েই সনদ পাওয়া যেত। এখন আর সে সুযোগ নেই। বর্তমানে আইনজীবী হতে হলে বার কাউন্সিল বিধি অনুযায়ী ‘অ্যাডভোকেট’ হিসেবে তালিকাভুক্তির (এনরোলমেন্ট) জন্য পরীক্ষা দিতে হয়। সাধরাণত নিয়ম হলো বার কাউন্সিল বছরে দুবার পরীক্ষা নেবে। ২০১২ সালের আগে গড়ে আট মাসে একটি পরীক্ষা সম্পন্ন হতো। কিন্তু বর্তমানে আড়াই-তিন বছর পরপর এই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। কোনো কারণে একবার কেউ ফেল করলে তার পাঁচ-ছয় বছর সময় লেগে যাচ্ছে। সহজে নিরাময়যোগ্য এই সমস্যা দেশে অপ্রত্যাশিত বেকারত্ব ও ভবিষ্যতের বিচার বিভাগের ভিত নড়বড়ে করে দিচ্ছে। দীর্ঘ বিলম্বের কারণে আবার কেউ কেউ আইন পেশাকে বেছে নিতে আগ্রহ হারাচ্ছে। একইসঙ্গে মেধাবীরা অন্য পেশায় ঝুঁকে পড়ছে আইন পেশাকে উপেক্ষা করে। আইন পড়ে আইনজীবী হিসেবে আইন প্র্যাকটিস করবে, এটাই তো স্বাভাবিক; কিন্তু আইনজীবী তালিকাভুক্ত পরীক্ষার দীর্ঘসূত্রতার কারণে শতকরা ৮০ ভাগের বেশি আইনের গ্র্যাজুয়েট আইন প্র্যাকটিস করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। বাংলাদেশে প্রায় সব পরীক্ষা অনুষ্ঠান ও ফলপ্রকাশ দ্রুততম সময়ের মধ্যেই হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম বার কাউন্সিলের আইনজীবী তালিকাভুক্তির পরীক্ষা, যে পরীক্ষার ক্ষেত্রে বিড়ম্বনা ও খেয়ালিপনার শেষ নেই।
সবচেয়ে বিপাকে আছে শিক্ষানবিশ আইনজীবীরা। আইনজীবী হিসেবে সনদ পেতে বছরের পর বছর অপেক্ষায় থাকা শিক্ষানবিশ অনেক আইনজীবীর মধ্যেই হতাশা কাজ করছে। যারা একদিন স্বপ্ন দেখেছিল নামকরা আইনজীবী হওয়ার, তারাই আজ বাস্তব জীবনে এসে হতাশায় বিহ্বল। আইনে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভের পর একজন শিক্ষার্থী বাংলাদেশ বার কাউন্সিল পরীক্ষার নিবন্ধন শেষে শিক্ষানবিশ আইনজীবী হিসেবে কোনো জ্যেষ্ঠ আইনজীবীর অধীনে ছয় মাসের প্রবেশনকালীন মামলা ও আইনি বিষয় সম্পর্কে অবহিত হন। সিনিয়রকে সহযোগিতা করার পাশাপাশি এ সময়ে আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্তির পরীক্ষার প্রস্তুতিও নেন। কিন্তু বার কাউন্সিলের অনিয়মিত পরীক্ষার কারণে তাদের শিক্ষানবিশকাল দীর্ঘায়িত হচ্ছে। আমরা জানি বার ও বেঞ্চকে নিয়েই বিচার বিভাগ। এক্ষেত্রে বার ও বেঞ্চকে ঈগলের দুই ডানা নামে অভিহিত করা হয়। প্রায় ৪০ লাখ বিচারাধীন মামলাজটের দেশে বার ও বেঞ্চ গঠনপ্রক্রিয়াটি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারে ও গতিশীল থাকবে, এটাই স্বাভাবিক প্রত্যাশা। কিন্তু এই নিয়োগপ্রক্রিয়ায় সার্বিকভাবে একটা স্বচ্ছতার ঘাটতি চলছে। কেউ কর্মজীবনের শুরুতে বিচারপতি হয়ে পরে আইনজীবী হতে পারেন না। প্রথমে হতে হবে আইনজীবী, কিন্তু সেই আইনজীবী হওয়ার প্রক্রিয়া ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে। উন্নয়ন-নীতিনির্ধারকদের মানতে হবে, যারা একদিন বিচার বিভাগের অংশে পরিণত হবেন, তারা জীবনের শুরুতেই অকারণে হোঁচট খাচ্ছেন, দুঃখ-দুর্দশায় পতিত হচ্ছেন। এটা নিশ্চয় তারা বিচার বিভাগের কাছ থেকে আশা করেন না।
সময় এসেছে পরিবর্তনের। আইনজীবীদের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ বার কাউন্সিলকে এখনই যুগোপযোগী পদক্ষেপ নিতে হবে। কোনো শিক্ষার্থী যাতে নিরাশ হয়ে আইন পেশা থেকে দূরে সরে না যায়, সে বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে হবে। বছরের নির্দিষ্ট সময়ে পরীক্ষার তফসিল নির্ধারণ করতে হবে। একইসঙ্গে বার কাউন্সিল পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর অতিশিগগির প্রার্থীদের আবেদন অনুযায়ী আদালত নির্ধারণ নিশ্চিত করতে হবে। আমরা দেখছি, বার কাউন্সিল শুধু পরীক্ষা নিতেই বিলম্ব করে না, পরীক্ষা নেওয়ার পরও যোগ্য প্রার্থীদের কোর্ট সীমানা নির্ধারণ করতেও হরহামেশাই দু-এক বছর বিলম্ব করে থাকে, যেটা আইনে পড়তে আসা শিক্ষার্থীরা বার কাউন্সিলের কাছ থেকে মোটেও প্রত্যাশা করে না। বর্তমানে আইনে পড়ার চাহিদা আগের চেয়ে অনেক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সুতরাং এক্ষেত্রে আইন বিষয়ে দুই বছরের কোর্স সম্পন্ন করে অ্যাডভোকেট তালিকাভুক্তির পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ বন্ধ করা সমীচীন হয়ে পড়েছে।
সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিবছরই সহস্রাধিক শিক্ষার্থী চার বছরের এলএলবি ডিগ্রি সম্পন্ন করেই বের হচ্ছে। এক্ষেত্রে তাদের উপেক্ষা করে যদি চার বছরের পরিবর্তে দুই বছর আইন পড়া শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হয়, তাহলে সহস্রাধিক শিক্ষার্থীর অধিকার অবশ্যই নষ্ট করা হবে। আইনের গুরুত্ব আজ আমরা নিজেরাই ধ্বংস করছি। বলতে কুণ্ঠাবোধ করি না, বর্তমানে সাধারণ মানুষ আইনজীবীদের কাছে আসতে ভয় পায়। তাদের মন্তব্য হলো, টাকার বিনিময়ে আইনজীবীরা সত্যকে মিথ্যায় রূপান্তর করে। আমাদের সমাজে ভালো আইনজীবীর বড়ই অভাব। আইনজীবী হবে মানুষের বন্ধু। অধিকারবঞ্চিত মানুষগুলো হরহামেশাই আইনজীবীর কাছে গিয়ে তার মনের কথা সহজেই বলবে, কিন্তু এগুলো আজ খাতা-কলমেই লিপিবদ্ধ।
বার কাউন্সিলের নীতিমালা অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি ৪০ বছর বয়স পর্যন্ত বার কাউন্সিল পরীক্ষাই অংশগ্রহণ করতে পারবে। এ নিয়মটা যুক্তিযুক্ত নয়। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের মতো ৩২ বছর রাখা সমুচিত। কেননা বয়সসীমা বেশি থাকায় আইন পেশাকে যে যার মতো ব্যবহার করছে। আমরা একটা উদাহরণ দিলে সহজেই উপলব্ধি করতে পারবÑ‘ক’ নামক ব্যক্তি আইনে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সাধারণ পদে ১০ বছর চাকরি করলেন। ১০ বছর চাকরির পর ব্যক্তিগত সমস্যার কারণে কোম্পানি থেকে অব্যাহতি নিলেন। তার বয়স এখন ৩৫। তিনি এখন ভাবলেন বার কাউন্সিলের পরীক্ষার মাধ্যমে আইনজীবী হবেন। অতঃপর সে আইনজীবী হলেন। এখন পাঠকের কাছে আমার প্রশ্ন যে ব্যক্তি দীর্ঘ ১০ বছর আইনচর্চার বাইরে সে ব্যক্তি কীভাবে তার ক্লায়েন্ট তথা একজন অধিকারবঞ্চিতকে আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অধিকার ফিরিয়ে দিতে যুক্তিযুক্তভাবে সক্ষম হবেন? আর এ রকম আইনজীবী আমাদের দেশে হরহামেশাই দেখা যায়। একশ্রেণির এমন কিছু আইনজীবীর কারণে সাধরাণ মানুষের আজ আইনের প্রতি আস্থা নেই, নেই কোনো সম্মানবোধ। বার কাউন্সিলকে এ বিষয়টি আমলে নিয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। আইনজীবী তালিকাভুক্তির পরীক্ষা পদ্ধতি মানসম্মত করতে হবে। এক্ষেত্রে আমরা বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনকে অবশ্যই প্রশংসা করব, কেননা কমিশনের নীতিমালা অনুযায়ী তারা প্রতিবছরই যোগ্য প্রার্থীকে বাছাই করে সহকারী জজ হিসেবে নিয়োগ দিচ্ছে। নেই কোনো পরীক্ষা নেওয়ার বিড়ম্বনা বা নিয়োগ বিড়ম্বনা। মানসম্মত প্রশ্নমালা তৈরি করে পরীক্ষা নেওয়ার মাধ্যমেই তারা যোগ্য প্রার্থী বাছাই করতে সক্ষম হয়েছে। বার ও বেঞ্চ মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। সুতরাং বার কাউন্সিলকে ভালো আইনজীবী তৈরি করতে জুডিশিয়াল কমিশনের মতো শক্ত অবস্থানে থাকতে হবে। তাহলেই আমার দেশ পাবে ভালো আইনজীবী। আর সাধারণ মানুষ পাবে তাদের অধিকার ফিরে পাওয়ার এক লৌহমানব, যিনি থাকবেন সত্যের পক্ষে নির্ভীক, অন্যায়ে আপসহীন। বলা বাহুল্য, মহিলা আইনজীবীদের জন্য উচ্চ আদালতসহ দেশের সব আদালতে ব্রেস্ট ফিডিং রুম, স্যানিটারি প্যাডসহ আলাদা ওয়াশরুমের ব্যবস্থা বার কাউন্সিলকে নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি মামলাজট কমাতে কার্যকর ও বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। আইনজীবীদের আইসিটি বিষয়ে দক্ষতা বৃদ্ধি ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার জন্য জরুরি উদ্যোগ নিতে হবে। আর যখনই বার কাউন্সিলের মাধ্যমে এ ধরনের যথাযথ উদ্যোগ নিশ্চিত হবে, তখনই মেধাবী শিক্ষর্থীরাও আইন প্র্যাকটিসের প্রতি আগ্রহ বাড়াবে।
শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
abujar.gifary.5614@gmail.com