Print Date & Time : 18 June 2025 Wednesday 10:10 pm

বিএম কনটেইনার ডিপোয় বিস্ফোরণ বিপুল ক্ষয়ক্ষতির দায় কার?

নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম: চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে শিল্প গ্রুপ স্মার্ট গ্রুপের মালিকানাধীন বিএম কনটেইনার ডিপোয় রাসায়নিক পদার্থ রাখার কোনো ধরনের অনুমোদন ছিল না। আর আগুনের সঙ্গে রাসায়নিক পদার্থের সংস্পর্শে বিস্ফোরণের ঘটনায় ৪১ জন নিহত এবং দুই শতাধিক আহত হয়। আর ৪২ ঘণ্টায় নিয়ন্ত্রণে আসেনি আগুন। এ ঘটনার পর থেকে প্রায় ৪৮ ঘণ্টা ধরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌ-বিমান, ফায়ার সার্ভিসসহ সংশ্লিষ্টরা উদ্ধার ও সেবা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এতে হাজার কোটি টাকার রপ্তানির পণ্য, যন্ত্রপাতিসহ পরিবেশের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। কিন্তু ঘটনার সূত্রপাত অজানা।

জানা যায়, ২০১১ সালে চট্টগ্রামভিত্তিক শিল্প গ্রুপ স্মার্ট গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান বিএম কনটেইনার ডিপো লিমিটেড একটি অভ্যন্তরীণ কনটেইনার ডিপো (আইসিডি) হিসেবে কার্যক্রম শুরু করে। প্রতিষ্ঠানটির ডাচ নাগরিক বার্ট প্রঙ্ক কোম্পানিটির চেয়ারম্যান এবং চট্টগ্রামের বাঁশখালীর ব্যবসায়ী মোস্তাফিজুর রহমান কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। গত ১১ বছর প্রতিষ্ঠানটি রপ্তানি ও আমদানি কনটেইনারাইজড কার্গো থেকে পণ্য খালাস ও বোঝাইয়ের (স্টাফিং/আনস্টাফিং) কাজ করছে। সীতাকুণ্ডের সোনাইছড়ি ইউনিয়নে শীতলপুর এলাকায় প্রায় ৩০ একর জমিতে গড়ে ওঠা বিএম কনটেইনার ডিপোতে ৫০০ মিটারের একটি টিনশেডের ভেতর ৩৩টি রাসায়নিক কনটেইনারের রপ্তানির জন্য মজুত ছিল বিপুল পরিমাণ ‘হাইড্রোজেন পার অক্সাইড’ নামের দাহ্য রাসায়নিক। এ ধরনের রাসায়নিক পদার্থ রাখার জন্য বিস্ফোরক অধিদপ্তরের অনুমতি লাগে। পাশাপাশি ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কর্তৃপক্ষকে অবহিত করতে হয়, যা ডিপো কর্তৃপক্ষ করেনি। এছাড়া রপ্তানির জন্য কাপড়, হিমায়িত খাবার, ফলসহ বিভিন্ন ধরনের আমদানি করা পণ্যও এ ডিপোতে রাখা আছে। শনিবার রাতে আগুন লাগার পর রাত ১১টা থেকে থেমে থেমে কয়েক দফা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এ ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৪১ জন নিহত ও দুই শতাধিক আহত হয়েছেন। এ সময় হাইড্রোজেন পার অক্সাইড বাইরে ছড়িয়ে যায়। গত রোববার সকাল থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা এসব রাসায়নিক যাতে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে না পড়ে, সেই লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছেন। গতকাল দুপুর সোয়া ১২টায় বিএম ডিপোর গেটে ২৪ ব্রিগেড ১৮ বি-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফুল ইসলাম হিমেল ব্রিফিংকালে বলেন, ডিপোতে থাকা ৪টি কনটেইনারে রাসায়নিক পদার্থ থাকার বিষয়টি আমরা নিশ্চিত হয়েছি। এ কনটেইনারগুলো ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা বিশেষ পদ্ধতিতে অপসারণ করার চেষ্টা করছে। তাছাড়া ডিপোর ভেতরে এখনও কালো ধোঁয়া থাকায় সেনাবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা আগুন সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করতে কাজ করে যাচ্ছে। 

কাস্টমস, বন্দর, ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার, শিপিং এজেন্ট প্রতিনিধি ও সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিএম ডিপোর ইয়ার্ডে থাকা ৩৩টি রাসায়নিক কনটেইনারের মধ্যে ২০টি শিপিং কোম্পানি ‘মায়ের্কস লাইনের’। বাকি ১৩টি ‘ওয়ান লাইনের’। মূলত ভিয়েতনামের এই রাসায়নিক পদার্থ নিতে না চাওয়ায় শিপিং কোম্পানি মায়ের্কস লাইন জাহাজের বুকিং বাতিল করে। ফলে ৩৩টি কনটেইনারভর্তি ৮৫০ টন রাসায়নিক বন্দরে না গিয়ে ডিপোর ইয়ার্ডে পড়ে ছিল। আর এসব পণ্যের রপ্তানিকারক আল-রাজি কেমিকেল কমপ্লেক্সের পক্ষে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট সেগুলো বিএম কনটেইনার ডিপো থেকে পুনরায় নিজেদের কারখানায় ফেরত নেয়নি। কারণ রপ্তানির জন্য আনা পণ্য একবার ডিপোতে ঢুকলে তা ফেরত নিতে কাস্টমসের অনুমতির প্রয়োজন। সেই অনুমতি পাওয়ার আগেই ভয়াবহ বিস্ফোরণ এবং বিপুল প্রাণহানির ঘটনা ঘটল। এক্ষেত্রে পণ্য ডিপোতে এনে ফেলে রাখার সুযোগ নেই। বড়জোর এক দিনে কাস্টম প্রক্রিয়া শেষ করে ডিপো থেকে পণ্য বন্দরে নেয়া হয়। এখানে নিশ্চিত উদাসীনতা আছে। অপরদিকে বিকডার তথ্য অনুযায়ী, রপ্তানির জন্য ৮০০ টিইইউ’স (২০ ফুট দীর্ঘ কনটেইনার) বোঝাই তৈরি পোশাক এবং হিমায়িত খাদ্যপণ্য ছিল। আমদানিকৃত পণ্যবোঝাই কনটেইনার ছিল ৫০০টি এবং খালি কনটেইনার ছিল ৩ হাজার। সবমিলিয়ে চার হাজার ৩০০ কনটেইনার ছিল।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বিস্ফোরক অধিদপ্তরের পরিদর্শক তোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘ডিপোতে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড বা যেকোনো রাসায়নিক মজুতের জন্য লাইসেন্স কিংবা কোনো ধরনের অনুমতি নেয়নি ডিপো কর্তৃপক্ষ। এমনকি এ বিষয়ে পরিদপ্তরকে কোনো কিছু জানানোও হয়নি। কোনো ধরনের অনুমোদন ছাড়াই ডিপোতে রাসায়নিক মজুত করেছিল।’

এ ঘটনার পরে রোববার সকালে ছুটে আসেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, মালিকপক্ষের কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। পাওয়া গেলে তাদের কাছ থেকে জানা যেত কোন কনটেইনারে কেমিকেল আছে। সেগুলো আলাদা করা গেলে আগুন সহজে নিয়ন্ত্রণে আসত। 

এদিকে গতকাল বেলা পৌনে ৩টার দিকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে দগ্ধ রোগীদের দেখতে এসে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, সীতাকুণ্ডে বিস্ফোরণের ঘটনায় তদন্ত গাফিলতির প্রমাণ পাওয়া গেলে সে যতই শক্তিশালী হোক, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। অবহেলা বা দায় থাকলে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।

গতকাল বিকাল ৪টার দিকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আহতদের দেখতে এসে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে স্মার্ট গ্রুপের পরিচালক আজিজুর রহমান বলেন, ‘ডিপোতে আট থেকে ৯০০ কনটেইনার ছিল। কোনোটাই বিস্ফোরিত হয়নি। একটা কনটেইনারে কেন বিস্ফোরণ ঘটেছে। এখানে নাশকতার বিষয়টি স্পষ্ট।’ এ সময় তিনি আরও বলেন, আমাদের ডিপো থেকে কোনো কনটেইনার বের করতে কিংবা প্রবেশ করাতে কাস্টমসের অনুমতি নিতে হয়। এখানে বিপজ্জনক রাসায়নিক পদার্থ থাকলে, তা কাস্টমস কর্মকর্তাদের জানার কথা।