Print Date & Time : 20 June 2025 Friday 2:33 am

বাল্যবিয়ে: কুফল ও করণীয়

মো. রুপাল মিয়া:মানুষের জীবন-মৃত্যুর মধ্যে বিবাহ বা বিয়ে প্রকৃতির একটি অলঙ্ঘনীয় বিধান। সামাজিক ও ধর্মীয় বৈধ চুক্তির মাধ্যমে দুজন প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষের মধ্যে এই বন্ধন তৈরি হয়। জৈবিক চাহিদা পূরণ ও ভবিষ্যতের বংশবিস্তার বিবাহের অন্যতম উদ্দেশ্য। এজন্য মানবজীবনে বিবাহ অতি প্রয়োজনীয়। কিন্তু অতি অল্পবয়সে বিবাহ পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের ওপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। এছাড়া অল্পবয়সে বিয়ে দেয়া শিশু নির্যাতন বা যৌন নির্যাতনের মধ্যেও পড়ে।

আমাদের দেশের অনেক অভিভাবক মনে করেন, এদেশের মেয়েরা সামাজিকভাবে সম্পূর্ণ নিরাপদ নয়। তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে অভিভাবকরা অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে থাকেন। আবার বয়স বেশি হলে মেয়েদের সৌন্দর্যহানি ঘটবে ভেবে অনেকে অল্প বয়সে বিয়ে দিতে আগ্রহী হন। ভালো কোনো সম্বন্ধ এলে তা হাতছাড়া না করার প্রবণতাও বাল্যবিয়ের অন্যতম একটি কারণ। আবার অনেকে মনে করেন, বেশি বয়স হলে বেশি যৌতুক দিতে হবে (যদিও যৌতুক আইনত দণ্ডনীয়) এমনটা ভেবেও অল্প বয়সে বিয়ে দিতে দেখা যায়। ছেলেমেয়েদের ভরণপোষণ ও লেখাপড়ার খরচ চালাতে না পারা অর্থাৎ দারিদ্র্যও বাল্যবিয়ের জন্য অনেকাংশে দায়ী। আমাদের দেশে কোনো কোনো ক্ষেত্রে অল্প বয়স্ক অনেক ছেলেমেয়েও মা-বাবার অবাধ্য হয়ে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়। 

বাল্যবিয়ে নারীর অগ্রগতিকে ব্যাহত করে। এর ফলে নারীর অগ্রযাত্রাও বাধাগ্রস্ত হয়। অল্প বয়সে বিবাহ মাতৃমৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ায়। এমনকি নবজাতকের মৃত্যুর আশঙ্কাও তৈরি করে। বাল্যবিয়ের ফলে অল্প বয়সে গর্ভবতী হওয়ার ফলে অপুষ্টিজনিত কারণে অনেক সময় নবজাতক মারাও যায়। এমনকি নবজাতক বেঁচে থাকলেও পরে এসব শিশু বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক জটিলতায় ভোগে। অপ্রাপ্ত বয়স্ক মায়ের প্রতিবন্ধী শিশু জš§দানের আশঙ্কা বেশি থাকে। অল্প বয়সে বিয়ের ফলে একটি মেয়ের পক্ষে অন্য একটি পরিবারের অনেক বিষয় সামাল দেয়া বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। এর ফলে তারা অনেক শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণার শিকার হয়ে থাকে। অনেক সময় বিবাহবিচ্ছেদের মতো ঘটনাও ঘটে। ফলে পরে এসব মেয়ের মা-বাবার ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি হয়, যা কোনো মা-বাবা কখনও কামনা করেন না। বিবাহবিচ্ছেদের ফলে মেয়ের ভবিষ্যৎ জীবনও অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।    

বাল্যবিয়ে কখনও ভালো ফল বয়ে আনতে পারে না। তাই সর্বদা নেতিবাচক ফলবাহী বাল্যবিয়ে বন্ধে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ ও আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। তবুও আমাদের দেশে বাল্যবিয়ে থেমে নেই। বাল্যবিয়ে বা শিশু বিয়ে করতে আমাদের সবার সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। বাল্যবিয়ে ব্যক্তি পর্যায়ে ক্ষতি করার সঙ্গে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনকেও ব্যাহত করে।

১৯২৯ সালে বাল্যবিয়ে বন্ধে বাল্যবিবাহ নিরোধ ‘আইন’ প্রণীত হয়। এই আইনে মেয়েদের বিয়ের বয়স ন্যূনতম ১৪ বছর এবং ছেলেদের ১৮ বছর নির্ধারণ করা হয়। ১৯৮৪ সালে এই আইনে পরিবর্তন এনে মেয়েদের বিয়ের বয়স নির্ধারণ করা হয় ১৮ বছর এবং ছেলেদের ২১ বছর। সর্বশেষ বাংলাদেশে ২০১৭ সালে ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ বিল ২০১৭’ পাস হয়। এই আইনেও মেয়েদের বিয়ের বয়স কমপক্ষে ১৮ বছর ও ছেলেদের কমপক্ষে ২১ বছর নির্ধারণ করা হয়। প্রাপ্তবয়স্ক কেউ বাল্যবিয়ে করলে তা অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে এবং এ জন্য দুই বছরের কারাদণ্ড বা এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড আরোপের বিধানও এতে রাখা হয়। অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়েদের বিয়ে দেয়া হলে এক মাসের আটকাদেশ ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় ধরনের শাস্তির যোগ্য হবে মর্মে এতে বিধান রয়েছে। বাল্যবিয়ের সঙ্গে পিতামাতা বা অন্যরা জড়িত থাকলে ছয় মাস থেকে দুই বছরের কারাদণ্ড ৫০ হাজার টাকা কারাদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার বিধান রাখা আছে, জরিমানার টাকা না দিলে আরও তিন মাসের জেল খাটার বিষয় উল্লেখ রয়েছে। বাল্যবিয়ে নিবন্ধন করলে নিবন্ধকের লাইসেন্স বাতিল হবে। যিনি বিয়ে পড়াবেন কিংবা নিবন্ধন করবেন তারাও ছয় মাস থেকে দুই বছরের কারাদণ্ড, ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। বর্তমান সরকার নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে ১০৯ নম্বরে কল বা এসএমএসের অভিযোগ গ্রহণের ব্যবস্থা রেখেছে। এর ফলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ সম্ভব হয়। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তর বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে কাজ করছে।

তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন গণযোগাযোগ অধিদপ্তর বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ ও সচেতনতা সৃষ্টিতে উঠান বৈঠক, মহিলা সমাবেশ, সিনেমা শো’র মতো বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা ও সম্প্রচার করে আসছে। সরকার মেয়েদের শিক্ষা গ্রহণকে অনুপ্রাণিত করতে শিক্ষা উপবৃত্তি চালু করেছে। এর ফলে মেয়েদের শিক্ষাক্ষেত্রে ঝরে পড়ার হার হ্রাস পাচ্ছে, যা বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।          

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালে লন্ডনে গার্লস সামিটে ২০২১ সালের মধ্যে ১৫ বছরের নিচে বাল্যবিয়ের হার শূন্যে নামিয়ে আনা ও ১৫-২১ বছরের মধ্যে সংঘটিত বাল্যবিয়ের হার এক তৃতীয়াংশে নামিয়ে আনা এবং ২০৪১ সালের মধ্যে পুরোপুরি বন্ধ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন। ২০০৭ সালে বাল্যবিয়ের হার (১৮ বছরের নিচে) ছিল ৭৪ শতাংশ। ২০১৫ সালে বাল্যবিয়ের হার (১৮ বছরের নিচে) ছিল ৫২ শতাংশে নেমে এসেছে। ২০০৭ সালে বাল্যবিয়ের হার (১৫ বছরের নিচে) ছিল ৪৭ শতাংশে নেমে এসেছে। ২০০৭ সালে বাল্যবিয়ের হার (১৫ বছরের নিচে) ছিল ৩২ শতাংশ। ২০১৭ সালে বাল্যবিয়ের হার (১৫ বছরের নিচে) ১০.৭-এ নেমে এসেছে। সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টায় বাল্যবিয়ে হ্রাসের যে প্রবণতা দৃশ্যমান হচ্ছে আশা করা যায়, ২০৪১ সালে আগেই বাংলাদেশ বাল্যবিয়েমুক্ত দেশে পরিণত হবে। 

বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন এনজিও নানা ধরনের কর্মসূচি পালন করে থাকে। এর ফলে বাংলাদেশ বাল্যবিয়ের হার হ্রাস পেলেও তা এখনও উদ্বেগজনক পর্যায়ে রয়েছে। তাই বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ পিতামাতার ভূমিকা অত্যন্ত জরুরি এবং তা সবার আগে। পিতামাতাকে মনে রাখতে হবে অল্প বয়সে বিয়ে দিলে মেয়ের শুধু সুন্দর ভবিষ্যৎই নষ্ট হয় না, মেয়েদের জীবনও মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। তাই বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে জন্মের পরপরই জন্ম নিবন্ধন করতে হবে। কারণ অনেকেই দেরিতে জন্ম নিবন্ধন করে বয়স বাড়িয়ে মেয়েদের বিয়ে দেয়। বিয়ের রেজিস্ট্রারকারীরা যেন অল্প বয়স্ক ছেলেমেয়ের বিয়ে না পড়ান, তা নিশ্চিত করতে হবে। সমাজে মেয়েরাও ছেলেদের মতো সমান ভূমিকা পালন করতে পারে। তাই অল্প বয়সে বিয়ে না দিয়ে তাদের মধ্যে এমন মনোভাব তৈরি করতে হবে। প্রতিষ্ঠিত মেয়েদের দৃষ্টান্ত ছেলেমেয়েদের কাছে বেশি করে তুলে ধরতে হবে। এতে তাদের মধ্যে সাহসের সঞ্চার হবে এবং নিজেরাও প্রতিষ্ঠিত হতে অনুপ্রাণিত হবে।

পরিবার থেকে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধসহ এ-সংক্রান্ত সচেতনতা তৈরির চর্চা করতে হবে। বাল্যবিয়ে সামাজিকভাবেই প্রতিহত করতে হবে। রাষ্ট্রীয়ভাবে সোচ্চার হতে হবে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে আমাদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা আর আন্তরিক ইচ্ছা নিশ্চয়ই দেশকে বাল্যবিয়ে মুক্ত দেশ হিসেবে গড়ে উঠতে সহায়তা করবে। প্রয়োজন শুধু আমাদের এগিয়ে আসা। 

পিআইডি নিবন্ধ