Print Date & Time : 30 June 2025 Monday 8:16 pm

বায়ুদূষণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে শিশুর বিকাশ

অখিল পোদ্দার: বাংলাদেশের অনেক শিশু বায়ুদূষণের কারণে প্রতি বছর বিভিন্ন রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, দূষিত বায়ুতে শ্বাস-প্রশ্বাস নিলে শিশুর মস্তিষ্কের টিস্যু ও বুদ্ধির বিকাশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, যার প্রভাব থেকে যেতে পারে সারা জীবন। বায়ুদূষণে আক্রান্ত শিশুর স্নায়ুতে প্রদাহ সৃষ্টি করে এবং শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। অল্প বয়সী শিশুরা দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়, ফলে বায়ুদূষণের কারণে শিশুরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শিশুর জন্য অপুষ্টি ও সহিংসতা যেমন মারাত্মক ক্ষতিকর, তার চেয়ে বেশি ক্ষতিকর বায়ুদূষণ।
সম্প্রতি ‘ইউনিসেফ’-এর এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বে এক বছরের কম বয়সী যত শিশু বিষাক্ত বাতাসে শ্বাস নেয়, তার তিন-চতুর্থাংশ শিশু দক্ষিণ এশিয়ায় বসবাস করে। বাংলাদেশের প্রায় এক কোটির বেশি শিশু বায়ুদূষণের শিকার। ঢাকাসহ বাংলাদেশের অন্যান্য বিভাগীয় শহরগুলোয় প্রতি বছর প্রায় ১৫ হাজার শিশুর মৃত্যু ঘটে বায়ুদূষণের ফলে। বায়ুদূষণের প্রধান কারণ মূলত মনুষ্যসৃষ্ট। ধুলা-ঝড়সহ অন্য কিছু প্রাকৃতিক কারণেও বায়ুদূষণ হয়ে থাকে। তবে তা মানুষ সৃষ্ট কারণের তুলনায় খুবই সামান্য। বায়ুদূষণ নীরব ঘাতক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। শীতকালে বায়ুদূষণের মাত্রা অনেক বেড়ে যায়। কার্বন-মনোঅক্সাইড, সিসা, সালফার-ডাই অক্সাইড, ক্লোরোফ্লোরোকার্বনের মতো ক্ষতিকর রাসায়নিক গ্যাস ও পদার্থ বায়ুতে মিশে বায়ুদূষণ কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেয়। ফলে শিশুর হাঁচি-কাশি ও শ্বাসতন্ত্রের রোগ, হাঁপানি, ফুসফুসের প্রদাহসহ জটিল রোগ দেখা দেয়। যেসব শিশুর রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, সেসব শিশু দূষণে বেশি মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে।
অতিসম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, পরিবেশ দূষণের কারণে বিশ্বের অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত দেশ বাংলাদেশ। বায়ুদূষণের কারণে প্রতি বছর প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের দূষণের কারণে ২০১৫ সালে শহরাঞ্চলে মারা গেছে প্রায় ৮০ হাজার মানুষ। এর এক-তৃতীয়াংশই শিশু। বাংলাদেশে ২০১৫ সালে মোট মৃত্যুর ২৮ শতাংশের কারণ পরিবেশ দূষণজনিত অসুখ-বিসুখ। দেশের শহরাঞ্চলে কমপক্ষে ১০ লাখ মানুষ সিসা দূষণের ঝুঁকিতে বসবাস করছে, যাদের বেশিরভাগই শিশু। এ দূষণের কারণে শিশুর মেধা ও বুদ্ধিমত্তার ক্ষতি হচ্ছে। এছাড়া গর্ভাবস্থায় শিশুমৃত্যুর হারও বাড়ছে। পরিবেশবিদদের মতে, বর্তমানে ঢাকা শহরের বায়ুদূষণ আরও বেড়েছে। বায়ুদূষণে ঢাকার অবস্থান বিশ্বে দ্বিতীয়।
রাজধানী ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভাগীয় শহরগুলোয় দূষণজনিত সমস্যা ক্রমাগতভাবে বাড়ছে। শহরগুলোয় বায়ুদূষণের প্রধান কারণগুলো হলো আশপাশের ইটভাটার দূষণ, রাস্তাঘাটের ধুলাবালি, ফিটনেসবিহীন যানবাহনের দূষণ, শিল্প-কারখানার দূষিত ধোঁয়া, সিসার দূষণ, ময়লা-আবর্জনার দূষণ, বস্তিতে ব্যাটারিসহ শিল্পবর্জ্যরে দূষণ ইত্যাদি। দূষিত বাতাসে ক্ষতিকারক গ্যাস ও ধুলার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় বাড়ছে ফুসফুস, ক্যান্সার, হƒদরোগ ও স্ট্রোকসহ নানা রোগের ঝুঁকি। গৃহস্থালি বায়ুদূষণও শিশুর জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। গ্রামাঞ্চলে রান্নাঘরে রান্নার জন্য লাকড়ি ও গোবরের ব্যবহার থেকেও দূষণ বাড়ছে।
বায়ুদূষণের কারণে শিশুর যে রোগ হতে পারে, অনেক অভিভাবক তা জানেনই না। সচেতনতার অভাবে সারাবিশ্বেই বায়ুদূষণসহ সব ধরনের দূষণ এখন জীবনের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। দূষণ থেকে শিশুসহ সবাই যদি নিরাপদ থাকতে পারে, তবে স্বাস্থ্য সুরক্ষিত থাকবে, পাশাপাশি চিকিৎসাসেবার খরচও সাশ্রয় হবে। গ্রামের চেয়ে শহরের শিশুরাই বেশি বায়ুদূষণের শিকার। শহরের বস্তি ও দরিদ্র এলাকার শিশুরা সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষণের শিকার। জীবনের শুরুতে একটি শিশু যদি দূষণের শিকার হয়, তবে তার ভবিষ্যৎ জীবন হুমকির মধ্যে পড়বে। তাই বায়ুদূষণ রোধে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার বিকল্প নেই। বায়ুদূষণের উৎসগুলো সবাইকে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলা এবং বায়ুদূষণসহ সব ধরনের দূষণের বিরুদ্ধে সচেতন থাকা উচিত।
খাদ্য, পানি আর বায়ু ছাড়া জীবজগতের অস্বিত্ব কল্পনা করা যায় না। খাবার ছাড়া আমরা কয়েকদিন বেঁচে থাকতে পারি, কিন্তু বায়ু ছাড়া আমরা সর্বোচ্চ তিন মিনিট পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারি। ফলে নির্মল বায়ু সেবন আমাদের প্রতিমুহূর্তের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন। খাবার এবং পানি আমরা অর্থমূল্যে কিনে থাকি। কিন্তু জীবনধারণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বায়ু আমরা প্রকৃতি থেকে গ্রহণ করি কোনো রকম অর্থ ছাড়াই। বাতাস থেকে আমরা যে অক্সিজেন গ্রহণ করি, তা শরীরের বিপাক ক্রিয়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আবার কার্বন-ডাইঅক্সাইড ছেড়ে দিয়ে আমরা শরীরকে দূষণমুক্ত রাখি। যে বাতাস আমরা বুক ভরে গ্রহণ করি, তা ধীরে ধীরে বিষময় হয়ে উঠছে।
বৈশ্বিক বায়ু পরিস্থিতি-২০১৮ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বায়ুদূষণের ক্রম মাত্রায় ঢাকার অবস্থান দ্বিতীয়। প্রথম স্থানে আছে ভারতের দিল্লি। গত ২৫ বছরে (১৯৯০-২০১৫) বায়ুদূষণ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ভারত ও বাংলাদেশে; যদিও চীন এ তালিকায় আগে প্রথম অবস্থানে ছিল। আমাদের ঢাকার বাতাসে সবচেয়ে ক্ষতিকর পদার্থ পিএম ২.৫-এর মাত্রা অনেক বেশি। পিএম ২.৫ হচ্ছে অতি সূক্ষ্মকণা, যা আড়াই মাইক্রোন বা তার চেয়ে কম। এক ইঞ্চি সমান ২৫ হাজার মাইক্রোন। এটা এমন সূক্ষ্মকণা, যা খালি চোখে দেখা যায় না। এ সূক্ষ্মকণা খুব সহজেই শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে ফুসফুসে প্রবেশ করে। সেখান থেকে হার্ট হয়ে রক্তের মাধ্যমে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। তারপর শ্বাসতন্ত্রের নানান রোগ যেমন হাঁচি, কাশি, শ্বাসকষ্ট থেকে শুরু করে ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিসসহ হার্ট অ্যাটাক এবং ক্যান্সারের মতো প্রাণঘাতী রোগও সৃষ্টি করতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডঐঙ) এবং আন্তর্জাতিক ক্যান্সার গবেষণা সংস্থা (ওঅজঈ) পিএম ২.৫ কণা মানবদেহের ক্যান্সার সৃষ্টিতে প্রথম সারিতে অবস্থান করছে বলে উল্লেখ করেছে। বৃদ্ধ ও শিশুদের জন্য এ কণা আরও বেশি ক্ষতিকর।
চিকিৎসা জার্নাল ল্যানসেট ২০১৬ সালের প্রতিবেদনে ১৮৮টি দেশের ২৩ বছরের (১৯৯০-২০১৩) তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখেছে, ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে মানুষ তাদের জীবনযাপন পদ্ধতি এবং আচরণগত পরিবর্তন এনে স্ট্রোক প্রতিরোধ করতে পারে। নি¤œ ও মধ্যআয়ের দেশগুলোয় বায়ুদূষণ স্ট্রোকের বড় কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে। স্ট্রোকের কারণে ৪০ বছরের কম বয়সী, যুবক এবং তরুণদের মৃত্যুহার বাড়ছে। বায়ুদূষণের এমন ভয়াবহ অবস্থাকে হালকাভাবে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
বাংলাদেশে ঢাকার পরই নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর সবচেয়ে বেশি দূষণের শিকার। সাধারণত এ শহরগুলোতেই মিল-কলকারখানা সবচেয়ে বেশি। জানুয়ারি থেকে মার্চ মাসে বায়ুদূষণ সবচেয়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করে। বিশ্বে প্রতি বছর ৫৫ লাখের বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করে বায়ুদূষণের কারণে। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলছেন, জনসচেতনতা না বাড়ালে অদূর ভবিষ্যতে ভয়াবহ বায়ুদূষণে পড়বে বাংলাদেশ। দূষিত বায়ুর কারণে ফুসফুস বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ইটভাটা থেকে নির্গত নাইট্রোজেন, সালফার-ডাইঅক্সাইড অ্যাজমা, হাঁপানি, অ্যালার্জি সমস্যা, নিউমোনিয়া ও শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ বাড়িয়ে দেয়। কার্বন-মনো-অক্সাইড রক্তের সঙ্গে মিশে অক্সিজেন পরিবহনের ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
সনাতন পদ্ধতির ইটভাটাগুলোকে জ্বালানি সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব ইটভাটায় রূপান্তর করা গেলে ৭০-৮০ শতাংশ দূষণ কমানো সম্ভব। ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন বন্ধকরণ, রাস্তা নিয়মিত পরিষ্কারকরণ, গ্রামে সাধারণ চুলার পরিবর্তে বন্ধুচুলা ব্যবহার, নির্মাণকাজ চলাকালে নিয়মিত পানি ছিটানো এবং নির্মাণসামগ্রী আচ্ছাদন দ্বারা আবৃতকরণ এবং সর্বোপরি কঠোর আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগের মাধ্যমে বায়ুদূষণ কমানো সম্ভব। এখনই বায়ুদূষণ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে প্রাণঘাতী রোগের প্রকোপ বেড়ে যাবে চরমভাবে। এতে একদিকে যেমন চিকিৎসাব্যয় বেড়ে যাবে, তেমনিভাবে অসুস্থ মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারণে উৎপাদনশীতাও ব্যাপকভাবে ব্যাহত হবে।
ছোট শিশুরা যেভাবে বায়ুদূষণের শিকার হচ্ছে, তাতে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজš§কে আমরা কোথায় ঠেলে দিচ্ছি সে বিষয়গুলো গভীরভাবে ভাবতে হবে। নীরব ঘাতক এ বায়ুদূষণের ব্যাপারে আমাদের প্রত্যেককে সচেতন হতে হবে। দূষণরোধে সরকারের সব সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। শিশুসহ সবার স্বার্থে বায়ুদূষণ রোধে সবাইকে সচেতন হতে হবে।

পিআইডি নিবন্ধ