মো. আসাদুজ্জামান নূর: বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) নির্ধারিত দামে ভোক্তা পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে না তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি)। বিইআরসি বিভিন্ন সময় মূল্য সমন্বয় করে দিলেও তা মানছেন না ডিলার ও খুচরা বিক্রেতারা। ফলে নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে এলপি গ্যাস কিনছেন সাধারণ ভোক্তারা।
তবে দাম বেশি নেয়ার বিষয়টি বিভিন্ন কৌশলে এড়িয়ে যাচ্ছেন বিক্রেতারা। তাদের ভাষ্য, তারা বেশি দাম নিচ্ছেন না। সরকারিভাবে যে দাম নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে, তা প্রাইভেট কোম্পানির জন্য নয়, ওই রেট শুধু সরকারি কোম্পানির জন্য। তবে সরকারি কোম্পানির জন্য দাম আবার নির্ধারণ করা হয়নি বলে জানালে তারা বিষয়টি এড়িয়ে যান। বেশি দামে কিনতে হচ্ছে বলে দাম কিছুটা বেশি রাখা হচ্ছে বলে দাবি করেন অনেকে।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১২ কেজির প্রতি সিলিন্ডার এলপিজি গ্যাস ভোক্তা পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ৩৫০ টাকা থেকে এক হাজার ৪০০ টাকায়। ফলে প্রতি কেজি এলপি গ্যাসের দাম পড়ছে প্রায় ১১৬ টাকা ৬৬ পয়সা। কিন্তু নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিইআরসির সর্বশেষ নির্ধারিত দাম অনুযায়ী, প্রতি কেজি এলপি গ্যাস মূসকসহ ১০৪ টাকা ৯২ পয়সা হারে এক হাজার ২৫৯ টাকায় বিক্রি হওয়ার কথা ছিল।
গত ১০ সেপ্টেম্বর বিইআরসির কার্যালয়ের শুনানি কক্ষে এলপিজির নতুন দাম ঘোষণা করেন বিইআরসি চেয়ারম্যান মো. আব্দুল জলিল। সেখানে বেসরকারি খাতে ১২ কেজির এলপিজি সিলিন্ডারের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেন তিনি। মূসকসহ প্রতি কেজি ১৮ টাকা ৮৫ পয়সা বাড়িয়ে ১০৪ টাকা ৯২ পয়সা করা হয়। অর্থাৎ ভোক্তা পর্যায়ে ১২ কেজি সিলিন্ডারের নতুন নির্ধারিত দাম হয় এক হাজার ২৫৯ টাকা। তার আগের মাসে কেজি প্রতি বোতলজাত এলপিজির দাম ছিল ৮৬ টাকা সাত পয়সা।
তবে বিইআরসির নির্ধারিত দামে এলপি গ্যাস বিক্রি করছেন না বিক্রেতারা। যাত্রাবাড়ীর ছনটেকের জ্যোতি গ্যাস ভাণ্ডার সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রতি ১২ কেজির এলপি গ্যাস সিলিন্ডার তারা এক হাজার ৩৫০ টাকায় বিক্রি করছেন। তবে বাজারের চেয়ে অতিরিক্ত দাম নেয়া হচ্ছে না বলে দাবি করেন তারা।
অন্যদিকে ১২ কেজি এলপি গ্যাস সিলিন্ডার এক হাজার ৪০০ টাকায় বিক্রি করছে রাজধানীর বংশালের মাজেদ সরদার রোডের আওয়াল এন্টারপ্রাইজ। সংশ্লিষ্টরা জানান, সাধারণ ভোক্তা পর্যায়ে তারা এক হাজার ৪০০ টাকায় গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি করছেন। চলতি মাসের শুরু থেকে তারা এ দামে তা বিক্রি করছেন।
নির্ধারিত দামের চেয়ে কেন বেশি দাম রাখা হচ্ছেÑজানতে চাইলে তারা বলেন, এটাই সরকার-নির্ধারিত দাম, গত ১ তারিখ থেকে এ দামেই বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু গত ১০ সেপ্টেম্বর বিইআরসির নির্ধারণ করে দেয়া এক হাজার ২৫৯ টাকা দামের কথা তুলে ধরলে তারা বলেন, এটা সরকারি কোম্পানির রেট, প্রাইভেট কোম্পানির জন্য নয়।
তবে অনেক ডিলার ও খুচরা বিক্রেতা মজুত রাখা সিলিন্ডার বিক্রি করছেন এক হাজার ২৫০ টাকায়। কিন্তু ১০ সেপ্টেম্বরের আগে বিইআরসি-নির্ধারিত দাম অনুযায়ীও সেটি বেশি। গত ৩১ আগস্ট বেসরকারি খাতে ১২ কেজি সিলিন্ডারের এলপিজি মূসকসহ ৯৯৩ টাকা থেকে বাড়িয়ে এক হাজার ৩৩ টাকা করা হয়। এটি সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য, যা ১ সেপ্টেম্বর থেকে কার্যকর হবে বলে জানানো হয়। কিন্তু খুচরা বিক্রেতারা সেই দামে বিক্রি না করে তা এক হাজার ২৫০ টাকায় বিক্রি করেন।
কারওয়ান বাজারের অর্ণা এন্টারপ্রাইজের প্রোপ্রাইটর মো. রবিউল ইসলাম বলেন, আমরা ১২ কেজির সিলিন্ডার এক হাজার ২৫০ টাকায় বিক্রি করছি। এটা গত মাসের রেট। গত ১০ থেকে ১২ দিন ধরে রেট আপ-ডাউন করছে। নতুন রেট পেলে আবার দাম বাড়বে।
বেশি দামে বিক্রি হওয়া প্রসঙ্গে বিইআরসির চেয়ারম্যান মো. আব্দুল জলিল বলেন, আমরা সব জায়গা থেকে শুধু শুনি দাম বেশি, দাম বেশি। কান পচে যাচ্ছে এসব শুনে। কিন্তু কেউ আমাদের কাছে লিখিত অভিযোগ করে না। লিখিত অভিযোগ না করলে আমরা তো কোনো ব্যবস্থা নিতে পারি না।
কোম্পানিগুলোকে লাইসেন্সের আওতায় আনতে পারলেও ডিলার ও খুচরা ব্যবসায়ীদের আনা যায়নি বলে জানান আব্দুল জলিল। তিনি আরও বলেন, কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে যদি কোনো ডিলার অভিযোগ করেন, তবে আমরা ব্যবস্থা নেব। কিন্তু কেউ তো অভিযোগ করেন না। ভোক্তা পর্যায়ে ভোক্তা অধিকার পরিষদে অথবা ডিসির কাছে অভিযোগ করলেও ব্যবস্থা নেয়া যায়।
নিয়ন্ত্রক সংস্থার চেয়ারম্যানের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বেঙ্গল এলপিজির হেড অব অপারেশন্স প্রকৌশলী হোসনি মোবারক বলেন, বিইআরসির বেঁধে দেয়া দামে কোনো কোম্পানি সিলিন্ডার বিক্রি করতে পারবে না। সৌদি গ্যাস সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান আরামকোর সঙ্গে হিসাব করে দাম নির্ধারণ করে বিইআরসি, কিন্তু আমরা যখন আরামকো থেকে গ্যাস কিনি, তখন এর সঙ্গে একটা প্রিমিয়াম অ্যাড হয়। এ প্রিমিয়াম তো বিইআরসি আমলে নেয় না।
এদিকে ব্যবসার শুরুতে আমরা যে সিলিন্ডার ৮০০ টাকায় দিই, সেই বোতলে আমাদের খরচ হয় তিন হাজার টাকা। শুরুতেই আমাদের ভর্তুকি দিয়ে ব্যবসায় নামতে হয়। এ খরচ আমরা তুলব কোথা থেকে?
হোসনি মোবারক আরও বলেন, কোম্পানির বিক্রি করা দামের ৮০ শতাংশ হয় ল্যান্ডিং ভ্যালু আর বাকি ২০ শতাংশ দিয়ে অপারেশনাল কস্ট, কর্মচারীদের বেতন ও ব্যাংকঋণ শোধ করা হয়। এত টাকা বিনিয়োগ করে কেউ তো লসে ব্যবসা করবে না।
আমদানির ব্যাপারে তিনি আরও বলেন, একমাত্র মোংলা পোর্ট দিয়ে আমরা এলপিজি আমদানি করে থাকি। এ বন্দর দিয়ে একবারে সর্বোচ্চ তিন হাজার ৫০০ টন পর্যন্ত আমদানি করতে পারি। প্রতি চালানে যদি ১০ হাজার টন আমদানি করতে পারতাম তবে দাম কম হতো নিশ্চিত, কিন্তু আমরা তা পারছি না।
উল্লেখ্য, গত বছর ডিসেম্বরে বিইআরসিতে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করে এলপিজি সরবরাহকারী কোম্পানিগুলো। তাদের প্রস্তাব মূল্যায়ন করে বিইআরসি গঠিত কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি। এরপর চলতি বছর গত ১৪ জানুয়ারি প্রথম এলপিজির দাম নির্ধারণ নিয়ে গণশুনানি করে বিইআরসি। এরপর ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে আরও দুই দফায় গণশুনানি করে দাম নির্ধারণ করা হয়।