কে এম রুবেল, ফরিদপুর : ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার নাসিরাবাদ ইউনিয়নের কোষাডাঙ্গা গ্রামে আড়িয়াল খাঁ নদে ড্রেজিং করে উত্তোলন করা লাখ লাখ ঘনফুট বালি নিয়ে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। নিয়মানুযায়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) প্রধান করে পাঁচ থেকে সাত সদস্যবিশিষ্ট একটি বালি ও মাটি ব্যবস্থাপনা কমিটি থাকার কথা। কিন্তু নিয়মের তোয়াক্কা না করেই ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি লিজ নিয়ে সেখানে বালি ফেলা হচ্ছে। আর শত শত ট্রাক বালি বিক্রি করে দেওয়ারও অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বিষয়টি নিয়ে উপজেলা পরিষদে এক সভায় উত্থাপনের পর সবার নজরে আসে। এ নিয়ে বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয় থেকে তদন্ত করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতায় ভাঙ্গা ও সদরপুর উপজেলায় আড়িয়াল খাঁ নদের নাব্য রক্ষায় প্রায় ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প গ্রহণ করে সরকার। ওই প্রকল্পের আওতায় কোষাডাঙ্গা গ্রামে আড়িয়াল খাঁ নদের ১ হাজার ৩০০ মিটার খননের কাজ শুরু করে একোয়া মেরিন ড্রেজিং নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। কোম্পানিটির সাইট ম্যানেজার ওমর ফারুক জানান, তিন মাস আগে থেকে তারা দুটি ড্রেজিং মেশিন বসিয়ে ড্রেজিং কাজ শুরু করেন। এ পর্যন্ত প্রায় ৪০ লাখ ঘনফুট বালি তোলা হয়েছে। একটি ড্রেজিং মেশিন দিয়ে প্রতি ঘণ্টায় ১০ হাজার ঘনফুট বালি উত্তোলন করা হয়। এ পর্যন্ত প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে।
সরেজমিন দেখা গেছে, আড়িয়াল খাঁ নদের পাশেই কোষাডাঙ্গা গ্রামের বিভিন্ন ব্যক্তির ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রায় ৩৩ বিঘা জমিতে এসব বালি রাখা হয়েছে। আর এসব বালি থেকে নিষ্কাশিত পানিতে বসতি জমি, কবরস্থান ধসে গেছে। গাছপালা ও ফসলাদি নষ্ট হচ্ছে। এতে ক্ষুব্ধ
স্থানীয়রা কোনো ক্ষতিপূরণ পাননি। সংশ্লিষ্ট জমির মালিকরা জানান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) বালি রাখার জন্য তাদের কাছ থেকে বার্ষিক ভিত্তিতে জমি লিজ নিয়েছেন।
ওই গ্রামের লতিফ ফকির জানান, তার তিন ফসলি দুই বিঘা জমি ৫০ হাজার টাকা চুক্তিতে ইউএনও এবং এসি ল্যান্ড লিজ নিয়েছেন। তবে অনেকে এখনও লিজের টাকা পাননি। এদিকে অনেকের অভিযোগ, তাদের জমিতে বালি ফেলা হলেও তাদের জানানোও হয়নি। এর প্রতিবাদ জানালে তাদের এসিল্যান্ড ও ইউএনও’র সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলা প্রশাসনের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, নিয়মানুযায়ী ড্রেজিং করে উত্তোলন করা বালি ফেলার স্থান নির্ধারণ করবে পানি উন্নয়ন বোর্ড। উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের জমি লিজ নেওয়ার সুযোগ নেই। তবে তারা বালি ব্যবস্থাপনা কমিটির প্রধান হিসেবে মধ্যস্থতা করতে পারেন। সরকারের প্রয়োজন ছাড়া বিনা টেন্ডারে বালি বিক্রি করা বা সরানো নিষেধ।
নাসিরাবাদ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নূরে আলম সিদ্দিকী বলেন, ‘বালি ব্যবস্থাপনা কমিটি করলে সেখানে আমারও থাকার কথা। কিন্তু উপজেলা প্রশাসন বা পানি উন্নয়ন বোর্ড আমাকে কিছু জানায়নি। এরই মধ্যে ১০ চাকার ট্রাক ও ড্রাম ট্রাকে ভরে কয়েকশ’ ট্রাক বালিও বিক্রি করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে গত মাসের জরুরি উন্নয়ন সমন্বয় সভায় আলোচনার পর জেলার স্থানীয় সরকার বিভাগের সহকারী পরিচালকের (ডিডিএলজি) কার্যালয় থেকে ব্যাখ্যা চাওয়া হলে, পুরো বিষয়টি লিখিতভাবে জানিয়েছি।’
এ ব্যাপারে জানতে ভাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রাকিবুর রহমান খানের কার্যালয়ে গেলে তিনি বক্তব্য না দিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন। তবে উপজেলা প্রশাসনের একটি সূত্র জানায়, সম্প্রতি বালি বিক্রির জন্য টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছে।
উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান বলেন, ‘বিষয়টি জানা আছে। স্থানীয়রা একাধিকবার অভিযোগ দিয়েছেন। সংসদ সদস্য নিক্সন চৌধুরী ভাঙ্গা, সদরপুর ও চরভদ্রাসনে নদীভাঙন রোধে দীর্ঘদিন চেষ্টা করেছেন। অবশেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায় ৬০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছেন। সে কাজে আড়িয়াল খাঁ নদী থেকে উত্তোলিত বালি স্থানীয় বাসিন্দাদের ফসলি জমিতে ফেলা হচ্ছে, লিজ নেওয়ার কথা বলে তাদের লিজের টাকাও দেওয়া হয়নি। অনেক বিষয়েই আমাদের কথা বলার সুযোগ নেই। কিন্তু আমরা জনপ্রতিনিধি, জনগণের কাছে আমাদের জবাবদিহি করতে হয়।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক অতুল সরকার বলেন, ‘যতদূর জানি এ বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন হয়েছে বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয় থেকে।’ তবে তদন্তাধীন বিষয়ে তিনি আর কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। আর পানি উন্নয়ন বোর্ডের ফরিদপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী সুলতান মাহামুদ বলেন, ‘ড্রেজিং করা বালি বা মাটির মালিক সরকারের পক্ষে জেলা প্রশাসক, ইউএনও এবং এসি ল্যান্ড। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নিজস্ব জমি নেই, তাই ইউএনও এবং এসি ল্যান্ডের মাধ্যমে হুকুম দখল করে স্বল্প সময়ের জন্য জমিগুলোয় বালি ফেলা হচ্ছে।’ স্থানীয়দের যে সমস্যার কথা বলছেন তা অবগত আছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘স্থানীয়দের সমস্যার সমাধান করেই কাজ করা হবে।’