কাজী সালমা সুলতানা: ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১। এদিন ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর চাঁপাইনবাবগঞ্জের মহানন্দা নদীর পাদদেশ রেহাইচরে সম্মুখযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে নিহত হন। মিত্রবাহিনী ঢাকা সেনানিবাসে বোমা হামলা করলে গভর্নর মালিক ইস্তফা দিয়ে তার দালাল মন্ত্রিপরিষদসহ ওঠে হোটেল ইন্টারকনে। মার্কিন সপ্তম নৌবহর বঙ্গবহর বাংলাদেশে এসেছে দারুণ উত্তেজনায় দালাল ও বিহারিদের মনে। তবু যুদ্ধ চলছে ঢাকার উপকণ্ঠে। মুক্তিবাহিনী ঢাকার দোরগোড়ায় পৌঁছে যায়।
এদিন রাতের অন্ধকারে বাঙালি বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, চিকিৎসক, বিজ্ঞানী, আইনজীবী, শিল্পী, দার্শনিক ও রাজনৈতিক চিন্তাবিদদের মিরপুর, রায়েরবাজার ও মোহাম্মদপুরের বধ্যভূমিতে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে আলবদর বাহিনী। সেদিন যাদের হত্যা করা হয়, তাদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষাবিদ ৯৯১ জন, সাংবাদিক ১৩, চিকিৎসক ৪৯, আইনজীবী ৪২, অন্যান্য (সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, শিল্পী ও প্রকৌশলী) ১৬। পাকিস্তানি জেনারেল রাও ফরমান আলির পরিচালনায় গভীর রাতে লোকচক্ষুর অন্তরালে এই বর্বর ঘটনা ঘটে।
এদিন চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, সুজানগর (পাবনা), পাঁচবিবি (জয়পুরহাট), তাড়াইল (কিশোরগঞ্জ), মোরেলগঞ্জ (বাগেরহাট)ও বগুড়া পাকিস্তানি হানাদারমুক্ত হয়।
এদিন যৌথবাহিনী ফরিদপুর থেকে ঢাকার পথে মধুমতি নদী অতিক্রম করে। অতি দ্রুত ঢাকা পৌঁছার জন্য মিত্রবাহিনী দুটি ব্রিগেড শত্রুর অবস্থান এড়িয়ে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে নদী পার হয়। স্থানীয় জনগণ মিত্রবাহিনী পারাপারের জন্য শত শত নৌকার বন্দোবস্ত করে সারারাত ধরে তাদের নদী পার করে।
১৪ ডিসেম্বর যৌথবাহিনীর একটি ব্রিগেড মানিকগঞ্জে পাকিস্তানি অবস্থানের ওপর আক্রমণ করে এবং মানিকগঞ্জকে শত্রুমুক্ত করে সাভারের দিকে এগিয়ে আসে। যৌথবাহিনী ঢাকার অদূরে তুরাগের পাড়ে পাকিস্তানি বাহিনীর মুখোমুখি হয়। শত্রুসৈন্যরা এখানে শক্তিশালী প্রতিবন্ধকতা গড়ে তোলে।
এদিন ঢাকার পশ্চিম-উত্তর সীমানা বরাবর চন্দ্রা-সাভার-মিরপুর অঞ্চল ধরে রাজধানীর দিকে এগিয়ে আসতে থাকে যৌথবাহিনীর আরেকটি ব্রিগেড। ঢাকার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে শীতলক্ষ্যার পাড়ে ডেমরায় যৌথবাহিনী পাকিস্তানি প্রতিরোধ ব্যূহের ওপর আঘাত হানে। আরেকটি দল শীতলক্ষ্যা পার হয়ে রূপগঞ্জ মুক্ত করে। যৌথবাহিনী গোমতী পার হয়ে মেঘনা তীরবর্তী বৈদ্যেরবাজারে অবস্থান নেয়। চট্টগ্রাম সেক্টরে মুক্তিবাহিনী কুমিরা ঘাঁটির পতন ঘটিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের দিকে যাত্রা শুরু করে।
এদিন হানাদার বাহিনীর একটি দল মিয়ানমার পালানোর পথে মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। জেনারেল মানেকশ’র বাণী প্রচারিত হয় রাও ফরমান আলির উদ্দেশে। জেনারেল মানেকশ বলেন, ‘আমার সৈন্যরা এখন ঢাকাকে ঘিরে ধরেছে এবং ঢাকার সেনানিবাস কামানের গোলার আওতায়। সুতরাং আপনারা আত্মসমর্পণ করুন। আত্মসমর্পণ না করলে নিশ্চিত মৃত্যু। যারা আত্মসমর্পণ করবে তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হবে এবং তাদের প্রতি ন্যায়সঙ্গত ব্যবহার করা হবে।’
দেশের বিভিন্ন এলাকায় এদিন শত শত পাকিস্তানি সেনা আত্মসমর্পণ করে। এক ময়নামতিতেই আত্মসমর্পণ করে এক হাজার ১৩৪ পাকিস্তানি সৈন্য। কুমিল্লার যুদ্ধরত ছিলেন তিন ভাই বদিউজ্জামান, করিমুজ্জামান ও শাহজাহান। মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে বড় ভাই বদিউজ্জামান তাদের ৯৮ রামকৃষ্ণ মিশন রোডের বাড়িটি মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটিতে পরিণত করেন। ১০ ডিসেম্বর ছোট দুই ভাই ঢাকায় এসে ভোররাতে বাড়িতে দেখা করতে আসেন। ১৩ ডিসেম্বর আলবদর বাহিনী তাদের ধরে নিয়ে যায় এবং পরে রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে তিন ভাইয়ের লাশ পাওয়া যায়।
এদিন পাকিস্তানি সেনারা দিনাজপুর থেকে সৈয়দপুরে পালিয়ে যায় এবং দিনাজপুর শত্রুমুক্ত হয়। এদিকে ঢাকা বিজয়ের প্রচণ্ড হামলা রাজধানীর চারদিকে। মিত্রবাহিনীর কামানের গোলা গিয়ে পড়ল ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে। গভর্নর মালিক সেদিন সকালেই ‘সমগ্র পরিস্থিতি’ বিবেচনার জন্য গভর্নর হাউসে মন্ত্রিসভার এক জরুরি বৈঠক ডাকেন। একটি পাকিস্তানি সিগন্যাল থেকে দিল্লির বিমান সদর দপ্তর জানতে পারে, ঢাকার গভর্নর ভবনে গভর্নরের মন্ত্রিসভার বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। ওই বৈঠক চলাকালেই মেঘালয়ের শিলং বিমান ঘাঁটি থেকে প্রেরিত অর্ধডজন মিগ-২১ গভর্নর ভবনে রকেট আক্রমণ চালায়। বিমান হানা শেষ হওয়ার পর তারা পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেয়। গভর্নর ডা. মালিক আত্মসমর্পণের অনুমতি চেয়ে ইসলামাবাদে জেনারেল ইয়াহিয়ার কাছে জরুরি তারবার্তা পাঠান। কিন্তু ইয়াহিয়া উভয়ের অনুরোধ নাকচ করে দিয়ে জানান, নিশ্চয়ই চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহর পাকিস্তানকে রক্ষার জন্য হস্তক্ষেপ করবে। ‘অপেক্ষা করো এবং যুদ্ধ চালিয়ে যাও।’
তথ্যসূত্র : মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, মূলধারা ৭১ ও বাংলাপিডিয়া