Print Date & Time : 26 June 2025 Thursday 9:23 pm

বিএনপির ‘ইন্দো প্যাসিফিক স্ট্রাটেজি’!

মো:নিজাম উদ্দিন

এক.

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যত এবং ইন্দো প্যাসিফিক কৌশল শীর্ষক একটি সেমিনার করেছে বিএনপি। এই সেমিনারের মূল বক্তব্য ছিল ইন্দো প্যাসিফিক রিজিওনকে কেন্দ্র করে বিএনপির রাজনীতি,কৌশল এবং পলিসি কেমন হবে-তার একটি রুপরেপা। ভবিষ্যত পরিকল্পনাও বলা যেতে পারে। সেমিনারের লিখিত বক্তব্যটি পড়ে মনে হলো বিএনপি তার পররাষ্ট্রনীতির খুব গুরুত্বপূর্ণ অংশটি বেশ খোলামেলা ভাবেই প্রকাশ করেছে। তামাম দুনিয়ার রাজনীতি যখন ভারত মহাসাগর এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলকে কেন্দ্র করে অর্থাৎ ইন্দো প্যাসিফিক রিজিওনকে কেন্দ্র করে উত্তপ্ত হচ্ছে এমন সময়ে বিএনপির এই অঞ্চল কেন্দ্রীক দলীয় বক্তব্য থাকা এই সময়ে একটি স্মার্ট পলিটিক্স ই বটে। সেটা অবশ্য প্রয়োজনও ছিল। বেশ কিছু দিন পূর্বে আওয়ামী লীগ সরকারও একটি ইন্দো প্যাসিফিক আউটলুক ঘোষণা দিয়েছিল। তারা আমেরিকাকে একটি কৌশল পত্র ঘোষণার মাধ্যমে বোঝাতে চেয়েছিলেন যে -আমরা চীনের খুব ক্লোজড হচ্ছি না! কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের ইন্দো প্যাসিফিক আউটলুক ঘোষণার পরেই দেখা গেল আমেরিকার স্যাংশন ঘোষণা হয়! সুতরাং সরকারের ইন্দো প্যাসিফিক পলিটিক্স যে পশ্চিমাদের আশ্বস্ত করতে পারে নাই এটা স্পষ্ট। এই অবস্থায় এ অঞ্চলের রাজনীতি নিয়ে বিএনপির কৌশল কী? ইন্দো প্যাসিফিক রিজিওনে যেহেতু বাংলাদেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক স্টেইক হোল্ডার-সেটা ঘোষণা দেওয়া, স্পষ্ট করা খুব জরুরী ছিলো। সেই কাজটিই মূলত বিএনপি করেছে।

দুই.

আন্তর্জাতিক রাজনীতির এক উত্তপ্ত মাঠ হয়ে উঠেছে এখন ভারত মহাসাগর এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল, খুব সহজ করে বললে এই অঞ্চলকেই মূলত ইন্দো প্যাসিফিক রিজিওন বলা হয়ে থাকে। আন্তর্জাতিক রাজনীতির গতিপথ পালটে দিচ্ছে এখন জিওপলিটিক্স বা ভূরাজনীতি। অর্থাৎ কোন রাষ্ট্রের ভৌগোলিক অবস্থান কোথায় এবং কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা কখনও সামরিক,অর্থনৈতিক এবং প্রযুক্তিগত সক্ষমতাকেও ছাড়িয়ে যায়। ভৌগোলিক ভাবে কোন রাষ্ট্রের অবস্থান কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় সেই বিষয়টি বিবেচনা রেখেই আবর্তিত হচ্ছে আজকের দুনিয়ার আন্তর্জাতিক রাজনীতির গতিপথ। যা ভূরাজনৈতিক নামে পরিচিত। ইন্দো প্যাসিফিক রিজিওনের প্রতিটি রাষ্ট্রই এখন একের পর এক ইন্দো প্যাসিফিক স্ট্রাটেজি প্রকাশ করছে। পশ্চিমা ব্লক বিএনপি কিংবা বিরোধী রাজনৈতিক দল গুলোর ব্যাপারে আগ্রহের একটা বড় কারণও কিন্তু বিএনপির গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার প্রতি কমিটমেন্ট। চায়নিজ মডেলের শাসনব্যবস্থা এ অঞ্চলের গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের জন্য হুমকি। বাংলাদেশে গণতন্ত্র না থাকায় চীন এটাকেও একটা সুযোগ হিসাবে দেখছে। বাংলাদেশ ভূরাজনৈতিক ভাবে ইন্দো প্যাসিফিক রিজিওনকে নিয়ন্ত্রণ করার একটা গুরুত্বপূর্ণ স্পট হওয়ায় বিরোধী রাজনৈতিক দল গুলোর পশ্চিমা ব্লকের গণতন্ত্রের প্রতি কমিটমেন্টের সম্পর্ককে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাচ্ছে। ভবিষ্যতে এ অঞ্চলের রাজনৈতিক অবস্থান কী হবে কার সাথে বিএনপি তাই স্পষ্ট করেছে।

বিএনপির লিখিত বক্তব্য বার বার পশ্চিমা ব্লকের রাষ্ট্র গুলোর ব্যাপারেই আগ্রহের কথা উঠে এসেছে। চীনের বিষয়ে বেশ সর্তক বক্তব্য দেওয়া হয়েছে।সুতরাং বিএনপির রাজনীতিতে তার দলীয় পররাষ্ট্রনীতির যে একটা বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়েছে এটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বাংলাদেশের গণতন্ত্র,মানবাধিকার, ভোটের অধিকার, আইনের শাসন ও মুক্ত বাজার অর্থনীতির, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতার নিশ্চয়তার জন্যই চায়না মডেলের শাসনব্যবস্থা থেকে দূরে থাকাটা প্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে।

মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ.গানি.স্তান থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার করার পর থেকে আমেরিকা মূলত চীনকে তার এক নাম্বার প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতে শুরু করে। জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ক্যাম্পেইনেও প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে পারলে তিনি যে চীনের দিকে নজর দিবেন সেটা স্পষ্ট করে ছিলেন।তাই হচ্ছে। চীন ইন্দো প্যাসিফিক রিজিওনের একটি রাষ্ট্র হওয়ায় এ অঞ্চলের রাজনীতি নিয়ে আমেরিকার আগ্রহ স্বাভাবিক ভাবেই বেশি। আগামী দিনে আমেরিকার প্রতিদ্বন্দ্বী যে চীন!

তিন.

আমেরিকা,চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া,অস্ট্রেলিয়া, ভারত এবং বাংলাদেশ সহ ডজন খানেক রাষ্ট্র এই ইন্দো প্যাসিফিক রিজিওনে অবস্থিত। এ অঞ্চলে পারমাণবিক শক্তিশালী রাষ্ট্র যেমন রয়েছে, তেমনি অর্থনৈতিক ভাবে শক্তিশালী রাষ্ট্রও আছে, আছে উন্নয়নের দিকে ধাবমান রাষ্ট্র, আছে গণতন্ত্র ও সুশাসন নিয়ে হাহাকার করা মিছিলের রাষ্ট্রও। এই অঞ্চলের আধিপত্য নিয়ে আমেরিকা,চীন, ভারতের যে ত্রিমুখী প্রতিযোগিতা সেখানে বাংলাদেশের অবস্থান কী হবে, কোন দিকে থাকবে, সেগুলোই বিএনপি সেমিনারে স্পষ্ট করেছে।একটি দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দল হিসাবে কিংবা বিএনপি ক্ষমতায় গেলে ইন্দো প্যাসিফিক রিজিওনকে বিএনপি কোন দৃষ্টিতে দেখতে চায় তা বিএনপি স্পষ্ট করেছে। বিএনপি বার বার জনগণের ইচ্ছের বিষয়টি গুরুত্ব দিচ্ছে। জনগণ নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের মাধ্যমে যা চায় তাই হবে। এ অঞ্চলে প্রতিটি রাষ্ট্রেই ভোটের মাধ্যমে একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ জরুরী।

বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান ইন্দো প্যাসিফিক রিজিওনে আমেরিকা, চীন এবং ভারত সবার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ।ইন্দো প্যাসিফিক রিজিওনে চীনকে চাপে রাখতে আমেরিকা এবং ভারতের জন্য বাংলাদেশকে লাগবেই।সুতরাং বাংলাদেশে জনগণের সরকার থাকলে এখন দারুণ রাজনীতি করতে পারতো। যা জনগণের মেন্ডেটবিহীন সরকার পারছে না।বাংলাদেশের গুরুত্ব আমেরিকা,চীন এবং ভারতের কাছে বেড়ে যাওয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ বাংলাদেশ ভৌগোলিক ভাবে এমন একটি জায়গায় অবস্থিত যে জায়গাটি ইন্দো প্যাসিফিক রিজিওনটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে সুপার পাওয়ার রাষ্ট্র গুলোর খুব বেশি প্রয়োজন।

চীনকে মোকাবিলার জন্য পশ্চিমা ব্লকের নেতৃত্বে ইন্দো প্যাসিফিক রিজিওনে কোয়াড এবং অকাস নামে দুটি জোট হয়েছে।আগ্রহ বাড়ছে বাংলাদেশ নিয়ে।তো বাংলাদেশ কী ভাবছে?বিশেষ করে বিএনপির নেতৃত্বে বিরোধী দল গুলো?
বিএনপিও বক্তব্য স্পষ্ট করেছে। তারা তাদের সাথেই যাদের গণতন্ত্র মানবাধিকার এবং আইনের শাসনের প্রতি কমিটমেন্ট আছে।

▪️লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক