বাল্যবিবাহ: প্রসঙ্গ পুরুষ ও সহায়ক শক্তি

জিনাত রহমান: দিনাজপুর সদর উপজেলার চাউলিয়াপট্টি এলাকার মেয়ে রোকেয়া। তার বাবা সফর আলি একজন ভ্যানচালক এবং মা আমিনা গৃহিণী। গৃহকাজের পাশাপাশি আমিনা ছোটখাটো হাতের কাজ ও কাঁথা সেলাইয়ের কাজ করেন। পাঁচ ছেলে-মেয়ে নিয়ে তাদের সংসার। সফর আলি তার মেয়ে সাবিহাকে বোঝা মনে করে লেখাপড়া করাতে চায় না। কিন্তু সাবিহাকে নিয়ে তার মায়ের রয়েছে অনেক আশা। সরকার যেহেতু বিনা পয়সায় মেয়েদের লেখাপড়া করার সুযোগ করে দিয়েছে তাই মা চায় তার মেয়ে লেখাপড়া শিখুক। আমেনার বাড়িতে যখন এলাকার অন্যান্য নারীরা আসে উঠান বৈঠক করতে, তখন আমেনা স্বপ্ন দেখে নিজের মেয়েকে নিয়ে। সে স্বপ্ন দেখে তার মেয়ে বড় চাকরি করবে। যৌতুক, নারী নির্যাতন, স্বাস্থ্য ইত্যাদি বিষয়ে সমাজের মানুষকে সচেতন করবে। সমাজের যেসব বিষয়ে সে নিজে কষ্ট পেয়েছে বা অন্য নারীদের দুর্ভোগ দেখে এসেছে তা দূর করার স্বপ্ন সে তার মেয়েকে দিয়েই পূরণ করতে চায়। কিন্তু মেয়েটির বাবা হঠাৎ একদিন এসে বলে সাবিহার জন্য একটা বিয়ের সম্বন্ধ এসেছে, এমন উপযুক্ত পাত্র হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। মায়ের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। তার মেয়ের বয়স মাত্র ১৪ বছর। এই বয়সে কোনোভাবেই সে মেয়ের বিয়ে দিতে রাজি নয়। তারপরও থেমে থাকে না বিয়ের কথা। আমিনা বেগম চোখে অন্ধকার দেখে। কী করবে সে? সমাজ ব্যবস্থায় বিবাহ একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই পবিত্র বন্ধনকে উপলব্ধি করার জন্য ছেলে-মেয়ে দু’জনেরই পরিণত হওয়া খুব জরুরি। কিন্তু মায়ের আর্তি কেউ শুনতে পায় না।

বর্তমানে নারীদের অবস্থা এবং অবস্থানের উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকার ও বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠনের বহুবিধ কার্যক্রম গ্রহণ করা সত্ত্বেও পরিবার, সমাজে, কর্মক্ষেত্র এবং রাষ্ট্রে নিজেদের অধিকার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নারীদের অবস্থান এখনও আশানুরূপভাবে পরিবর্তিত হয়নি। নারী ও শিশুরা বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, এখনও প্রতিনিয়ত এবং এর ভয়াবহতাও কম নয়। নারী নির্যাতন যেন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যদিও তা প্রতিরোধে সরকার আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে, প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।

১৯২৯ সালের বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনেই বলা উল্লেখ করা হয়েছে, মেয়ের বয়স ১৮ ও ছেলের বয়স ২১ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে তাদের বিয়ে দেয়া যাবে না। পরে সরকার বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন-২০১৭ এবং যৌতুক নিরোধ আইন-২০১৮ প্রণয়ন করেছে। এ আইনে বাল্যবিবাহের শাস্তি হিসেবে কারাভোগের মেয়াদ সর্বোচ্চ তিন মাসের জায়গায় দুই বছর করা হয়েছে, জরিমানা বাড়িয়ে ৫০ হাজার টাকা করা হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার প্রণীত শিশু আইন ২০১৩ ও জাতীয় শিশু নীতি ২০১১ অনুযায়ী ১৮ বছরের কম বয়সী সবাই শিশু। তাই ১৮ বছরের আগে কোনো মেয়েকে বিয়ে দেয়া দণ্ডনীয় অপরাধ। আইনটির বিষয়ে গ্রামের সাধারণ মানুষের অজ্ঞতা রয়েছে এখনও। পাশাপাশি এর পরিণতি সম্পর্কেও স্পষ্ট ধারণা নেই তাদের। তাই বাল্যবিবাহের নেতিবাচক দিকগুলো সম্পর্কে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে সচেতন করতে হবে। এর শাস্তি সম্পর্কেও ব্যাপকভাবে জনগণকে জানাতে হবে, বিশেষ করে জš§নিবন্ধন সনদ অথবা জাতীয় পরিচয়পত্র দেখে বিয়ে পড়ানো বাধ্যতামূলক করতে হবে। ইউপি চেয়ারম্যান বা মেম্বার কর্তৃক জš§নিবন্ধন সনদপত্রে ছেলে-মেয়েদের বয়স বাড়ানোর প্রচেষ্টা প্রতিহত করতে হবে। বাল্যবিবাহ বন্ধে এলাকার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীসহ সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সম্পৃক্ততা ও প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে যথাযথ আইন প্রয়োগের মাধ্যমে বাল্যবিবাহের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা করা গেলে বাল্যবিবাহের প্রকোপ অনেকটাই কমে আসবে বলে আশা করা যায়।

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, বাল্যবিবাহের সঙ্গে শিক্ষার নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। কোনো রকম শিক্ষার সুযোগ পায়নি এমন মেয়ের শিশু অবস্থায় বিয়ের হার বেশি। তবে মাধ্যমিক বা উচ্চশিক্ষা প্রাপ্ত মেয়েদের ক্ষেত্রে এ হার অনেক কম। এর কারণ অনুসন্ধান করে বেশ কিছু অর্থনৈতিক, সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক বিষয় উঠে এসেছে। দারিদ্র্যের কারণে যেমন মেয়ের মা-বাবা শিশু বয়সে মেয়ের বিয়ে দিচ্ছেন, তেমনি বিয়ের মাধ্যমে যৌতুক পাওয়ার আশায় অল্প বয়সী ছেলেকেও বিয়ে দিতে চান অনেক মা-বাবা। এছাড়া বখাটে ছেলেদের উৎপাতে মেয়ের নিরাপত্তার চিন্তায়ও অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে দিতে দেখা যায়। আবার বেশি বয়স হয়ে গেলে ভালো পাত্র পাওয়া যাবে না, এমন ভাবনা থেকেও শিশু বয়সেই মেয়ের বিয়ের জন্য অস্থির হয়ে ওঠেন অনেক মা-বাবা। অথচ বিয়ের পর ওই শিশুটির শারীরিক ও মানসিক কী ধরনের সমস্যা তৈরি হতে পারে, সেদিকটি নিয়ে মোটেও ভাবেন না তারা।

বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে আইন থাকা সত্ত্বেও যথাযথ প্রচারণার অভাবে তা যথাযথ কার্যকর হয়নি। তবে বর্তমানে মিডিয়ায় বাল্যবিবাহ সম্পর্কে সচেতনতামূলক প্রচারণার ফলে এ অবস্থার পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। বিবাহযোগ্য বয়সের আইনগত বাধ্যবাধকতা সম্পর্কে অভিভাবকদের অবহিত করা হচ্ছে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে। পাশাপাশি কিশোর-কিশোরীদের মধ্যেও সচেতনতা সৃষ্টি করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি দক্ষতামূলক কাজ শেখার সুযোগ করে দিলে ছেলে-মেয়েরা স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ পাবে। এ সঙ্গে কমে আসবে বাল্যবিবাহের হার। কারণ একমাত্র শিক্ষিত ও পরিণত মা’ই পারে সুস্থ শিশুর জন্ম দিতে, সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়তে। সবচেয়ে যে বিষয়টি এখন জরুরি হয়ে উঠেছে তা হলো বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে পুরুষদেরও সম্পৃক্ত করা। মেয়েদের সমস্যা শুধু মেয়েদের জানালে চলবে না। এ সম্পর্কে কিশোর, তরুণ এবং পুরুষদেরও বোঝাতে হবে, প্রয়োজনীয় তথ্য জানাতে হবে। তাহলে তারাও বিষয়টি অনুধাবন করতে পারবে।

বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ৪৫ শতাংশ শিশু-কিশোর। তার অর্ধেক কন্যাশিশু। কিন্তু নানা কারণে তারা অধিকারবঞ্চিত হচ্ছে, বিশেষ করে বাল্যবিবাহের মধ্য দিয়ে লঙ্ঘিত হচ্ছে তাদের মানবাধিকার। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে অনেক পদক্ষেপ নেয়া হলেও এখনও তা বন্ধ হয়নি পুরোপুরি। করোনার মধ্যে বাল্যবিবাহের হার আরও বেড়েছে। বাল্যবিবাহ হারের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে প্রথম সারির দেশগুলোর সঙ্গে প্রথম দিকে। শতকরা ৫২ ভাগ মেয়েকে ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই বিয়ে দেয়া হয়। অথচ বিষয়টি এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ৬টি লক্ষ্য এর সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিল। তাই দেশের বাল্যবিবাহের আগ্রাসন বন্ধ করতে না পারলে ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করার প্রচেষ্টাও বাধাগ্রস্ত হবে। বাল্যবিবাহ আমাদের সম্ভাবনাময় কিশোর-কিশোরীদের বেড়ে ওঠা, শিক্ষা জীবনের আনন্দঘন সময়Ñসবকিছু ম্লান করে দেয়। বাল্যবিবাহ বন্ধে সচেতনতার পাশাপাশি আইনের কঠোর বাস্তবায়ন করতে হবে। তা না হলে বাল্যবিয়ে নির্মূল করা সম্ভব হবে না। বাল্যবিবাহ কন্যাশিশুদের শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে, মা ও তাদের সন্তানের স্বাস্থ্যের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। অপুষ্টিসহ শারীরিকি ও মানসিকভাবে অপ্রস্তুত মায়েদের সন্তান জন্মলাভের সময় নানারকম স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখা দেয়। অনেক ক্ষেত্রে গর্ভধারণজনিত নানা সমস্যার সৃষ্টি হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সী অন্তঃসত্ত্বা নারীদের তুলনায় ১৩ থেকে ১৫ বছর বয়সী অন্তঃসত্ত্বা নারীদের মৃত্যুঝুঁকি পাঁচগুণ বেশি। বিষয়টি সম্পর্কে অভিভাবকদের সচেতন করতে হবে আরও অনেক বেশি জোরদারভাবে।

বাংলাদেশ নারী শিক্ষার প্রসার, মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য নিশ্চিতকরণসহ অনেক ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। সরকার, এনজিও, সুশীল সমাজ ও সচেতন নাগরিকদের প্রচেষ্টায় এ সাফল্য অর্জিত হয়েছে। আশা করা যায় বাল্যবিবাহ প্রতিরোধেও একদিন শতভাগ সফলতা আসবে। এজন্য আমাদের সবার মধ্যে আইন মানার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে বয়স প্রমাণে ডিজিটাল জš§নিবন্ধন সনদ প্রদর্শন বাধ্যতামূলক করা, ইউনিয়ন তথ্য সেবা কেন্দ্র থেকে বাল্যবিবাহের ক্ষতিকর প্রভাবের ওপর লিফলেট বিতরণ করলে সচেতনতা বাড়বে তৃণমূল পর্যায়ে। এছাড়া কমিউনিটি রেডিওর মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চলের কিশোর-কিশোরীদের জন্য সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান প্রচার জোরদার করার পাশাপাশি, ইউনিয়ন পর্যায়ে বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে প্রচারণা চালানো হলে ব্যাপক জনসচেতনতা তৈরি হবে। বন্ধ হবে বাল্যবিবাহ, বেঁচে থাকবে কন্যাশিশুদের স্বপ্ন, উজ্জ্বলতর হবে দেশের ভবিষ্যৎ।

পিআইডি নিবন্ধন

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০