নিজস্ব প্রতিবেদক: বিএনপি রাজনীতিতে ‘অনেক ভুল’ করেছে বলে মনে করেন দলটির ভাইস চেয়ারম্যান হাফিজ উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেছেন, ‘দলের প্রধানের মতের বাইরে এখানে কিছু বলা যায় না। ‘ইয়েস স্যার, রাইট স্যার’ ছাড়া আর কোনো কিছুই জানেন না।’
‘ভুল থেকে বের হয়ে আসতে’ সংস্কারের তাগিদও দিয়েছেন তিনি। ২০১৪ সালের নির্বাচনে না যাওয়া ‘ভুল ছিল’ মনে করা এই নেতা বলেছেন, তিনি চান বিএনপি এবার ভোটে আসুক। এই মুহূর্তে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে ‘জোর না দিয়ে’ আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতায় বিএনপির ভোটে আসাতেই জোর দেয়া উচিত বলেও মনে করেন তিনি। আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে হাফিজ উদ্দিনের নেতৃত্বে নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের বিষয়ে তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেটিও উড়িয়ে দিয়েছেন সাবেক মন্ত্রী।
তথ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের পর নানা জল্পনা-কল্পনার মধ্যে গতকাল বুধবার ঢাকার বনানীর বাসায় সাংবাদিকদের ডেকে হাফিজ উদ্দিন বলেন, নতুন দল গড়ার যে কথা বাজারে আছে, তা ‘সঠিক নয়’। তার শরীর ভালো নয়, দেশের বাইরে চলে যাবেন। তবে বিএনপি থেকেই তিনি অবসরে যেতে চান।
হাফিজ উদ্দিন আহমেদ প্রথমেই তোলেন ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচন বর্জনের প্রসঙ্গ। তিনি বলেন, “২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ করা ‘উচিত ছিল’।” কেন এমনটি মনে করেন সেই ‘ব্যাখ্যায়’ তিনি বলেন, ‘সে সময় আওয়ামী লীগ লেজেগোবরে ছিল, প্রধানমন্ত্রী আমাদের নেত্রীকে আহ্বান করেছিলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ অন্যান্য মন্ত্রণালয় দেয়ার জন্য। কখন তারা এরকম আহ্বান জানায়? যখন লেজেগোবরে অবস্থা। এখন কী জানায়? আমরা সেই অবস্থার ফায়দা নিতে পারিনি। তার পরে যে রাজপথ অনুসরণ করেছি, সেই যে রাজপথে গিয়েছি, এখনও রাজপথে আছি।’
হাফিজ বলেন, ‘জিয়াউর রহমানের আদর্শ থেকে দূরে সরে যাওয়ার ফলে বিএনপি ক্ষমতার বাইরে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। অনেকগুলো ভুল আমরা করেছি। সেই ভুল ডিসকাস করার ফোরাম এটা নয়। প্রকাশ্যে এটা বলা উচিত নয়। কিন্তু আমার তো কোনো ফোরাম নেই, দলে কোনো অবস্থা নেই। গত আট বছর দলের কোনো কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়নি। নেতা নির্বাচন করার সুযোগ নাই, প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে রাজনীতি করার সুযোগ নেই, বক্তব্য রাখারও সুযোগ নেই। তিন বছর আগে আমি এই ছাদের ওপরে সংবাদ সম্মেলনে একটা কথা বলেছিলাম যে, আমার যথেষ্ট বয়স হয়েছে। আমি মুখ ও বধির স্কুলের ছাত্র নই। সুতরাং একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কিছু কিছু কথা বলতেই হয় জাতির স্বার্থে। আমার কাছে দেশ সবার ওপরে।’
খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান, দুজনই তার নেতা এবং দুজনকেই ‘সম্মান করেন’ জানিয়ে বিএনপি নেতা বলেন, ‘কিছু ভুল-ত্রুটি ধরিয়ে দেয়া দরকার। আওয়ামী লীগেরটা জানি না, কখনও আওয়ামী লীগ করিনি, বিএনপিতে সত্যি কথা বলার মতো কোনো লোক, বিশেষ করে চেয়ারপারসনের সামনে সত্যি কথা বলার মতো লোক আমার চোখে পড়েনি। অনেক আগে সাইফুর রহমান সাহেব বলতেন। তিনি একজন ত্যাগী নেতা। তাকে দু-চারবার সত্যি কথা বলতে দেখেছি। এছাড়া সবাই ইয়েস স্যার, রাইট স্যার ছাড়া আর কোনো কিছুই জানেন না; এটা হলো বাস্তবতা।’
তিনি বলেন, ‘এখন যেভাবে চলে সেভাবে কোনো রাজনৈতিক দল চলতে পারে না। রাজনৈতিক দলের কাউন্সিল কেন্দ্রীয় কমিটি করবে, কেন্দ্রীয় কমিটি জেলা কমিটি করবে, জেলা কমিটি উপজেলা কমিটি করবে, উপজেলা কমিটি ইউনিয়ন কমিটি করবে, ইউনিয়ন কমিটি ওয়ার্ড কমিটি করবেÑসারা পৃথিবীতে এ রকম সিস্টেম।’
এ রকম ব্যবস্থা জিয়ার সময়ে ছিল বলে জানিয়ে সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা কেন সেই পথ থেকে বিচ্যুত হলাম, কেন দলে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলো, কেন কমিটি বাণিজ্য হচ্ছে, কেন ত্যাগী নেতারা নির্বাসিত? খুলনার নজরুল ইসলাম মঞ্জু, সিলেটের আরিফুল হক চৌধুরী, বরিশালের মজিবুর রহমান সরওয়ারÑতারা তো ত্যাগী নেতা। ভুল-ত্রুটি থাকতেই পারে। আমি জনাব তারেক রহমানকে বলব, এই দলে সবাই আপনার অনুসারী, আপনি সবার শ্রদ্ধার পাত্র।’
২০১৪ সালের মতো ‘ভুল’ আর দেখতে চান না হাফিজ উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি বিএনপির এই নির্বাচনে যাওয়া উচিত। বিএনপিতে অসংখ্য ত্যাগী নেতা-কর্মী রয়েছে, তারা প্রাণপণ চেষ্টা করেছে কিন্তু বাস্তবতার কারণে সেটি সম্ভব হয়নি।’
এই মুহূর্তে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর জোর না দিয়ে বিএনপির এখন ‘বিকল্প সমাধান’ খোঁজা উচিত বলে মনে করেন হাফিজ। বিএনপি নেতা অবশ্য এও মনে করেন যে, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে তা সুষ্ঠু হওয়ার ‘সুযোগ নেই’। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে হবে না, বিএনপি ক্ষমতায় গেলে তাদের অধীনেও হবে না।’ বিকল্প কী হতে পারে, তাও জানিয়েছেন বিএনপি নেতা। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি আগামী নির্বাচনে বিএনপি যদি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যস্থতায়… সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে, গণতন্ত্রের স্বার্থে আন্তর্জাতিক শক্তিসমূহের মধ্যস্থতা পেলে বিএনপির নির্বাচনে যাওয়া উচিত।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিএনপিকে অনুরোধ জানাই, কীভাবে সমঝোতার রাজনীতির মাধ্যমে আমরা একটা সুষ্ঠু নির্বাচন পেতে পারি। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে অনুরোধ জানাব, আপনারা মধ্যস্থতা করুন। … জাতিসংঘ অনেক দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করে থাকে। আমরা জাতিসংঘের তদারকিতে সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে চাই। নইলে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না।’
