কাজী সালমা সুলতানা: ১০ ডিসেম্বর ১৯৭১। এদিন মিত্রবাহিনী ঢাকার পথে হেলিকপ্টারে ৫৭নং ডিভিশনের সৈন্যদের মেঘনা নদী অতিক্রমে অভিযান চালায়। পাকসেনারা ভৈরব বাজার ব্রিজ ধ্বংস করে নদীর পশ্চিম পাড়ে অবস্থান নেয়। মিত্রবাহিনীর বিমান হামলায় রেডিও ঢাকা স্তব্ধ হয়ে যায়। তিনটি ট্রান্সমিটারই বোমার আঘাতে গুঁড়িয়ে যায়। সম্মিলিত বিমানবাহিনী আজও বারবার ঢাকার চারদিকে পাকসেনাদের ঘাঁটিতে আক্রমণ চালায়।
সম্মিলিত বাহিনী বিভিন্ন কৌশলে এগোতে থাকে। জনগণের অপূর্ণ সহযোগিতায় মেঘনা পার হয় সুসজ্জিত মিত্রবাহিনী। একদল আসে ভৈরব বাজার থেকে ঢাকার মূল রাস্তায়, অন্যদল ময়মনসিংহ থেকে এগিয়ে আসে। দুদিক থেকে সাঁড়াশি আক্রমণে পড়েছে পাকবাহিনী। এদিন বোমাবর্ষণ চলে চট্টগ্রাম ও চালনা বিমানবন্দরে।
এদিনে ময়মনসিংহ, মাদারীপুর, ভোলা ও নড়াইল পাক-হানাদার মুক্ত হয়। উল্লেখ্য, ময়মনসিংহ শহরে পাকসেনারা ডাকবাংলো, কেওয়াটখালী, বড়বাজার, নিউমার্কেট, কালীবাড়ি ও সাহেবআলি রোড এলাকায় বহু নিরীহ সাধারণ লোককে হত্যা করে। স্বাধীনতার পর ময়মনসিংহ এলাকায় ১২টি বধ্যভূমি পাওয়া যায়।
যুদ্ধে পরাজয়ের আশঙ্কায় লে. জেনারেল নিয়াজি পালানোর পাঁয়তারা করে। তার এই গোপন অভিসন্ধি বিবিসি ফাঁস করে দেয়। সে সময় স্বীয় দুর্বলতা ঢাকার জন্য নিয়াজি ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে দম্ভ করে বলেন, কোথায় বিদেশি সাংবাদিকরা, আমি তাদের জানাতে চাই, আমি কখনও আমার সেনাবাহিনীকে ছেড়ে যাব না।
এদিন গভর্নর মালিকের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি ও মুখ্য সচিব পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসার মুজাফফর হোসেন ক্যান্টনমেন্টে জেনারেল নিয়াজির সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেন এবং ঢাকায় জাতিসংঘের প্রতিনিধির কাছে ‘আত্মসমর্পণের’ আবেদন হস্তান্তর করেন। এই আবেদন ঢাকায় জাতিসংঘের প্রতিনিধি পল মার্ক হেনরির হাতে দেয়া হয়। পাকিস্তনি মহলে বার্তাটি মালিক-ফরমান আলি বার্তা হিসেবে পরিচিতি পায়।
এদিন সম্মিলিত বাহিনী উত্তরাঞ্চলের যুদ্ধে সর্বাত্মক সাফল্য অর্জন করে। মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী যৌথ অভিযান চালিয়ে দিনাজপুর, রংপুর ও সৈয়দপুরের পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। যৌথবাহিনী এই তিন শহরের মধ্যে রংপুর ও দিনাজপুর জেলা সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত করে। রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী জামালপুর গ্যারিসন ছেড়ে পালিয়ে ঢাকার দিকে যাত্রা শুরু করে। তারা ঢাকার কাছে এসে মিত্রবাহিনীর মুখোমুখি হয়। এখানে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধে প্রায় এক হাজার ৫০০ পাকিস্তানি সৈন্য হতাহত হয়।
ঢাকায় ব্ল্যাক আউট চলছে। এদিন দিবাগত রাতে আলবদর বাহিনীর গুপ্তঘাতক দল দৈনিক ইত্তেফাকের কার্যনির্বাহী সম্পাদক সিরাজুদ্দিন হোসেন ও পিপিআই’র প্রধান প্রতিবেদক সৈয়দ নাজমুল হককে তাদের বাসভবন থেকে অপহরণ করে। পরে আর তাদের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
এদিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী নয়াদিল্লিতে বলেন, যুদ্ধবিরতি-সংক্রান্ত জাতিসংঘের আহ্বান ভারত প্রত্যাখ্যান করেনি বা গ্রহণও করেনি। প্রস্তাবটি সরকারের বিবেচনাধীন রয়েছে। তিনি বলেন, পরিস্থিতির তখনই উন্নতি হবে, যখন বাংলাদেশ তার নিজস্ব সরকার গঠন করবে এবং এক কোটি শরণার্থী ভারত থেকে দেশে ফিরে যাবে। এদিকে ১০ ডিসেম্বর শত্রুমুক্ত জেলা যশোরের দায়িত্ব গ্রহণ করেন ডেপুটি কমিশনার ওয়ালিউল ইসলাম।
এদিন পাবনা জেলার সুজানগর বাজারের কালীমন্দিরে ঘটে এক নির্মম হত্যাযজ্ঞ। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সুজানগর বাজারের প্রখ্যাত ব্যবসায়ী মানিকদি গ্রামের অজিত কুণ্ডু একই গ্রামের আবদুল হামিদ ও সুজানগর থানাসংলগ্ন কালীমন্দিরে অবস্থানকারী কৃষি কর্মকর্তা গোপালচন্দ্র ভাদুরীকে ধরে এনে কালীমন্দিরের সামনে নির্মমভাবে হত্যা করে মন্দিরের পাশের একটি কুয়ার মধ্যে লাশ ফেলে দেয়। এই কুয়াই তাদের সমাধিতে পরিণত হয়। এছাড়া এদিন ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার কুতুবা ইউনিয়নের মানিকা গ্রামের আনুমানিক ২৫ জনকে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী।
এদিন ভারতীয় বাহিনীর মেঘনা অতিক্রমের সংবাদ লাভের পর যেকোনো মূল্যে এই অগ্রাভিযান রোধ করে সপ্তম নৌবহরকে বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী করার মতো সময় লাভের উদ্দেশ্যে ভারতীয় সৈন্য ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার শর্ত ছাড়াই ‘যে যেখানে আছে সে ভিত্তিতে’ নিশ্চল যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার ব্যাপারে ভারতকে সম্মত করানোর জন্য ব্রেজনেভের ওপর চাপের মাত্রা বাড়ানো হয়। তাকে জানানো হয়, ভারত যদি এরপরও সম্মত না হয়, তবে যুক্তরাষ্ট্র নিজেই এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে ও সপ্তম নৌবাহিনী পাঠানোসহ শক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
তথ্যসূত্র: মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ও মূলধারা ৭১