নজরুল ইসলাম: বাজারমূল্যের চেয়ে কম মূল্যে দেয়া হয়েছে ঘাট ইজারা! আত্মসাৎ করা হয়েছে সরকারের পৌনে সাত কোটি টাকা। নৌবন্দরের তিনটি ঘাটের ইজারায় স্বজনপ্রীতি, অনিয়ম ও দুর্নীতির ঘটনা ঘটেছে। অনুসন্ধান শেষে এমন তথ্যই পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কমিশনে সভায় উঠেছিল অনুসন্ধান প্রতিবেদন। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) চেয়ারম্যান কমোডর গোলাম সাদেকসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে মামলার অনুমোদনও দিয়েছিল দুদক। ২০২২ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর মামলা দায়েরের অনুমোদন দেয়া হয়, কিন্তু সাড়ে তিন মাসেও মামলাটি দায়ের করা হয়নি।
আরিচা নদীবন্দর নিয়ন্ত্রণাধীন তিনটি ঘাটের ইজারায় সরকারের ছয় কোটি ৮০ লাখ টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে বলে দুদকের অনুসন্ধান প্রতিবেদনে জানানো হয়। এতে দণ্ডবিধির ৪০৯/১০৯ ধারাসহ ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় অপরাধ হয়েছে। মামলার অনুমোদন (দুদক, প্রধান কার্যালয়, ঢাকার নথি নম্বর- ০০.০১.২৬০০.৬০৩.০১.২৩৩.২১.) চিঠিতে স্বাক্ষর করেন উপপরিচালক মো. জাহিদ হোসেন। অনুসন্ধান কর্মকর্তা উপসহকারী পরিচালক আলিয়াজ হোসেনের মামলাটি দায়ের করার কথা।
আসামিরা হলেনÑবাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) চেয়ারম্যান কমডোর গোলাম সাদেক, বিআইডব্লিউটিএ’র সদস্য (পরিকল্পনা ও পরিচালন) দেলোয়ার হোসেন, পরিচালক (প্রশাসন ও মানবসম্পদ) মুহাম্মদ আবু জাফর হাওলাদার, পরিচালক (বন্দর ও পরিবহন বিভাগ) কাজী ওয়াকিল নওয়াজ (বর্তমানে প্রশাসন ও মানবসম্পদ), অতিরিক্ত পরিচালক (বন্দর ও পরিবহন বিভাগ) সাইফুল ইসলাম (বর্তমানে পরিচালক), যুগ্ম পরিচালক (বন্দর) জুলফা খানম, উপ-পরিচালক (ইজারা), মোস্তাফিজুর রহমান (বর্তমানে যুগ্ম পরিচালক) এবং তিন উপপরিচালক শেখ মো. সেলিম রেজা, কবির হোসেন ও মাসুদ পারভেজ। এছাড়া তিন ইজারাদার হলেন এজাজ আহমেদ সোহাগ, সায়িব আহাম্মেদ ইমন ও রফিকুল ইসলাম খান।
তাদের মধ্যে যুগ্ম সচিব দেলোয়ার হোসেন (পরিচিতি নম্বর ৫৭১৬) সম্প্রতি বদলি হয়ে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদে (বিসিএসআইআর) সদস্য (প্রশাসন) পদে যোগ দিয়েছেন। মুহাম্মদ আবু জাফর হাওলাদার ২০২২ সালের জুলাই মাসে অবসরে গেছেন। অতিরিক্ত সচিব জুলফা খানমও ২০২২ সালে অবসরে গেছেন।
অনুমোদনের পরও মামলা দায়েরে ধীরগতির বিষয়ে দুদকের সাবেক মহাপরিচালক (লিগ্যাল ও প্রসিকিউশন) মো. মঈদুল ইসলাম শেয়ার বিজকে বলেন, ‘অনেক স্তর পার করে অভিযোগ যাচাই-বাছাই হলো, অনুসন্ধানে নেয়া হলো। তখনও আইনের প্রশ্ন উঠল না। অনুসন্ধান শেষে তদারককারী, পরিচালক ও মহাপরিচালক পার হয়ে কমিশন সভায় উঠল। কমিশন সভায় মামলার অনুমোদন হলো। মামলার অনুমোদন যখন হয়ে গেল, তখনই আইনগত প্রশ্ন উঠল! আইনগত সমস্যা হলে তো অনুসন্ধান পর্যায়েই আইন অনুবিভাগে (লিগ্যাল) যাওয়ার কথা ছিল। তার মানে অনুমোদন হওয়া পর্যন্ত আইনগত সমস্যা ছিল না। এখন মাঝখানে কে এই প্রশ্ন তুলল? স্বাভাবিক হিসেবে এখন তো মামলা দায়ের হবে। তদন্তকালে কোনো সমস্যা পেলে ফাইল আইন শাখায় যেত। এখানেই অস্বাভাবিক কিছু একটা ঘটনা ঘটেছে। এর পেছনে অন্যরকম কিছু একটা কারণ থাকে। আর আইন শাখায় তো এত দিন পড়ে থাকার কারণ নেই। এটা অনুসন্ধান ও তদন্তের সিস্টেমের বাইরে গিয়ে কিছু একটা ঘটেছে। সেজন্যই হয়তো মামলাটা করতে চায় না। এটা যুক্তিসংগত নয়।’
গতকাল দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, ‘মামলাটি দায়ের হলে আমি জানতাম। এখনও দায়ের হয়নি। এর বেশি জানি না।’
মামলা দায়েরে দেরির কারণ জানতে চাইলে গতকাল দুদকের মহাপরিচালক (তদন্ত- ১) মো. রেজানুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আইন শাখায় মতামতের জন্য পাঠানো হয়েছে। মতামত পেলেই দায়ের করা হবে।’ মামলা অনুমোদনের আগে আইনগত কোনো প্রশ্ন উঠল না, অনুমোদনের পর হঠাৎ এমন কী হলোÑজানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।
দুদকের মহাপরিচালক (লিগ্যাল ও প্রসিকিউশন) মীর রুহুল আমিন বলেন, ‘আইন শাখায় এলে তো দেরি হয় না, আমরা পাঠিয়ে দিই। হয়তো অন্য কোথাও থাকতে পারে। অথবা অন্য কোনো কারণেও থাকতে পারে।’
অভিযোগের বিষয়ে জানতে কমডোর গোলাম সাদেককে গত সোমবার ও গতকাল মঙ্গলবার কল করা হলে তিনি রিসিভ করেননি। হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ দেয়া হলেও তিনি উত্তর দেননি। পরে গতকাল এ প্রতিবেদকের মোবাইল ফোন নম্বরে এসএমএস পাঠিয়ে তাকে এসএমএস দিতে বলেন। এসএমএস দেয়ার পর তিনি কোনো উত্তর দেননি।
অভিযোগের বিষয়ে দেলোয়ার হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমি কিছু জানি না।’
মুহাম্মদ আবু জাফর হাওলাদার বলেন, ‘আমার সারাজীবন ছিল সততার। আমি স্বচ্ছতার বাইরে কিছু বুঝি না। এর বাইরে কিছু হয়নি।’
কাজী ওয়াকিল নওয়াজ বলেন, ‘আমার কিছুই বলার নেই। মামলা দায়ের হলেই যা বলার বলব। এখন কিছুই জানি না।’
অভিযোগের বিষয়ে গত সোমবার সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘অফিসে আসেন। আমার মতামত দিই। কাগজপত্র দিয়ে আপনাকে দেখাব। আমি খারাপ না ভালো, ক্র্যাব সভাপতি থেকে জেনে নেবেন।’
জুলফা খানম বলেন, ‘আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। আমি ছিলাম পাঁচ মাসের মতো। আমি তো অনুমোদনও করিনি।’
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমাদের চেয়ারম্যান এটা (অভিযোগ) আবার অনুসন্ধানের জন্য দুদকের কাছে আবেদন করেছেন। বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত আমি বাস্তবায়ন করেছি।’
শেখ মো. সেলিম রেজা বলেন, ‘আমি জানি না। অফিসে কথা বলেন। অফিসের ডিউটি করি। অফিসের চাকরি করি। অফিস বিষয়টি দেখছে।’
কবির হোসেন বলেন, ‘এ বিষয়ে চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলুন। আমাদের বলা নিষেধ আছে।’
মাসুদ পারভেজ বলেন, ‘প্রধান কার্যালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ীই সব কাজ করেছি।’
অনুসন্ধান প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, সরকারি নিয়ম অনুযায়ী দরপত্রের মাধ্যমে নৌবন্দরের ইজারা দেয়া হয়। কিন্তু ২০২০-২১ এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে আরিচার নগরবাড়ী, কাজিরহাট ও নরাদহ ঘাটের ইজারায় কোনো দরপত্র আহ্বান করা হয়নি। বিআইডব্লিউটিএ’র কর্মকর্তারা পরস্পর যোগসাজশে এসব ঘাটের ইজারা কম মূল্যে দিয়েছেন। এতে সরকারের ক্ষতি হয়েছে ছয় কোটি ৮০ লাখ ৯৩ হাজার ৫৩৬ টাকা। তারা আরিচা নদীবন্দরের নিয়ন্ত্রণাধীন নব্যসৃষ্ট ‘নগরবাড়ী-কাজিরহাট-নরাদহ নদীবন্দরের’ আওতাধীন নগরবাড়ী/কাজিরহাট/নরাদহ বন্দর এলাকায় (এলএসসি) শুল্ক আদায় কেন্দ্র ঘাট পয়েন্ট ইজারা প্রদানে অনিয়ম করেছেন। তাদের বিরুদ্ধে পরস্পর যোগসাজশে অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যক্তিস্বার্থে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য ক্ষমতা অপব্যবহার করে ২০২০-২১ অর্থবছরে বাজারমূল্যের চেয়ে তিন কোটি ৬৩ লাখ ৩৪ হাজার ৬৩৪ টাকা কমে এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে বাজারমূল্যের চেয়ে তিন কোটি ১৭ লাখ ৫৮ হাজার ৯০২ টাকা কমে ইজারা দিয়ে সরকারের ছয় কোটি ৮০ লাখ ৯৩ হাজার ৫৩৬ টাকা আর্থিক ক্ষতি সাধনের অভিযোগ করা হয়েছে।
বিআইডব্লিউটিএয়ের চেয়ারম্যান গোলাম সাদেক প্রতিষ্ঠানটির প্রধান হিসেবে নিয়োজিত থেকে আমদানি-রপ্তানি/খালাস করা মালামালের পরিমাণ-সংক্রান্ত তথ্য/রেকর্ড পর্যালোচনা না করে ঘাটটির চলমান বার্ষিক ইজারা মূল্য চার কোটি ৮০ লাখ টাকা হলেও প্রাক্কলতি মূল্য নির্ধারণে গঠিত পাঁচ সদস্যের কমিটির মূল্যায়ন প্রতিবেদন ব্যতিরেকেই ২০২১-২২ অর্থবছরের দুই কোটি টাকা দরে ইজারা অনুমোদন করেন।
দুদকের অনুসন্ধানে বলা হয়, পূর্ণকালীন চুক্তিনামাধারী এ ইজারাদার না হওয়া সত্ত্বেও ঘাট পয়েন্টের জন্য ২০১১-১২ অর্থবছরে নবায়নের মাধ্যমে ইজারা দেয়া হয়, যেখানে ঘাট ইজারা দেওয়ার পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়নি।
পাবনা জেলা প্রশাসন ইজারা দিত। ২০২০ সালের অক্টোবর থেকে বিআইডব্লিউটিএয়ের নিয়ন্ত্রণে আরিচা নদীবন্দরের আওতায় ইজারা দেয়া শুরু হয়। ২০২০-২১ অর্থবছরে ইজারা দেয়ার জন্য আরিচা নদীবন্দরের উপপরিচালক এবং বন্দর ও পরিবহন কর্মকর্তা প্রাক্কলিত ইজারা মূল্য নির্ধারণ ছাড়াই ৩০ দিনের জন্য স্পট কোটেশন আহ্বান করে। এভাবে ২০২১ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ৯ বার স্পট কোটেশেনে ঘাটটির ইজারা দেয়া হয়। কোনো প্রতিযোগিতামূলক দর ছাড়াই ৯ বারই একই ব্যক্তিদের মধ্যে স্পট কোটেশনে ঘাটটির ইজারা পরিচালনা করা হয়। এজাজ আহমেদ সোহাগকে ছয়বার, সায়িব আহাম্মেদ ইমনকে দুবার ও রফিকুল ইসলাম খানকে একবার ইজারা দেয়া হয়। প্রত্যেকবারই স্পট কোটেশনের মূল্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়াই কার্যাদেশ দেয়া হয়। ২০২০-২১ অর্থবছরে স্পট কোটেশনের মাধ্যমে ২০২০ সালের ৮ অক্টোবর থেকে ২০২১ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ২৬৬ দিনে ৯ বারে মূল ইজারা মূল্য বাবদ মাত্র ৪৭ লাখ দুই হাজার টাকা ইজারা মূল্যের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট বাবদ সাত লাখ পাঁচ হাজার ৩০০ টাকা এবং পাঁচ শতাংশ আয়কর বাবদ দুই লাখ ৩৫ হাজার ১০০ টাকাসহ মোট ৫৬ লাখ ৪২ হাজার ৪০০ টাকা ইজারা মূল্য আদায় করেন।