নিজস্ব প্রতিবেদক: বিচারপতিদের অপসারণ ক্ষমতা সংসদ সদস্যদের হাতে ন্যস্ত সংক্রান্ত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায় বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ। গতকাল সোমবার প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন সাত বিচারপতির আপিল বেঞ্চ ঐকমত্যের ভিত্তিতে এ-সংক্রান্ত সরকারপক্ষের আপিল খারিজ করে রায় দেন।
‘সরকার বনাম অ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামান সিদ্দিকী ও অন্যান্য’ শীর্ষক আলোচিত এ মামলা রায়ের জন্য আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় এক নম্বর ক্রমিকে ছিল। সে অনুযায়ী সকাল ৯টায় আদালত বসার পর প্রথমেই এ রায় হওয়ার কথা ছিল। বিচারকরা এজলাসে প্রায় সোয়া এক ঘণ্টা দেরিতে আসার ফলে রায় ঘোষণায় কিছুটা বিলম্ব হয়। পরে জনাকীর্ণ আদালত কক্ষে সকাল ১০টা ২৫ মিনিটে রায় ঘোষণা করেন প্রধান বিচারপতি।
রায়ের পর রিট আবেদনকারীদের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘আপিল বিভাগে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল খারিজ হওয়ায় বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে থাকবে না। আগের মতোই বিচার বিভাগই বিষয়টি দেখবেন।’
এর আগে ১ জুন সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপিল শুনানি শেষে মামলাটি রায় ঘোষণার জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখা হয়। আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে চূড়ান্ত যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা।
গত ৮ মে ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপিল শুনানি শুরু হয়। ধারাবাহিকভাবে টানা ১১ দিন এ শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। আপিল শুনানিতে আদালতে মতামত উপস্থাপনকারী ১০ অ্যামিক্যাস কিউরির মধ্যে শুধু ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর পক্ষে মত দেন। অপর ৯ অ্যামিক্যাস কিউরি ড. কামাল হোসেন, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এমআই ফারুকী, আবদুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া, প্রাক্তন অ্যাটর্নি জেনারেল এএফএম হাসান আরিফ, ব্যারিস্টার এম আমিরুল ইসলাম, বিচারপতি টিএইচ খান, ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ, ফিদা এম কামাল, এজে মোহাম্মদ আলী সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর বিপক্ষে তাদের মতামত তুলে ধরেন। এর আগে ৮ ফেব্রুয়ারি ষোড়শ সংশোধনীর আপিল শুনানিতে অ্যামিক্যাস কিউরি নিয়োগ দেন আপিল বিভাগ।
গত বছরের ১১ আগস্ট সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে দেওয়া রায় সুপ্রিমকোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। পরে ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। একই বছরের ৫ মে বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী, বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি আশরাফুল কামালের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বিশেষ বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ বলে রায় ঘোষণা করেন। রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আইনসভার কাছে সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা রয়েছে। দেশের সংবিধানেও শুরুতে এ বিধান ছিল। তবে সেটি ইতিহাসের দুর্ঘটনা মাত্র।
আদালত রায়ে বলেন, বাংলাদেশের সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদের ফলে দলের বিরুদ্ধে সংসদ সদস্যরা ভোট দিতে পারেন না। তারা দলের হাইকমান্ডের কাছে জিম্মি। নিজস্ব কোনো সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষমতা নেই। ৭০ অনুচ্ছেদ রাখার ফলে সংসদ সদস্যদের সব সময় দলের অনুগত থাকতে হয়। বিচারপতি অপসারণের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও তারা দলের বাইরে যেতে পারেন না। যদিও অনেক উন্নত দেশে সংসদ সদস্যদের স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষমতা আছে।
রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আইনসভার কাছে সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা রয়েছে। দেশের সংবিধানেও শুরুতে এ বিধান ছিল। তবে সেটি ইতিহাসের দুর্ঘটনা মাত্র। রায়ে আরও বলা হয়, কমনওয়েলথভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর ৬৩ শতাংশের অ্যাডহক ট্রাইব্যুনাল বা ডিসিপ্লিনারি কাউন্সিলরের মাধ্যমে বিচারপতি অপসারণের বিধান রয়েছে।
রায়ের পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়, মানুষের ধারণা হলো, বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে থাকলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণœ হবে। সেক্ষেত্রে বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থা দুর্বল হয়ে যাবে। মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
রিটকারীপক্ষের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় এ রায়কে ঐতিহাসিক হিসেবে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, সর্বসম্মতিক্রমে আপিল খারিজ করে দিয়েছেন আদালত। আইনটি করে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে দেওয়া হয়েছিল, সেটা বেআইনি, অকার্যকর ও বাতিল হয়ে গেল। সংসদ পঞ্চদশ যে সংশোধনী করেছিল, সেখানে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে প্রটেক্ট করা হয়েছিল, সেটাই বহাল থাকলো।
অন্যদিকে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম রায়ে হতাশা প্রকাশ করে বলেন, ‘আমি অত্যন্ত হতাশ। আমাদের যে আশা ছিল, স্বপ্ন ছিল সংবিধানের মূল অনুচ্ছেদ ৯৬ তে ফিরে যাব, আজকে এ রায়ের ফলে সেটা আর হলো না। আমি অত্যন্ত দুঃখ অনুভব করছি, হতাশ হয়েছি। রাষ্ট্রপক্ষ এ রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করবে কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, সেটা এ মুহূর্তে বলা যাবে না। মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলাপ করে, সরকারের সঙ্গে আলাপ করে আমরা জানাব।’
আপিল বিভাগের এ রায়ের ফলে বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা আবার সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে ফেরত গেলো বলে মনজিল মোরসেদ মনে করলেও তার সঙ্গে একমত নন মাহবুবে আলম।
তিনি আরও বলেন, ‘আমার মতে যে সংবিধান সংসদ বাতিল করেছে, সেটা আপনা-আপনি পুনর্বহাল হবে না। আমার মতে, এ পরিস্থিতিতে শূন্যতা বিরাজ করছে। সংসদের কাজ তো আর আদালত করতে পারে না।’
উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা আইনপ্রণেতাদের হাতে ফিরিয়ে দিতে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধন বিল পাস হলে এ সংশোধনী বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ওই বছরের ৫ নভেম্বর হাইকোর্টে একটি রিট দায়ের করা হয়। পরে ২০১৬ সালের ১০ মার্চ চূড়ান্ত শুনানি শেষে ৫ মে মামলার রায় দেন হাইকোর্ট। বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী, বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি আশরাফুল কামালের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বিশেষ বেঞ্চে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করা হয়।
Add Comment