মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ: প্রাইমারি মার্কেটে আইপিও আবেদনকারীদের প্রতিযোগিতা বেড়েছে। আইপিও শিকারিদের দৌরাত্ম্য সেই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের কোটা মিটিয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আইপিও বিজয়ী হওয়া মুশকিল হয়ে পড়েছে। যার জের ধরে কমে গেছে বিও অ্যাকাউন্ট খোলার প্রবণতা।
গত চার মাসে এ ধরনের অ্যাকাউন্ট খোলার সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে কয়েকগুণ। ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে শেয়ার সংরক্ষণকারী কোম্পানি সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিডিবিএল) সূত্রে এ তথ্য জানা যায়।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, এপ্রিল শেষে বিও অ্যাকাউন্টের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৭ লাখ ৮১ হাজার ৭৩৬টি। মার্চের শেষে বিও হিসাব সংখ্যা ছিল ২৭ লাখ ৭৭ হাজার ৩৩৪টি। অর্থাৎ এই সময়ের মধ্যে বিও বেড়েছে চার হাজারের কিছু বেশি। অন্যদিকে জানুয়ারি শেষে মোট বিও হিসাব খোলা হয় ২৬ হাজার।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে মন্দা বিরাজ করছে পুঁজিবাজারে। সূচকের পতনে সেকেন্ডারি মার্কেটের সার্বিক পরিস্থিতি নাজুক। পাশাপাশি প্রাইমারিতে মার্কেট থেকেও সুবিধা করতে পারছেন না বিনিয়োগকারীরা। এ কারণে পুঁজিবাজারের প্রতি আগ্রহ কমে গেছে আগ্রহী সাধারণ বিনিয়োগকারীদের, যার প্রভাব পড়ছে নতুন বিও হিসাব খোলায়।
অন্যদিকে বিও হ্রাস পাওয়ার প্রধান কারণ হিসেবে আইপিও শিকারি ও কোটাকে দায়ী করছেন বাজারসংশ্লিষ্টরা। পুঁজিবাজারে এমন লোক রয়েছে যারা নামে-বেনামে শত শত অ্যাকাউন্ট পরিচালনা করেন। এরপর ২০ শতাংশ শেয়ার বরাদ্দ থাকে ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের জন্য। যে কারণে এসব বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারেন না সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। অন্যদিকে প্রবাসীর নামে ভুয়া অ্যাকাউন্ট খুলে আবেদন করছেন অসংখ্য লোক। যে কারণে নতুন বিও খোলার আগ্রহ কমে গেছে।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, গত মাসে আগের মাসের চেয়ে বিও অ্যাকাউন্ট খোলার হার কমেছে ৯ হাজারের বেশি। মার্চে মোট বিও হিসাব বাড়ে ১৩ হাজার। ফেব্রুয়ারিতে সিকিউরিটিজ হাউজগুলোয় নতুন বিও খোলা হয়েছিল ২০ হাজারের ওপরে। অন্যদিকে বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে নতুন হিসাব হয়েছিল প্রায় ২৬ হাজার।
এ প্রসঙ্গে মডার্ন সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খুজিস্তা নূর-ই-নাহারীন বলেন, ‘তুলনামূলক সেকেন্ডারি মার্কেট থেকে প্রাইমারি মার্কেটের প্রতি সবার আগ্রহ বেশি থাকে। কারণ এখান থেকে বেশি মুনাফা করা যায়। এ কারণেই বাজারে আইপিওর প্রস্তাব থাকলে বিও হিসাব বাড়ে। তবে সম্প্রতি এর উল্টো চিত্র দেখা গেছে।
আগামীতে এ পরিস্থিতি বদলে যাবে বলে তিনি অভিমত প্রকাশ করে তিনি বলেন, বিশ্বের সব পুঁজিবাজারেই উত্থান-পতন আছে। এটা খুবই স্বাভাবিক।
এদিকে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করলে বিএসইসির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, বিনিয়োগকারী বেনামে অনেক অ্যাকাউন্ট পরিচালনা করেন এ কথা সত্যি। কিন্তু এই বিষয়ে কোনো আইন না থাকায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয় না। তবে একই অ্যাকাউন্ট থেকে কেউ একাধিক আবেদন করলে আমরা তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে থাকি।
তথ্যমতে, এপ্রিল শেষে যার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৭ লাখ ৮১ হাজার ৭৩৬টি। বর্তমানে সচল বিও’র মধ্যে সারা দেশে পুরুষদের ২০ লাখ ৩২ হাজার ৭৩৯টি এবং নারীদের বিও হিসাব সাত লাখ ৩৬ হাজার ৮৫০টি। আর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে চালু আছে ১২ হাজার ১৪৭টি বিও এবং প্রবাসীদের রয়েছে এক লাখ ৬৩ হাজার ৩৮৮টি।
২০১০ সালের পর থেকে মূলত বিনিয়োগকারী ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের পুঁজিবাজারের প্রতি অনাগ্রহ তৈরি হয়। ওই ধসের পর বাজার ছাড়তে শুরু করেন অনেকে। পুঁজিবাজারমুখী হননি আগ্রহী নতুন বিনিয়োগকারীরাও। যে কারণে একেবারে থমকে যায় বিও হিসাব খোলা। ২০১২ সাল থেকে ধীরে ধীরে বিও বাড়তে থাকে। পরবর্তীকালে আবারও বিও খোলার প্রবণতা থমকে যায়।
এর আগে সময়মতো বিও ফি না দেওয়ায় গত বছর বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে দেড় লাখের বেশি বিও হিসাব। সংশ্লিষ্টদের মতে, প্রধানত দুই কারণে এবার অসংখ্য বিও বাতিল হয়েছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে দীর্ঘদিন থেকে বাজারের মন্দা পরিস্থিতি; অন্যটি প্রাইমারি মার্কেট থেকে বিনিয়োগকারীদের সুবিধা না পাওয়া। যে কারণে বিনিয়োগকারীরা ৫০০ টাকা দিয়ে বিও নবায়ন করেননি। ফলে এসব হিসাব বাতিল হয়ে গেছে।
সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) ডিপোজিটরি (ব্যবহারিক) প্রবিধানমালা ২০০৩-এর তফসিল-৪ অনুযায়ী বিও হিসাব পরিচালনার জন্য ডিপোজিটরি অংশগ্রহণকারী বা বিনিয়োগকারীকে নির্ধারিত হারে বার্ষিক হিসাবরক্ষণ ফি দিয়ে হিসাব নবায়ন করতে হয়। এর আগে পঞ্জিকাবর্ষ হিসেবে প্রতি বছর ডিসেম্বরে এই ফি জমা নেওয়া হতো। তবে ২০১০ সালের জুন মাসে বিএসইসি বিও হিসাব নবায়নের সময় পরিবর্তন করে বার্ষিক ফি প্রদানের সময় জুন মাস নির্ধারণ করে। এ সময়ে বিও নবায়ন ফি ৩০০ থেকে বাড়িয়ে ৫০০ টাকা করা হয়। এরপর বিএসইসির জারি করা ২০১১ সালের ১৮ এপ্রিল এক সার্কুলারে ৩০ জুনের মধ্যে বিও হিসাব নবায়নের বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়। না হলে তা বাতিল করা হবে বলে ওই সার্কুলারে বলা হয়েছিল।