Print Date & Time : 18 June 2025 Wednesday 4:03 am

বাসযোগ্য নগর বিনির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে উদ্যান

মাছুম বিল্লাহ ভূঞা: মানুষের জীবনে সবুজায়নের একটি ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে। গাছের ছায়ার মাধ্যমে নগরায়ণের উত্তাপ কমানোর বেশ কার্যকর একটি উপায় হতে পারে। যেহেতু গাছপালার বাষ্পীভবনের মাধ্যমে শীতলীকরণের সহজাত বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তাই বড় কিংবা গুল্মাকার গাছপালা ভূ-পৃষ্ঠের তাপমাত্রা হ্রাসে টেকসই ভূমিকা রাখবে। আর গাছপালার নিচ দিয়ে যখন মানুষের চলাচল পথ থাকবে, তখন ওপরে গাছপালা আর তার নিচ দিয়ে মানুষের যাতায়াতের কাঠামোটি হবে সবুজের শামিয়ানার মতো। তবে এই সবুজায়ন দালানকোঠা দেয়ালের গায়ে বা দালানের খোপেও হতে পারে। বাসযোগ্য উদ্যান-নগর প্রতিষ্ঠায় আধুনিক বিশ্বের যাত্রা এগিয়ে চলেছে, সেখানে আমরা পিছিয়ে থাকব কেন? যার (উদ্যান-নগরের) একটি জ্বলন্ত উদাহরণ হচ্ছে সিঙ্গাপুর। তাই বলা যায়, ‘হ্যাংগিং গার্ডেন্স অব ব্যাবিলন’ থেকে ‘গার্ডেনস বাই দ্য বে’ সিঙ্গাপুর।

সিঙ্গাপুর শহরের ১০ লাখ গাছ রোপন করতে উদ্যোগ নিয়েছে এবং একই সঙ্গে আরও যুক্ত করতে চায় সবুজমণ্ডিত গণপরিসর ও ফাঁকা জায়গা। যোগ্য নেতৃত্বের সৌভাগ্যক্রমে সিঙ্গাপুর চেষ্টা করে চলেছে উদ্যান-নগর হিসেবে গড়ে উঠতে। মানুষের জীবনকে আরও আনন্দময়, প্রশান্তিময় করার লক্ষ্যে নগর সবুজায়নের দিক থেকে সিঙ্গাপুর বিশ্বের অন্যতম সবুজ শহরগুলোর একটি। পরিবেশ সুরক্ষা ও বাসযোগ্য নগর-উদ্যান তৈরির প্রাথমিকভাবে এই দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন ১৯৬৭ সালে লি কুয়ান ইউ। নগর-উদ্যান করার এই চিন্তার প্রথম স্বপ্নদ্রষ্টা লি কুয়ান ইউ ছিলেন সিঙ্গাপুরের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী।

শহরমুখী মানব সভ্যতার মাধ্যমে আধুনিক বিশ্বের যাত্রা এগিয়ে চলেছে। কিন্তু ক্রমবর্ধমান অপরিকল্পিত নগরায়ণে মানুষ শহরকে করে ফেলছে নিজেরই বিপদের কারণ। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু বিপর্যয়ে গুরুতরভাবেই শহরের দায় রয়েছে। পৃথিবীর হুমকির জন্য শহরগুলোই বেশ মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। উষ্ণায়ন/অতিমাত্রায় তাপদহন সমস্যায় পড়া একটি শহর সিঙ্গাপুর। তাই সিঙ্গাপুর সরকার স্থিতিশীলভাবে তাপমাত্রা হ্রাসের জন্য বেশ কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। উপরিক্ত সমস্যা সমাধানের পথে বিজ্ঞানের বুদ্ধি কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে দেশটি। দেশটির ২৫০ একর জায়গায় উপসাগরের তীরে একটি উদ্যান তৈরি করা হয়, নাম ‘গার্ডেনস বাই দ্য বে’ (‡ardens by the Bay), এটি একটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার বিজয়ী উদ্যান। উদ্যানের ভেতরে গাছের মতো কাঠামো ডিজাইন করা হয়েছে, যা ধরে ধরে সবুজায়ন করা হয়েছে। যদিও সিঙ্গাপুর দেশটি এখনও অন্য দেশের তুলনায় কম বাসযোগ্য নয়। 

এসফল্ট, কংক্রিট, এমনকি কাঠের ছাউনির ছাদও উদ্ভিদের চেয়ে বেশি উত্তাপ গ্রহণ করে সূর্য থেকে। যার প্রভাবে অধিকাংশ শহরগুলোতে উচ্চ তাপমাত্রার জন্য দায়ী। প্রাকৃতিক পরিবেশ উপাদানের চেয়ে শহরের রাস্তাঘাট, দালানকোঠা, অন্যান্য অবকাঠামো খুব সহজে সূর্য থেকে বিকিরণ করা তাপ শোষণ করে, আবার পরিবেশে সেই তাপ ছেড়ে দেয়। ফলে শহরের তাপমাত্রা আশপাশের এলাকার চেয়ে কয়েক ডিগ্রি ওপরে বা বেশি থাকে। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা ও অন্যান্য শহরগুলোও তার ব্যতিক্রম নয়। 

ঢাকা একটি ঘনবসতিপূর্ণ শহর। এই শহরে মাটি ও গাছের অস্তিত্ব দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে, খোলা জায়গাটি হারিয়ে যাচ্ছে। শহরের আবাসিক এবং বাণিজ্যিক ভবনগুলোতে ইস্পাত, শক্ত ধাতব শিট, ফাইবার এবং গ্লাসের দরজা এবং উইন্ডো টেকসই ইনস্টলেশন ব্যবহƒত হচ্ছে। ফলে ভূ-পৃষ্ঠের তাপমাত্রা আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে, কারণ সূর্য থেকে আসা তাপ ও আলো ধাতব এবং কাচের কাঠামোগুলোতে পড়ে এবং নির্দিষ্ট অঞ্চলের তাপমাত্রাকে কিছুটা বাড়িয়ে তোলে এবং শহরজুড়ে প্রচুর তাপ দ্বীপ তৈরি হচ্ছে।

এই শহরে গাছপালা কম থাকায় অক্সিজেনের উৎপাদন কম এবং কার্বন-ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বাড়ছে। এখানকার পরিবেশ মানুষের জন্য প্রতিকূল হয়ে উঠছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে ভূ-পৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধি নগরবাসীর জীবন অসহনীয় হওয়ার ফলে শহরটি দিন দিন বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯০০ সালের চেয়ে শহরগুলোতে বর্তমানে ১২ গুণ বেশি কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ হচ্ছে, যা শহরের তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। শহরে তাপ দ্বীপ সৃষ্টির কারণে শহরাঞ্চলের তাপমাত্রা গ্রামাঞ্চলের তুলনায় অধিক বৃদ্ধি করছে। ফলে পরিবেশের ক্ষতি হয়ে মানুষের মারাত্মক রোগ-ব্যাধি ও অকালমৃত্যু হচ্ছে।

আধুনিক বিশ্বের শহরগুলোতে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে জীবাশ্ম জ্বালানি নির্ভর যান্ত্রিক যান-বাহনের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ার ফলে জলবায়ু পরিবর্তনে উত্তাপের প্রভাব ক্রমশ মানব স্বাস্থ্যের (বিশেষ করে জীবন ও জীবিকার) ওপর জন্য মারাত্মক ঝুঁকি হয়ে উঠছে। যেহেতু জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার বৃদ্ধির কারণে পৃথিবী উত্তপ্ত হচ্ছে এবং উষ্ণায়নও বাড়ছে। সুতরাং অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে আরও বেশি করে যান্ত্রিক যানবাহন, এয়ার কন্ডিশনার, রেফ্রিজারেটর ইত্যাদির ব্যবহার বাড়বে। মানুষ যতই যান্ত্রিক বাহন নির্ভর হবে এবং এ ধরনের যান্ত্রিক গৃহস্থালি পণ্য কিনতে থাকবে, জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহারের পরিমাণও ততই বাড়বে। আর সংখ্যায় বর্ধনশীল যানবাহন ও যন্ত্রগুলো সামগ্রিকভাবে আরও বেশি উত্তাপ পরিবেশে ত্যাগ ও নিঃসরণ করবে। ফলে বৈশ্বিক জলবায়ু বিপর্যয় ক্রমেই উদ্বেগজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে। এটিকে একটি জলবায়ু দুষ্টচক্র বলা যায়।

জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৫৪ শতাংশ নগরে বসবাস করে। ১৯৫০ সালে এর হার ছিল মাত্র ৩০ শতাংশ। ভবিষ্যতে নগরমুখী মানুষের স্রোত আরও বেগবান হবে। ২০৫০ সালে পৃথিবীর প্রায় ৬৬ শতাংশ মানুষ নগরে বসবাস করবে। ততদিনে আরও অনেক শহর ও মেগা শহর গড়ে উঠবে। তাই বর্তমান নগরগুলোর উন্নয়ন ঘটাতে হবে এবং মানুষের বসবাসের উপযোগী রাখতে নগর উন্নয়নে যুগোপযোগী উদ্যোগ নিতে হবে।

আমরা সবাই জানি গাছপালা পরিবেশ উন্নয়ন ব্যাপক ইতিবাচক অবদান রাখে। গাছ পরিবেশের তাপমাত্রা বৃদ্ধিকারক কার্বন-ডাই অক্সাইড গ্রহণ করে এবং প্রাণিকুলের জন্য অক্সিজেন নিঃসরণ করে সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করে। এমন পরিস্থিতিতে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে নগর-উদ্যান তৈরি করার বিকল্প নেই।

ঢাকা শহরের খালি ছাদ প্রায় ৮০ শতাংশ স্থান দখল করেছে, যা কাজে লাগিয়ে শহরের ভূ-পৃষ্ঠের তাপমাত্রা হ্রাস করা এবং উদ্যান-নগর কার্যক্রমের আওতায় নগরের পরিবেশগত বর্তমান সমস্যা অনেকাংশে দূর করা সম্ভব হবে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, বায়ুর তাপমাত্রা বৃদ্ধিকরণ উপাদান যেমনÑপাটিকুলেট মেটার গাছের পাতায়, কাণ্ডে ও শাখায় লেগে থাকে বা পরবর্তীকালে সেচ ও বৃষ্টির পানির মাধ্যমে মাটিতে চলে যায়। যার ফলে বায়ুর তাপমাত্রা হ্রাস পায়। এছাড়া গাছপালা গ্রীষ্মের তাপশোষণ করে শহরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে, সেই সঙ্গে পরিবেশ সুশীতল ও শান্তিময় রাখে।   

এমন প্রেক্ষাপটে নগরকে পরিকল্পিত আকারে গড়ে তুলতে উদ্যান-নগর সৃজন অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে; যা শহরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। আমরা আশা করতে পারি, বাংলাদেশ সরকার বাসযোগ্য শহর বিনির্মাণে উদ্যান-নগর তৈরি করতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। রাজধানী ঢাকাও সিঙ্গাপুর শহরের মতো সত্যিকার অর্থে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বসবাসযোগ্য শহর হয়ে উঠবে।

আইনজীবী

masumbillahlaw06@mail.com