মো. জিল্লুর রহমান: দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিদেশি ঋণ কতটা সহায়ক ভূমিকা পালন করে, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। বলা হয়, বিদেশি সাহায্য সেসব দেশেই কার্যকর, যেখানে ভালো অর্থনৈতিক, মুদ্রা ও বাণিজ্য নীতিমালা রয়েছে। অন্যপক্ষের যুক্তি হচ্ছে, বিদেশি সাহায্য কার্যকর হওয়ার সঙ্গে গ্রহীতা দেশের অর্থনৈতিক নীতিমালার কোনো সম্পর্ক নেই। সাম্প্রতিক সময়ে শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের মতো দেশগুলো উন্নয়নের নামে বিদেশ থেকে গৃহীত বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়ে অনেক সমস্যায় জর্জর এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো একে ‘বিদেশি ঋণের ফাঁদ’ বলে অভিহিত করছে। এক্ষেত্রে বিগত সরকারের সময় বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদরা উদ্বেগ প্রকাশ করে দেশি-বিদেশি ঋণ নিয়ে সরকারকে বারবার সতর্ক করেছিল, কিন্তু বিগত সরকার সেগুলো আমলে নেয়নি।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি যখন শেখ হাসিনা ক্ষমতা গ্রহণ করেন, তখন দেশি-বিদেশি ঋণের স্থিতি ছিল দুই লাখ ৭৭ হাজার কোটি টাকা। এরপর তিনি সাড়ে ১৫ বছর টানা ক্ষমতায় ছিলেন। আর এ সময়ে ঋণ ফুলেফেঁপে গিয়ে ঠেকেছে সাড়ে ছয় গুণে। অর্থনীতিবিদদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আমলে না নিয়েই একের পর এক মেগা প্রকল্পের নামে মেগা দুর্নীতি আর সেই দুর্নীতি আড়াল করতে তিনি দৃষ্টি দেন দেশি-বিদেশি ঋণের প্রতি। ফলে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর জনগণের ওপর রেখে যাওয়া শেখ হাসিনার তৈরি এই পর্বতসম ঋণের বোঝা সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে।
স্বাধীনতার পর দীর্ঘ ৩৭ বছরে যত সরকার এসেছে, তারা দেশি ঋণে খুব বেশি মনোযোগী ছিল না। অর্থনীতিবিদদের মতে, এর কারণ ছিল রিজার্ভ শক্তিশালী করা এবং দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্ত ভিত্তি দেয়া। তাছাড়া অভ্যন্তরীণ সোর্সের ঋণের রেট অব রিটার্ন অনেক বেশি এবং এতে দেশের বেসরকারি বিনিয়োগ কমে যায়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের তথ্য বলছে, ওই সময়ে দেশি-বিদেশি উৎস থেকে সরকার যে ঋণ নিয়েছে, ২০০৯ পর্যন্ত তার স্থিতি ছিল দুই লাখ ৭৭ হাজার কোটি টাকা, কিন্তু ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় শেখ হাসিনা দেশি-বিদেশি মিলিয়ে যে ঋণের বোঝা রেখে গেছেন, তা স্থানীয় মুদ্রায় ১৮ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকার সমান।
২০০৯ সাল পর্যন্ত ৩৭ বছরে যত সরকার এসেছে, সেখানে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারও ছিল। তিনি ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসেন এবং এরপর ২০০৯ সালে দুই লাখ ৭৬ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা ঋণের স্থিতি নিয়ে ক্ষমতায় এসে টানা চার মেয়াদে গড়ে তোলেন ঋণের পর্বত। বর্তমানে ঋণের যে স্থিতি আছে, তার মধ্যে বিদেশি ঋণের থেকে বেশি দেশি ঋণ। অর্থ মন্ত্রণালয় বলছে, গত সাড়ে ১৫ বছরের শেখ হাসিনার শাসনামলে দেশি-বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নেয়া হয়েছে ১৫ লাখ ৫৯ হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে দেশি-বিদেশি প্রায় ১৮ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা ঋণের মধ্যে আভ্যন্তরীণ ঋণ ১০ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা আর বিদেশি ঋণ আট লাখ এক হাজার কোটি টাকা।
অন্যদিকে, বিশ্বব্যাংকের ‘ইন্টারন্যাশনাল ডেট রিপোর্ট, ২০২২’ শীর্ষক এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত ১০ বছরে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ বেড়েছে তিনগুণেরও বেশি, অর্থাৎ মোট বৈদেশিক ঋণ ২০১১ সালের ২৭ দশমিক ০৫ বিলিয়ন ডলার থেকে ২৩৮ শাতংশ বেড়ে ২০২১ সালে দাঁড়ায় ৯১ দশমিক ৪৩ বিলিয়ন ডলার। প্রতিবেশী ভারতের বৈদেশিক ঋণ এই একই সময়ে বেড়েছে ৮৩ শতাংশ, পাকিস্তানের বেড়েছে ১০১ শতাংশ ও শ্রীলঙ্কার ১১৯ শতাংশ। বাংলাদেশে ২০২১ সালে দীর্ঘমেয়াদি বৈদেশিক ঋণ ছিল ৭০ দশমিক ০৪ বিলিয়ন ডলার, যা এক বছর আগে ২০২০ সালে ছিল ৬০ দশমিক ৪১ বিলিয়ন ডলার। এই ঋণের মধ্যে ৬২ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ পেয়েছে পাবলিক সেক্টর। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা গেছে, ২০২১-২২ অর্থবছরের শেষে দেশের মোট বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৫ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন ডলার। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০ সালে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের মজুত ছিল ৭৩ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার।
বিগত পতিত স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের সময় আমাদের দেশে উন্নয়নের নামে বিদেশ থেকে গৃহীত দেশের বৈদেশিক ঋণ বেড়েই যাচ্ছিল। এর মধ্যে সরকারি খাতের চেয়ে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বেশি বেড়েছিল। এর মধ্যে স্বল্পমেয়াদি ঋণ সবচেয়ে বেশি এবং এ ঋণের ঝুঁকিও অত্যধিক বেশি। সরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদি ঋণ কম, দীর্ঘমেয়াদি ঋণ বেশি। ইদানীং বৈশ্বিক মন্দায় টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বৃদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক বাজারে সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় এখন সরকারকে বাড়তি অর্থ পরিশোধ করতে হচ্ছে। ডলার সংকটে নিয়মিত ঋণ শোধ করতে না পারায় এর মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে। এতে ঋণের অর্থও বেড়ে যাচ্ছে। একদিকে ডলার সংকট, অন্যদিকে ঋণের বোঝা বেড়ে যাওয়ায় বৈদেশিক ঋণ এখন অর্থনীতির গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করতে গিয়েই ডলার সংকট আরও প্রকট হচ্ছে।
দেশের অর্থনীতিবিদরা মেগা প্রকল্পের নামে দেশি-বিদেশি উৎস থেকে লাগামহীনভাবে ঋণ নিয়ে জনগণের ওপর বোঝা চাপানোর ঘটনায় বরাবরই উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছিলেন। শেখ হাসিনা তাদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাকে আমলেই নেননি, বরং কখনও কখনও তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে তাদের বিদ্রুপ করেছেন। তিনি নিজের একক সিদ্ধান্ত ও তোষামোদকারীদের উৎসাহে বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ ও ঋণ গ্রহণে উৎসাহী ছিলেন। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্য অনুযায়ী, শেখ হাসিনার সরকার গত সাড়ে ১৫ বছরে দেশি-বিদেশি উৎস থেকে যত ঋণ নিয়েছেন, সুদসহ সে ঋণের কিস্তি শোধ করতে হবে আগামী বছর থেকেই। দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিয়ে যেসব প্রকল্প নেয়া হয়েছিল সেগুলোর মধ্যে রয়েছে—কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণ, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ প্রকল্প। এসব প্রকল্পের জন্য ভারত, চীন, রাশিয়াসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও দেশের কাছ থেকে কঠিন শর্তের উচ্চ হারের স্বল্পমেয়াদি ঋণ নিয়েছিল শেখ হাসিনা সরকার।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছেন ঠিকই, কিন্তু তিনি দেশ ও দেশের অর্থনীতিকে ডুবিয়ে গেছেন। দেশের অর্থনীতিকে ঋণের ফাঁদে ফেলে চরম ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছেন। ক্ষমতায় থাকাকালে গত সাড়ে ১৫ বছরে যেসব প্রকল্প নেয়া হয়েছে, তার সবগুলোই নেয়া হয়েছে অর্থ আত্মসাৎ ও লুটপাটের দিকটি সামনে রেখে। শেখ হাসিনার নেয়া প্রতিটি প্রকল্পব্যয় নিয়ে নানা মহলে প্রশ্ন আছে। তার নেয়া প্রতিটি প্রকল্পের নির্মাণব্যয় বিশ্বের যেকোনো দেশের চেয়ে বেশি। কোনো কোনো প্রকল্পের ব্যয় দ্বিগুণেরও বেশি। প্রকল্পগুলো দলীয় লোকদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করে বাস্তবায়নের মাধ্যমে এক দুর্নীতির মহোৎসবে মেতে উঠেছিলেন। এটি খুবই অস্বাভাবিক ঘটনা। অর্থনীতিবিদদের মতে, এর চেয়ে বড় আর্থিক কেলেঙ্কারি আর কিছুই হতে পারে না।
শেখ হাসিনার সরকার পদ্মা সেতু প্রকল্পে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার কাছ থেকে ঋণ পেতে ব্যর্থ হয়ে পরে অন্যান্য মেগাপ্রকল্পে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক ও জাপানের দাতা সংস্থা জাইকার মতো প্রতিষ্ঠান থেকে সরে এসে রাশিয়া, চীন ও ভারত সরকারের কাছ থেকে স্বল্পমেয়াদি ঋণের দিকে ঝুঁকে পড়ে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক ও জাপানের দাতা সংস্থা জাইকার মতো প্রতিষ্ঠানের ঋণ দীর্ঘমেয়াদি, সুদের হার তুলনামূলকভাবে কম, একটি নির্দিষ্ট গ্রেস পিরিয়ডের পর কিস্তি শুরু এবং অনেকটা স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় বাস্তবায়ন করা হয়। পক্ষান্তরে রাশিয়া, চীন ও ভারত সরকারের ঋণ স্বল্পমেয়াদি, সুদের হার বেশি, নানা শর্তের বেড়াজালে আবদ্ধ, গ্রেস পিরিয়ড নেই বললেই চলে এবং অনেকটা অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় বাস্তবায়ন করা হয়। এক্ষেত্রে দুর্নীতির যথেষ্ট সুযোগ থাকে।
যেমন গ্লোবাল ডিফেন্স কর্প নামের ওয়েবসাইটের বরাত দিয়ে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প থেকে শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের ৫০০ কোটি মার্কিন ডলার দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, রাশিয়ার সহযোগিতায় বিদ্যুৎকেন্দ্রটির নির্মাণে খরচ ধরা হয় এক হাজার ২৬৫ কোটি ডলার, যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি। এতে মালয়েশিয়ার একটি ব্যাংকের মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে এই প্রকল্প থেকে ৫০০ কোটি ডলার আত্মসাতের সুযোগ করে দেয় প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা রোসাট্রম।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, জবাবদিহি এড়িয়ে দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাৎ করতেই শেখ হাসিনা দাতা সংস্থার পরিবর্তে নির্দিষ্ট কিছু দেশ থেকে বিদেশি ঋণ এবং দেশীয় উৎস থেকে ঋণ নিয়েছেন। তাদের মতে, পদ্মা সেতুর প্রাক্কলিত ব্যয় ছিল মাত্র ১১ হাজার কোটি টাকা, অথচ সেটা ধাপে ধাপে বেড়ে ৩২ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হয়। বিশ্বব্যাংকসহ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থা মেগা প্রকল্পে ঋণ দিতে চাইলেও তারা দুর্নীতির অভিযোগে সটকে পড়ে। এটি শেখ হাসিনার কাছে সাপে বর হয়ে আসে। পরে দেশীয় খাত থেকে উচ্চ হারে ঋণ নিয়েই হাতে নেন মেগা দুর্নীতিগ্রস্ত সব প্রজেক্ট। আর তাতে শেখ হাসিনাকে আন্তর্জাতিক মহলের কাছে আর কোনো জবাবদিহি করতে হয়নি।
শেখ হাসিনার রেখে যাওয়া ঋণ বর্তমান সরকারের ওপর একটি বড় ধরনের বোঝা, যেখানে আগের পতিত স্বৈরাচারী সরকার নগদ টাকা ছাপিয়ে ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট মোকাবিলার চেষ্টা করেছে। এতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেছে। কিন্তু বর্তমান সরকার অর্থনীতিতে একটি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে। তবে এক্ষেত্রে দুর্নীতি বন্ধ করে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে পাচার হওয়া অর্থ যেমন ফেরত আনতে হবে, দেশের ভেতরে যারা দুর্নীতি করেছেন, তাদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এরই মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করে সহায়তার প্রতিশ্রুতি আদায় করেছেন। এতে দেশের রিজার্ভ যেমন একটি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়াবে, দেশের অর্থনীতি সচল হবে এবং দেশ দেশি-বিদেশি ঋণের ফাঁদ থেকে অনেকটা রেহাই পাবে।