বন্ধুদের সঙ্গে গল্প ও আড্ডায় ঘিরে থাকে ভালোবাসা। আর মনমাতানো সুরে দূরে কোথাও ঘুরে বেড়ানোর অনুভূতি শব্দে প্রকাশ করা যায় না সব সময়। উপরন্তু সে বেড়ানো যদি হয় একই বিভাগের বন্ধুদের সঙ্গে, তাহলে যেন সোনায় সোহাগা ভালো লাগাটা একটু ব্যতিক্রমই হয়।
বলছিলাম জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের একদল ভ্রমণপ্রিয় তরুণদের কথা। তারা সুযোগ পেলেই দেশের সুন্দর ও ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন মনে প্রশান্তি আনতে, ভালো লাগা থেকে। সেদিন আমরা কয়েকজন গিয়েছিলাম সিলেটের রাতারগুল ও বিছানাকান্দিতে।
এ দুই স্থানের নাম শুনলে যে কারোরই যেতে ইচ্ছা করবে। আমাদের লক্ষ ছিল সারা রাত জার্নি করে পরদিন ঘুরে রাতে রাজধানীতে ফিরে আসা। বিভাগের বন্ধু কাওসার, সেতু, জুলিয়া তানহা, ফেরদৌস, অভি ও আমি মিলে রওনা করি সিলেটের উদ্দেশে। তীব্র যানজট অতিক্রম করে কমলাপুর রেলস্টেশনে পৌঁছালাম। টিকিট নিলাম শোভন চেয়ারে। রাত ১০টায় ট্রেন যাত্রা করল সিলেটের উদ্দেশে। ট্রেনের ঝকঝক শব্দের সঙ্গে যুক্ত হয় আমাদের গান, মনমাতানো গান। গানে গানে সারা রাত সবাইকে জাগিয়ে রাখলাম। এভাবে চলতে চলতে কখন যে ভোর ঘনিয়ে এলো টেরই পেলাম না। ট্রেন থেকে দেখতে পেলাম দু’দিকে পানি। বিলের মধ্যে সাদা শাপলা ফুল, উঁকি দিচ্ছে সকালের সূর্য। এ এক দারুণ অনুভূতি। ভোর সাড়ে ৫টায় ট্রেন পৌঁছাল সিলেট স্টেশনে।
ট্রেন থেকে নেমে পায়ে হেঁটে সুরমা নদীর ব্রিজ পার হলাম। এরপর সিলেটের জিন্দাবাজার হয়ে সিলেট এয়ারপোর্ট সড়কÑদু’দিকে চা বাগান, কী সুন্দর
নয়নাভিরাম পরিবেশ! সিলেট শহর থেকে প্রায় দেড় ঘণ্টা পর পৌঁছালাম পীরের বাজার নৌঘাটে। এখানে পৌঁছে অবাক হয়ে যাই। প্রকৃতি কী অপরূপ সাজে সেজেছে। পাহাড়, মেঘ ও আকাশ এক হয়ে আছে।
নৌঘাটে গিয়ে পরিচয় হলো ঢাকার আরও তিন পর্যটকের সঙ্গে। তারাও আমাদের মতো বেড়াতে এসেছেন। আমরা ৯ জন মিলে একটি নৌকায় রওনা হলাম। প্রথমে পাহাড়গুলোকে কাছে মনে হয়েছিল। ছোট নদী। এগিয়ে চলছে ইঞ্জিনচালিত নৌকা। দু’দিকের দৃশ্য অনেক সুন্দর। আর দূরের পাহাড়গুলো যেন ক্রমান্বয়ে দূরে চলে যাচ্ছে। দেড় ঘণ্টা পর বিছানাকান্দিতে গিয়ে পৌঁছাই। পাহাড়, পানি, আকাশ ও পাথর নিয়ে বিছানাকান্দি। আমাদের সিলেট ও ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সীমান্তবর্তী স্থান এটি। এখান থেকে প্রায় ১০০ গজ দূরে লাল পতাকা দেখা যায়, যেখান থেকে ভারতের জলপ্রপাতগুলো চোখে পড়ে। সেখান থেকে ছোট-বড় পাথর বেয়ে পানি নেমে আসে বিছানাকান্দিতে। অর্থাৎ বিছানাকান্দি যেন পাথরের বিছানা। বর্ষাকালে ভরা যৌবন লাভ করে পুরো স্থানটি। আর শীতকালে শুকিয়ে যায়।
ক্যামেরা-হাতে কয়েকজন উদীয়মান ফটোগ্রাফার দেখতে পেলাম। তারা দর্শনার্থীদের টাকার বিনিময়ে ছবি তুলে দেন। কে কার ছবি তুলবে, তা নিয়ে তারা প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। পরে আমরা ৯ জন মিলে তিনজনকে ঠিক করলাম ছবি তোলার জন্য। ছবি তুলতে তুলতে সীমান্তের কাছাকাছি চলে যাই। এরপর ফিরে আসি পীরের বাজার ঘাটে। সিএনজিচালিত অটোরিকশায় চড়ে পরের গন্তব্য রাতারগুলের উদ্দেশে রওনা করি। চারদিকে গাছগাছালির সারি। দেখতে দেখতে প্রায় এক ঘণ্টা পর রাতারগুল মোটর ঘাটে আসি। বেলা তখন ৪টা। এখানে একটি রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার সারি। পরে ঘাট থেকে ছয়জনে মিলে এক হাজার টাকা দিয়ে ডিঙ্গি নৌকা ভাড়া করি। ছলাত ছলাত এগিয়ে চলছে নৌকা চাঙরাই খাল দিয়ে। সঙ্গে যোগ হলো মাঝির গান।
রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্টে রয়েছে বেত, মুত্রা ও হিজল গাছ। পানির ওপর গাছ ভেসে রয়েছে, এ দৃশ্য মনোমুগ্ধকর। একটু পর আমরা ওয়াচ টাওয়ারের সামনে আসি। সবাই ওয়াচ টাওয়ারে উঠে পড়ি। এখান থেকে রাতারগুলের পুরো বন ও দূরে ভারতের উঁচু পাহাড়গুলো দেখা যায়। কিছুক্ষণ এখানে কাটিয়ে আবার নৌকায় চড়ি। পরে আবারও মোটরঘাটে। এবারের গন্তব্য হজরত শাহজালাল (রহ.)-এর মাজার। মাজার জিয়ারত করি আমরা। পরে বহুল কাক্সিক্ষত পানসি রেস্টুরেন্টে রাতের খাবার খেয়ে কদমতলী বাসস্ট্যান্ডে এলাম। আনন্দঘন মুহূর্তগুলো সত্যিই খুব তাড়াতাড়ি এভাবে শেষ হয়ে যায়।
জুলিয়া তানহা বলেন, পরবর্তী সময়ে কোনো এক অবেলায় মনে পড়ে যাবে রাতারগুলের সে মনোরম সুন্দর চিত্র। চোখে ভাসবে ভালোবাসায় ঘেরা বন্ধুর মুখ।
আমজাদ হোসেন ফাহীম