দরজায় কড়া নাড়ছে বাংলা নববর্ষ ১৪২৪! নববর্ষকে বরণ করে নিতে আয়োজনের কমতি নেই। দেশের অভিজাত বিপণিবিতান থেকে শুরু করে ফুটপাথ, গ্রামের হাট-বাজার সব জায়গা বৈশাখি আয়োজনে ঠাঁসা। বাজার, খাদ্যপণ্য, ফুল, মৃৎশিল্প ও উপহারসামগ্রীতে লাগে বৈশাখি হাওয়া। গত কয়েক বছরে এ আয়োজন যত বেড়েছে, তার সঙ্গে বড় হয়েছে বৈশাখের অর্থনীতিও। কয়েক বছরের আর্থিক বিবেচনায় পয়লা বৈশাখ ঘিরে লেনদেনের সম্ভাব্য পরিমাণ প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
তবে বৈশাখের অর্থনীতি নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান নেই। ঈদ উৎসবের অর্থনীতি নিয়ে এফবিসিসিআই’র করা এক সমীক্ষার সঙ্গে বৈশাখ বাজারের তুলনা করা যেতে পারে। এফবিসিসিআই’র জরিপ অনুযায়ী ঈদে খাদ্যপণ্য, পোশাক, বিনোদন ও পরিবহন খাতে বাড়তি অর্থ যোগ হয়। ২০১৫ সালে এর পরিমাণ ছিল এক লাখ ৩৮ হাজার কোটি টাকা। তখন পোশাকের বাজারে যোগ হয় ৩৫ হাজার ২০০ কোটি টাকা ও আপ্যায়নে ২৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। যদিও আপ্যায়ন বাবদ বেশি ব্যয় হয় রমজান মাসে।
এসব বিবেচনায় ব্যবসায়ীরা বলছেন, ঈদ বিক্রির সঙ্গে তুলনা করলে বৈশাখে বিক্রির পরিমাণ দাঁড়ায় ২০ থেকে ২৫ শতাংশে। সেই হিসাবে বৈশাখে পোশাকের বাজারমূল্য ৭ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া উপহারসামগ্রী, মেলা ও আপ্যায়নে আরও তিন হাজার কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে। ঈদের মতোই বৈশাখে মোট অর্থের সবচেয়ে বেশি খরচ হয় পোশাক খাতে।
ব্যবসায়ীরা আরও বলছেন, নববর্ষ বরণ করে নিতে সারা দেশে পার্ক-উদ্যান, পাড়া-মহল্লায় ছোট-বড় নানা অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি চলে। হোটেল ও রেস্টুরেন্টে ক্রেতা বাড়ানোর জন্য নানা বৈচিত্র্যময় খাবারের আয়োজন করা হয়। গ্রামগঞ্জে চলে মেলা। দেশের অনেক জেলা শহরে শুরু হয়েছে বৈশাখি মেলা। তাছাড়া বৈশাখে পান্তা ও ইলিশের আয়োজন বাবদ প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়। এসব কর্মযজ্ঞের কারণে লেনদেন বাড়ছে, জাতীয় অর্থনীতিতে যোগ হচ্ছে প্রচুর রাজস্ব।
বাজার বড় হওয়া প্রসঙ্গে সিপিডির অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, এখন পয়লা বৈশাখের বিস্তৃতি শুধু দেশেই নয়, বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। নতুন পোশাক কেনা ও ঘোরাঘুরি উৎসব পালনের অংশে পরিণত হয়েছে। সরকারিসহ নানা পর্যায়ের পেশাজীবীরা উৎসব ভাতা পাচ্ছেন। টাকার অংকে উল্লেখযোগ্য না হলেও তা মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়াচ্ছে। সব মিলে বৈশাখের অর্থনীতি বড় হয়েছে।
বৈশাখে বাজারের প্রস্তুতি নিয়ে ঢাকা মহানগর দোকান মালিক সমিতির সাবেক সভাপতি হেলালউদ্দিন বলেন, দেশব্যাপী ছোট বড় প্রায় ২৬ লাখ দোকান রয়েছে। বৈশাখ ঘিরে এরই মধ্যে এসব দোকানে বিক্রি বেড়েছে। অর্থাৎ সামগ্রিক দোকানের এক-চতুর্থাংশের ক্রয় বিক্রয়ে বৈশাখের প্রভাব রয়েছে।
তিনি জানান, রাজধানীসহ সারা দেশে প্রায় সাড়ে ৬ হাজার বুটিক ও ফ্যাশন হাউস রয়েছে। যেখানে বৈশাখের প্রত্যক্ষ প্রভাব দেখা যায়। শুধু এসব স্থানেই বৈশাখ উপলক্ষে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার পোশাক বিক্রি হবে।
পোশাকের বাজারে দমকা হাওয়া: বৈশাখ উপলক্ষে রাজধানীর বিতানগুলোয় চলছে কেনাকাটা। এ বছর পোশাক বিক্রি গত বছরের তুলনায় ২০ শতাংশ বেড়েছে বলে জানিয়েছে ব্যবসায়ীরা। শাড়িসহ নানা ধরনের পোশাকই বিক্রি হবে এক থেকে দেড় হাজার কোটি টাকার। এর সঙ্গে চুড়ি, মালা, দুল, মাটির তৈরি পণ্য, কুটিরশিল্পসহ নানা পণ্য বিক্রির লক্ষ্যমাত্রাও ছাড়িয়ে যাবে।
ফ্যাশন হাউজের উদ্যোক্তারা জানান, তাদের ব্যবসার অর্ধেকই হয় রোজার ঈদে। এসব কাজে যত লোকের কর্মসংস্থান হচ্ছে, তা হিসাব করা হলে এ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পরিমাণ পাঁচ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে।
মিষ্টি বিক্রি হবে কয়েকগুণ: বর্ষবরণ কেন্দ্র করে দই ও মিষ্টিসহ কিছু বেকারিজাত পণ্যের বেচাকেনায়ও ধুম পড়ে। রাজধানীতে পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীরা হালখাতা করেন। সারা দেশে হয় হালখাতার আয়োজন। কালের আবর্তে সে রেওয়াজ কিছুটা প্রাণ হারালেও অনেকে মিষ্টি দিয়ে দিনটি বরণ করেন। এছাড়া পয়লা বৈশাখে বিভিন্ন করপোরেট হাউজ তাদের ক্লায়েন্টদের মিষ্টি পাঠিয়ে নতুন বছর বরণ করে নেন। বৈশাখ উপলক্ষে আমরা আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবসহ শুভাকাক্সক্ষীদের বাড়িতেও মিষ্টিজাত পণ্য নিয়ে হাজির হই।
সুইটস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, বছরের অন্যান্য দিনের চেয়ে পয়লা বৈশাখে বেশি মিষ্টি বিক্রি হয়। সহ-সভাপতি ও ভাগ্যকুল মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের মালিক মাধব চন্দ্র ঘোষ বলেন, বৈশাখ আমাদের জাতীয় উৎসব। সবাই এ উৎসব পালন করেন। বাঙালির যে কোনো উৎসবেই খাবারদাবারের প্রয়োজন পড়ে। মিষ্টির ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম নয়।
সাজসজ্জায় ব্যয়: পয়লা বৈশাখের উৎসব সফল করতে মৃৎশিল্পের বিশেষ বিশেষ সামগ্রী ঘরে রাখার রেওয়াজ রয়েছে। যুগ যুগ ধরেই এভাবে চলে আসছে। শুধু ঘরদোরই নয়, সাজবে প্রতিষ্ঠান, এমনকি রাস্তাঘাটও। বৈশাখের কয়েকদিন আগেই এসব সজ্জার জন্য মৃৎশিল্পের উপকরণ সংগ্রহ করছেন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া প্রতিবছরের মতো এবারও শুভেচ্ছা কার্ড ও বাংলা নববর্ষের ক্যালেন্ডার উপহার দিয়েছে নানা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। এতে মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসাও জমে উঠেছে। এর সঙ্গে কাগজের টুপি ও বৈশাখি বইমেলার জন্য বই ছাপিয়ে অনেক প্রতিষ্ঠান নিজস্ব অর্থনীতি চাঙা করছে। সব মিলিয়ে মুদ্রণশিল্পে আনুমানিক ১০ থেকে ১২ কোটি টাকার লেনদেন হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ফুলের বাজার ৭৫ কোটির: বৈশাখ ঘিরে দেশের বিভিন্ন স্থানে ফুল ব্যবসা চাঙা হয়। সাধারণত প্রতিদিন রাজধানীর পাইকারি বাজারে ৩০ থেকে ৩৫ লাখ টাকার ফুল কেনাবেচা হয়। বৈশাখ ঘিরে সারা দেশে প্রায় ৭৫ কোটি টাকার ফুল বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ফুল ব্যবসায়ী সমিতি। যা বিভিন্ন সজ্জাসহ সরাসরি ক্রেতাদের কাছে বিক্রি হবে।
আরও নানা আয়োজন: বাংলা বছর বরণ করে নিতে পার্ক-উদ্যান ও পাড়া-মহল্লায় ছোট-বড় নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। দেশ বিদেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা বাঙালিরা এদিন প্রাণের উৎসবে মেতে উঠবে। পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে বিভিন্ন স্থানে বৈশাখি মেলা বসবে। হস্তনির্মিত নানা পণ্যসামগ্রী ঘুরবে হাতে হাতে। শহরে চলবে বৈশাখি তাঁত-বস্ত্রের মেলা। দিবস উদ্যাপনে পার্লার ও সোনার দোকানে ভিড় বাড়বে। বিনোদনজগতেও নতুন ছবি, মিউজিক ভিডিও, বই, নাটকসহ নানা অনুষ্ঠান যোগ হবে।
পয়লা বৈশাখ ঘিরে ইলিশের চাহিদাও বাড়ে। এ সময়ে ইলিশের মূল্য জানার আগ্রহে আমাদের কমতি নেই। গত ১৫ দিন ধরে ঢাকার বাজারে এ মাছের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে, যা এখন বৈশাখ পালনের আরেক বড় ব্যয়ে পরিণত হয়েছে।
নাজমুল হুসাইন, সাংবাদিক