নিজস্ব প্রতিবেদক: গত সপ্তাহে পরপর চার দিন পুঁজিবাজারের সূচকের পতন দেখেছেন বিনিয়োগকারীরা। চলতি সপ্তাহেও সেই ধারা অব্যাহত রয়েছে। অর্থাৎ টানা ছয় কার্যদিবস নি¤œমুখী রয়েছে বাজার। এই ছয় দিনের মধ্যে গতকাল দেখা গেছে সবচেয়ে বড় পতন। এতে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন বিনিয়োগকারীরা। এ ধারা অব্যাহত থাকলে অবস্থা করুণ হবে বলে মন্তব্য করেন তারা।
এদিকে বাজারের এই পরিস্থিতির জন্য প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের শেয়ার বিক্রির চাপ বা সেল প্রেসার টনিক হিসেবে কাজ করছে বলে মনে করছেন কেউ কেউ। বাজারে গুজব রয়েছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থাসহ প্রভাবশালীদের নির্দেশে বর্তমানে বাজারে বড় ধরনের সেল প্রেসার তৈরি হয়েছে, যার প্রভাব পড়েছে সার্বিক পুঁজিবাজারে। এতে আতঙ্কিত হয়ে শেয়ার ছেড়ে দিচ্ছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। ফলে বাজার নিম্নমুখী হচ্ছেন।
অন্যদিকে এতদিন বাজার ভালো থাকায় সম্প্রতি অনেক প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী মুনাফা তুলে নিয়েছেন। তারা এখন বাজারে নতুন বিনিয়োগ করছেন না। এসব বিনিয়োগকারীরা শেয়ারদর আরও কমার অপেক্ষায় রয়েছেন বলে জানা যায়। যে কারণে বাজারে ক্রেতার আকাল দেখা দিয়েছে। ফলে বাজারে বড় পতন দেখা যাচ্ছে।
সূত্রমতে, সম্প্রতি বিএসইসি কিছু প্রতিষ্ঠানকে জরিমানার আওতায় এনেছে। তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে কিছু প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। এর মধ্যে রয়েছে কিছু মার্কেট প্লেয়ারদের বিনিয়োগ থাকা প্রতিষ্ঠান। এতে যাদের মার্কেটে বড় বিনিয়োগ রয়েছে কিংবা যারা মার্কেট প্লেয়ার হিসাবে কাজ করছেন তারা অভিমানে বিনিয়োগ বন্ধ রেখেছেন, যার প্রভাবে বাজার নিম্নমুখী রয়েছে।
এদিকে বর্তমানে বিভিন্ন কোম্পানি থেকে লভ্যাংশ ঘোষণা আসছে। বাজার-সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন বেশিরভাগ কোম্পানিই লভ্যাংশে খুশি করতে পারছেন না বিনিয়োগকারীদের। নিয়মানুযায়ী বাজারে যখন এ ধরনের লভ্যাংশ ঘোষণা আসে তখন বাজার নিম্নমুখী থাকে।
অন্যদিকে গুজব রয়েছে দীর্ঘদিন বাজার ভালো থাকার কারণে বাজার খেলোয়াড়রা তাদের মুনাফার মাধ্যমে ফায়দা হাসিল করেছেন। ইতোমধ্যে তারা বেশি দরে শেয়ার বিক্রি করেও দিয়েছে। এখন এই চক্রটি সক্রিয় রয়েছে বাজার ফেলে দিতে। ফলে বাজার পড়ে যাওয়ায় তাদের ইশারা রয়েছে বলে মনে করছেন পুঁজিবাজার-সংশ্লিষ্টরা।
গত ছয় কার্যদিবসে পুঁজিবাজারের সূচক কমেছে মোট ২৭০ পয়েন্ট। এম মধ্যে গতকালই সূচক কমেছে ৮৯ পয়েন্ট, যা মোট সূচকের এক শতাংশের বেশি। ছয় কার্যদিবস আগে ডিএসইর প্রধান সূচক ছিল সাত হাজার ৩৬৭ পয়েন্টে। গতকাল তা স্থির হয়েছে সাত হাজার ৯৭ পয়েন্টে।
এদিকে এক দিনে এক শতাংশের বেশি সূচক হ্রাস পাওয়ার ঘটনায় বিনিয়োগকারীদের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, তারা ভেবেছিলেন কয়েকদিন পতনের পর পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়াবে। তবে গতকালও তাদের আরও বড়পতন দেখতে হয়েছে। বহুজাতিকসহ বড় বড় প্রতিষ্ঠানের শেয়ারে ক্রেতার আকাল থাকায় কমেছে তালিকাভুক্ত সিংহভাগ প্রতিষ্ঠানের শেয়ারদর। পাশাপাশি উল্লেখযোগ্যহারে কমে গেছে লেনদেন এবং সূচক। একইভাবে কমে গেছে বাজার মূলধন। গতকাল এক দিনেই বাজার মূলধন কমে গেছে ছয় হাজার কোটি টাকা। আর গত ছয় দিনের ব্যবধানে বাজার মূলধন কমেছে ১৩ হাজার কোটি টাকা।
গতকাল লেনদেনের শুরুতে কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী ছিল সূচক। এই সময়ে বাড়তি ছিল অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ারদর। কিন্তু বেলা গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে এই পরিস্থিতি বদলে যেতে থাকে। বেশিরভাগ কোম্পানির শেয়ারেই বিক্রয় চাপ বাড়তে থাকে। যার ফলশ্রুতিতে ক্রেতা সংকট তৈরি হয়। এর জের ধরে কমে যায় শেয়ারদর।
বাজারে তালিকাভুক্ত বহুজাতিক কোম্পানি ম্যারিকো, লিন্ডে বিডি, রেনেটা, বিট্রিশ আমেরিকান টোব্যাকো, বার্জার পেইন্টসসহ বেশিরভাগ কোম্পানির শেয়ারেরই বিক্রেতার চেয়ে ক্রেতার সংখ্যা ছিল কম। লেনদেন শুরুর কিছু সময় পর থেকে শেষ পর্যন্ত এভাবেই লেনদেন চলতে থাকে। ফলে দিন শেষে হ্রাস পায় অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ারদর।
এ প্রসঙ্গে মো. শহিদুল ইসলাম নামে একজন বিনিয়োগকারী বলেন, গত পাঁচ দিন বাজার নিম্নমুখী ছিল। আজ (গতকাল) বাজার ঘুরে দাঁড়াবে এমনটিই ভেবেছিলেন সবাই। কিন্তু আজকের পতনে আমার মতো অনেকেই শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। বাজারে দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা থাকবে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে কথা বললে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি ব্রোকারেজ হাউসের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, সম্প্রতি মার্কেট পরিস্থিতি বোঝা যাচ্ছে না। হঠাৎ করেই মার্কেট অস্বাভাবিক আচরণ করছে। এতে বোঝা যাচ্ছে কোনো একটি চক্র কৃত্রিমভাবে এমন কর্মকাণ্ড ঘটাচ্ছে। তিনি বলেন বাজারে যদি প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা সক্রিয় না থাকে তখন বাজারের অবস্থা এমনিতে খারাপ হয়।
অন্যদিকে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করলে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, কিছুদিন বাজার ভালো থাকায় এখন অনেকেই মুনাফা তুলছেন। সে কারণে বিক্রয় চাপ থাকা স্বাভাবিক। তবে এসব পরিস্থিতি বিনিয়োগকারীরা ভয়ে পেয়ে কম দরে শেয়ার বিক্রি করে দেন। এটা ঠিক নয়। বিনিয়োগকারীদের এ ধরনের মানসিকতা পরিহার করা দরকার। যে কোনো পরিস্থিতি তাদের সামাল দেয়ার মানসিকতা থাকতে হবে।