Print Date & Time : 20 June 2025 Friday 1:35 am

 ‘বাস্তবমুখী প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বেকারত্ব দূর করতে চাই’

লক্ষ্মীপুরের বাঞ্ছানগর গ্রামের আলী আকবরের ছোট মেয়ে আইরিন সুলতানা। পেশায় প্রকৌশলী। সফল নারী উদ্যোক্তা হিসেবে সুনাম কুড়িয়েছেন। নারীদের জন্য জেলা শহরে গড়ে তুলেছেন ব্যতিক্রমধর্মী প্রতিষ্ঠান আইরিন কম্পিউটার অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার। বেকারদের কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে সততাকে পুঁজি করে তার পথচলা, সফলতা ও পরিকল্পনার কথা জানাচ্ছেন জুনায়েদ আহম্মেদ

আপনার সম্পর্কে জানতে আগ্রহী

লক্ষ্মীপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পাস করে কম্পিউটারের ওপর ট্রেনিং নিই। ওখানে নারীদের আলাদা কোনো সেন্টার না থাকায় নানা সমস্যায় পড়ি। ২০১০ সালে রাজধানীর শ্যামলী আইডিয়াল পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে কম্পিউটার বিভাগে ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে সফলতার সঙ্গে পাস করি। এছাড়া লক্ষ্মীপুর যুব উন্নয়ন কারিগরি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট ও ঢাকার বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে আউটসোর্সিং, অটোক্যাড, গ্রাফিক ডিজাইন, ইলেকট্রনিকস, মাছ ও সবজি চাষ, বনায়ন, হাঁস-মুরগি পালনসহ একাধিক বিষয়ের ওপর প্রশিক্ষণ নিই। স্বামীর একান্ত সহযোগিতা আর সাহস আমাকে প্রেরণা জোগায়।

 আপনার উদ্যোগ সম্পর্কে বলুন

অর্জিত জ্ঞান কাজে লাগাতে কম্পিউটারের ওপর নারীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার স্বপ্ন দেখা শুরু করি। সে স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠা করি আইরিন কম্পিউটার অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার। ২০১১ সালে প্রকৌশলী মাহবুবের রহমানের সঙ্গে বিয়ে হয়। নারীদের উন্নয়নে স্বামীর উৎসাহ ও সরাসরি অংশগ্রহণে ট্রেনিং সেন্টারটি দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ২০১৭ সালের শুরুতে কারিগরি শিক্ষা বোর্ড থেকে ট্রেনিং সেন্টারটি ‘আইরিন টেকনিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট’ হিসেবে অনুমোদন পায়। পাঠদানের অনুমোদন পাওয়ার পর প্রথম ব্যাচে শতভাগ (৬০ পরীক্ষার্থী) পাস করে বৃহত্তর নোয়াখালীতে আলোড়ন সৃষ্টি করে।

 

বর্তমানে কী প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়?

সরকার অনুমোদিত কোর্সগুলোর মধ্যে কম্পিউটার অফিস অ্যাপ্লিকেশন, গ্রাফিক ডিজাইন অ্যান্ড মাল্টিমিডিয়া ও হার্ডওয়্যার অ্যান্ড নেটওয়ার্কিংয়ের ওপর তিন মাস থেকে ছয় মাসের কোর্স রয়েছে। ফি তিন হাজার থেকে চার হাজার টাকা। এছাড়া এখানে আউটসোর্সিং, ওয়েব ডিজাইন, অটোক্যাডসহ বিভিন্ন প্রোগ্রাম শেখার সুযোগ রয়েছে।

চাকরির পেছনে না ছুটে উদ্যোগী হলেন

চাকরির পেছনে ছুটে নানা প্রতিকূলতার সম্মুখীন হই। তাই পড়ালেখা সম্পন্ন করে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখি কর্মসংস্থানমুখী প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটিকে ব্যবসামুখী চিন্তা না করে কর্মমুখী করার চিন্তা করি আজও।

আপনার প্রতিষ্ঠানের বিশেষত্ব কী?

এখানে সরকারি কর্মকর্তাদের বিনা মূল্যে কম্পিউটারবিষয়ক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। কম্পিউটারবিষয়ক সরকারি ও স্কুল-কলেজের বিভিন্ন পরীক্ষা নেওয়া হয়। নারীদের সুবিধামতো সময়ে ট্রেনিং দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর ও ল্যাপটপের মাধ্যমে আর্থিকভাবে অসচ্ছল নারীদের বিনা খরচে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে ব্লাড ডোনেট করা হয়। গরিব ও মেধাবীদের বিনা মূল্যে প্রশিক্ষণের পাশাপাশি কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে উদ্বুদ্ধ করা হয়। ট্রেনিং সেন্টারে আগত সবাইকে গাছ লাগানোর জন্য উদ্বুদ্ধ করি। এজন্য ট্রেনিং সেন্টারের সৌন্দর্য বাড়াতে টবে ঔষধি, ফলদ ও সৌন্দর্যবর্ধক গাছ এবং বিভিন্ন প্রজাতির ক্যাকটাসসহ প্রায় ৬০ জাতের গাছ লাগানো হয়েছে। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটিতে প্রশিক্ষণার্থীদের নিরাপত্তার জন্য রয়েছে একাধিক সিসি ক্যামেরা।

প্রতিষ্ঠান গড়তে সহায়তা পেয়েছেন কোথা থেকে?

পারিবারিক ক্ষুদ্র মূলধন নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলি। লক্ষ্মীপুরের সাবেক এবং বর্তমানে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মো. জিল্লুর রহমান চৌধুরীর সহযোগিতা এবং বর্তমান জেলা প্রশাসক হোমায়রা বেগম, পুলিশ সুপার আ. স. ম. মাহতাব উদ্দিন ও সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নুরুজ্জামানের অনুপ্রেরণা প্রতিষ্ঠান প্রসারে সহায়তা করেছে।

 কোনো সমস্যা

শুরুটা ছিল অনেক ভঙ্গুর। সমাজপতি নামের সমালোচকদের সমালোচনা ও কটু কথা শুনতে হয়েছে তখন।

 সমস্যা সমাধানে কী করা যেতে পারে?

সাধারণত আমাদের মাঝে একটা সমস্যা কাজ করে, তা হলো কোনো উদ্যোগ নেওয়ার আগেই সরকারি কিংবা বেসরকারি ঋণের চিন্তা, যা পরিহার করতে হবে। সমালোচকদের সমালোচনা আর নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে গন্তব্যস্থলে পৌঁছাতে পেছনে ফেরা যাবে না।

 আপনার প্রতিষ্ঠানের সাফল্য

তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে সম্যক জ্ঞান না থাকায় নারীরা নানা বৈষম্যের শিকার। বিয়ের পর নানা প্রতিকূলতার মাঝেও আমার স্বামীর সহযোগিতায় ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠানটি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। নারীদের পাশাপাশি পুরুষদেরও প্রশিক্ষণের আওতায় আনা হয়। বিশেষ করে কর্মজীবী পুরুষরা আগ্রহী হয় বেশি। ২০১২ সালে প্রশিক্ষণার্থীর সংখ্যা ছিল ৫০, ক্রমে তা বাড়তে থাকে। ২০১৩ সালে ৮০, ২০১৪ সালে ১৮২, ২০১৫ সালে ২২৭ ও ২০১৬ সালে ২১৭ জন এখান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে বিভিন্ন স্থানে কাজ করছেন। প্রশিক্ষণ দিয়ে নারীদের স্বাবলম্বী করার চেষ্টা করি। এখানে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়সহ জেলার অনেক সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নারীদের পাশাপাশি পুরুষদেরও কর্মসংস্থান হয়েছে।

 

আগামী পাঁচ বছর পর কোন অবস্থানে যেতে চান?

আগামীতে প্রতিষ্ঠানটিকে ভোকেশনাল ইঞ্জিনিয়ার ইনস্টিটিউট হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। বাস্তবমুখী প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বেকারত্ব দূর করতে চাই। সফলভাবে উত্তীর্ণদের জন্য এখানে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে চাই।

 

নতুন উদ্যোক্তাদের উদ্দেশে

নতুন উদ্যোক্তাদের বলতে চাই, ব্যবসায় উদ্যোগ নিয়ে পিছপা হলে চলবে না। ধৈর্য, সততা ও কর্মস্পৃহার মাধ্যমে লক্ষ্যে পৌঁছাতে হবে। ব্যবসায়িক চিন্তা না করে প্রতিষ্ঠানকে জনকল্যাণমুখী করার চিন্তা করতে হবে।