কাজী সালমা সুলতানা: ১১ ডিসেম্বর, ১৯৭১। মুক্ত যশোরের জনসভায় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজুদ্দীন আহমদ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। এগুলো হলো যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, ২৫ মার্চের পূর্বেও মালিকদের সম্পত্তি ফেরত দান, সব নাগরিকের সম-অধিকার এবং চারটি রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধকরণ। এদিন মুক্ত হয় জামালপুর, ময়মনসিংহ, হিলি, গাইবান্ধা, ফুলছড়ি, বাহাদুরাবাদ, পিসপাড়া, দূর্গাদীঘি, বিলগ্রামও চন্দ্রীপুড়। বিভিন্ন গ্রামের শত শত পাকিস্তানি সেনা আত্মসমর্পণ করে।
এ দিকে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে উত্থাপিত বাংলাদেশে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব মেনে নেয়ার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জোর দাবি জানায়। হোয়াইট হাউজের মুখপাত্র রোনাল্ড জিগলার বলেন, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের প্রস্তাব মেনে নেয়া ভারত-পাকিস্তান উভয়ের জন্যই অত্যাবশ্যক। তিনি জানান, প্রেসিডেন্ট নিক্সন এ বিষয়ে নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা কিসিঞ্জারের সঙ্গে পরামর্শ করেছেন।
যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদর বাহিনীকে পরাজিত করে মুক্তিবাহিনী দেশের বিস্তীর্ণ এলাকা মুক্ত করে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা অব্যাহত রাখে। দিনাজপুরের হিলি সীমান্তে মিত্রবাহিনী প্রচণ্ড প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে এখানে তুমুল লড়াই অব্যাহত থাকে। সন্ধ্যায় বগুড়া-রংপুর মহাসড়কের মধ্যবর্তী গোবিন্দগঞ্জে পাকিস্তানি বাহিনীর শক্তিশালী ঘাঁটিতে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী সম্মিলিতভাবে সাঁড়াশি আক্রমণ চালায়। সারারাত যুদ্ধের পর পাকিস্তানি বাহিনী ভোরের দিকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।
এদিকে জামালপুর গ্যারিসনে সম্মিলিত বাহিনীর কাছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অস্ত্র সমর্পণ করে। জামালপুরের পূর্বে হালুয়াঘাট এলাকায় প্রচণ্ড সংঘর্ষের পর পাকিস্তানি বাহিনীর আর একটি ব্রিগেড প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে অস্ত্র গোলাবারুদ ফেলে টাঙ্গাইলের দিকে পালিয়ে যেতে শুরু করে। পলায়নের সময় শত্রুবাহিনী রাস্তার সব বড় বড় সেতু ধ্বংস করে দিয়ে যায়। অপরদিকে ময়মনসিংহে অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনীর আর একটি বিগ্রেড শহর ত্যাগ করে টাঙ্গাইলে তাদের প্রতিরক্ষামূলক ঘাঁটিতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। সম্মিলিত বাহিনী রাতে বিনা প্রতিরোধে জামালপুর দখলে নেয়।
এদিন জাতিসংঘের অনুরোধে বিদেশি নাগরিকদের ঢাকা ত্যাগের ব্যবস্থা করতে সকালে মিত্রবাহিনীর বিমান হামলা সাময়িকভাবে স্থগিত রাখা হয়। মূল উদ্দেশ্য ছিল মিত্রবাহিনীর বিমান হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত বিমানবন্দর মেরামত করে বিমান ওড়ার সুযোগ করে দেয়া। সন্ধ্যায় মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী যুদ্ধবিরতি ও পাকিস্তানিদের ঢাকা থেকে অপসারণের ব্যবস্থা করার জরুরি আবেদন জানান।
ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন মুখপাত্র সাংবাদিকদের জানান, যদিও পূর্বাঞ্চলের যুদ্ধাবস্থা খুব ভালো নয় তারপরও আমাদের আত্মসমর্পণের প্রশ্নই ওঠে না।
এদিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢাকায় বিকাল ৩টা থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য সান্ধ্য আইন জারী করে।
একাত্তরের এদিন হিলি সীমান্তে যৌথবাহিনী প্রচণ্ড প্রতিরোধের মুখোমুখি পড়ে। মার্কিন সপ্তম নৌবিহারের টাস্কফোর্স বঙ্গোপসাগর অভিমুখে। মিত্রবাহিনী এগিয়ে চলছে। মৌলভীবাজারের পতন আর নরসিংদীতে যৌথবাহিনীর দখল প্রতিষ্ঠা হয়। এদিকে দেশের অধিকাংশ থানায় স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হয়।
সন্ধ্যায় গোবিন্দগঞ্জে হানাদার বাহিনীর শক্তিশালী ঘাঁটিতে আক্রমণ ও সারারাত যুদ্ধ শেষে ভোরে গোবিন্দগঞ্জের পতন ঘটে। জাতিসংঘের অনুরোধে বিদেশি নাগরিকদের স্থানান্তরের জন্য ঢাকা বিমানবন্দরে সাময়িক সময়ের জন্য বিমান হামলা স্থগিত হয়। যুদ্ধবিরতির জন্য প্রাদেশিক সরকারের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী জাতিসংঘ সদর দপ্তরে জরুরি বার্তা প্রেরণ করেন। জামালপুর ময়মনসিংহ, গাইবান্ধা, চণ্ডীপুর, টাঙ্গাইল, কুষ্টিয়া, ফুলছড়িহাট ও বাহাদুরবাদ ঘাটসহ মুক্ত হয় অবরুদ্ধ বাংলাদেশের ১২টি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর ছয় দিনব্যাপী অবরোধ ও প্রচণ্ড যুদ্ধের পর এদিন ভোরে জামালপুর হানাদারমুক্ত হয়। জামালপুর গ্যারিসনে অবস্থানকারী পাকিস্তানি বাহিনী ২১ বেলুচ রেজিমেন্টের ছয়জন অফিসার ও ৫২২ জন সেনা যৌথবাহিনীর আছে আত্মসমর্পণ করে। হানাদারদের মধ্যে নিহত হয় ২১২ জন আর আহত হয় ২০০ জন।
এদিন লে. জেনারেল নিয়াজি হঠাৎ ঢাকা বিমান বন্দরে হাজির হয়ে দম্ভ ভরে ঘোষণা করে যে, তিনি পালিয়ে যাননি। তার মৃত্যুর পূর্বে ঢাকা পতন হবে না। সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী তাজুদ্দীন আহমদ সহকর্মীদের সঙ্গে সদ্যমুক্ত যশোর পরিদর্শন করেন। বিপুল জনসমুদ্র জয় বাংলা ধ্বনি দিয়ে তাদের সংবর্ধনা জানায়। সেদিন টাইমস পত্রিকার এক সংবাদে বলা হয় মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম ও পিপলস্ ডেমোক্র্যাটিক পার্টিকে বেআইনি প্রতিষ্ঠান হিসাবে গণ্য করা হবে বলে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম যশোরে ঘোষণা করেন।
তথ্যসূত্র: মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ও ৭১-এর ১০ মাস।