Print Date & Time : 19 June 2025 Thursday 11:57 am

বিজয়কেতন

কাজী সালমা সুলতানা: ১৯৭১ সালের ১৯ ডিসেম্বর। এই দিনে গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানী উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয় ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হলেও কাশিয়ানীর ভাটিয়াপাড়ায় স্বাধীন বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকা ওড়ে ১৯ ডিসেম্বর সকালে। ১৯৭১ সালের মে মাসে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ৬৫ সেনার একটি গ্রুপ এখানে অবস্থান করে এলাকার নিরীহ মুক্তিকামী মানুষের ওপর নির্যাতন, নিপীড়ন ও গণহত্যা চালায়। অনেক মুক্তিকামী মানুষকে হত্যা করে তাদের লাশ মধুমতী নদীতে ভাসিয়ে দেয়।

এদিন ভোরে নড়াইল, গোপালগঞ্জ ও ফরিদপুরের দিক থেকে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডাররা সম্মিলিতভাবে ভাটিয়াপাড়া ক্যান্টনমেন্টে আক্রমণ চালান। মুক্তিযোদ্ধাদের এই সাহসী যুদ্ধে ১৯ ডিসেম্বর মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে ৬৫ পাকিস্তানি সেনা আত্মসমর্পণ করে। ঈশ্বরদীতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধে ৩৩ মুক্তিযোদ্ধার আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে ঈশ্বরদী পাকিস্তানি সেনা মুক্ত হয়।

এদিন দিবাগত রাতে পাকিস্তান বেতারে প্রেসিডেন্ট পদে ইয়াহিয়া খানের ইস্তফা দানের বার্তা ঘোষিত হয়। বার্তায় বলা হয়Ñ‘আগামীকাল প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার গঠনের সঙ্গে সঙ্গে তিনি ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলি ভুট্টো নিউইয়র্ক থেকে এখন দেশের পথে রয়েছেন এবং তিনি নতুন সরকার গঠন করবেন বলে মনে করা হচ্ছে।’

পাকিস্তান বিমানবাহিনীর সাবেক প্রধান এয়ার মার্শাল আসগর খান রাওয়ালপিন্ডিতে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে ‘আহাম্মক’ হিসেবে অভিযুক্ত করেন। তিনি ইয়াহিয়া ও তার দোসর জেনারেলদের প্রকাশ্য বিচার দাবি করেন। এদিকে ঢাকা থেকে ফিরে ব্রিটিশ এমপি জন স্টোনহাউস বলেন, পাকিস্তানি বাহিনী বাংলাদেশে গণহত্যা চালিয়েছে এবং এসব নৃশংসতার দৃশ্য তিনি দেখতে পেয়েছেন। তিনি আরও জানান, একজন মেজর জেনারেলসহ ছয় পাকিস্তানি অফিসার হত্যার জন্য দুই হাজার বাঙালি বুদ্ধিজীবীর তালিকা তৈরি করা হয়।

ডেইলি টেলিগ্রাফ সংবাদদাতা ক্লেয়ার হলিংওয়ার্থ ঢাকা থেকে আবার চালু হওয়া প্রথম আন্তর্জাতিক টেলিফোন যোগাযোগের মাধ্যমে ওই পত্রিকাকে জানান, বাংলাদেশ সরকার যুদ্ধাপরাধী হিসেবে সাবেক গভর্নর ডা. আবদুল মালিকের বিচার করতে পারে। রাতে কড়া পাহারায় তাকে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয়।

১৯ ডিসেম্বর ঢাকা সেনানিবাসের গলফ মাঠে অস্ত্র সমর্পণ করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩০ হাজার সৈন্য। তাদের পক্ষে নেতৃত্ব দেন মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি। মিত্রবাহিনীর পক্ষে ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল সগৎ সিং তাদের অস্ত্র গ্রহণ করেন। জেনারেল নিয়াজি সেই অস্ত্র সমর্পণ অনুষ্ঠানে ছিলেন না। আগের দিন তাকে হেলিকপ্টারে করে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে সরিয়ে নেয়া হয়।

দেশের সর্বত্র বিজয়োল্লাস চলছিল। সঙ্গে ছিল স্বজন হারানোর বেদনা। সবাই চেষ্টা করছেন একে অপরের খোঁজ নিতে। উদ্বেগ বাড়তে থাকে বঙ্গবন্ধুর অবস্থানের বিষয়ে।

এদিকে বিপ্লবী বাংলাদেশ সরকারের সেক্রেটারি জেনারেল রুহুল কুদ্দুসের নেতৃত্বে স্বল্পসংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারীর উপস্থিতিতে ঢাকার কেন্দ্রীয় সেক্রেটারিয়েট প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু হয়। ঢাকার অফিস-আদালত খুলতে শুরু করে। এদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হল (সাবেক ইকবাল হল) প্রাঙ্গণে ছাত্রলীগের একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়।

প্রায় ৯ মাস দীর্ঘ এক রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধের পর সারাদেশের প্রশাসন, অর্থনৈতিক অবকাঠামো, কৃষি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষাসহ প্রতিটি ক্ষেত্রেই তখন বিপর্যস্ত অবস্থা। আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর শক্তি ছিল নামমাত্র। দেশের আয়তন ও সমস্যার তুলনায় বাংলাদেশের নিজস্ব সৈন্যবলও ছিল অতিশয় নগণ্য। দেশের অফিস-আদালত ছিল জনশূন্য। ডাক বিভাগ সম্পূর্ণ বন্ধ, তার বিভাগ প্রায় অচল। অসংখ্য সেতু ও কালভার্ট বিধ্বস্ত হওয়ায় রেল ও সড়কপথে যোগাযোগ প্রতি পদে বিঘিœত হলো। যান্ত্রিক জলযানের প্রায় সবগুলোই জলমগ্ন অথবা বিধ্বস্ত। দেশের সব ব্যাংক বন্ধ ৩ ডিসেম্বর থেকে। প্রচলিত মুদ্রার আইনগত কোনো মূল্য নেই। স্বর্ণ ও বৈদেশিক মুদ্রা তহবিল কোনো কিছুরই অস্তিত্ব নেই। কল-কারখানা সব বন্ধ। বন্দর অচল ও বহির্বাণিজ্য নিশ্চল। অন্যদিকে পাকিস্তানি নির্যাতনের কবল থেকে জীবন ও সম্ভ্রম রক্ষার প্রচেষ্টায় দেশের ভেতরেই তখন দেড় থেকে দুই কোটি লোকের উদ্বাস্তু দশা। ভারতে আশ্রয় লাভকারী এক কোটি শরণার্থীকেও সেখানকার সাধারণ নির্বাচনের আগে স্বদেশে ফিরিয়ে আনার তাগিদ ছিল। প্রায় আড়াই থেকে তিন কোটি লোকের পুনর্বাসন ছিল দেশের জরুরি সমস্যাগুলোর মধ্যে সর্ববৃহৎ। খাদ্যশস্যের ঘাটতি ৪০ লাখ টন বলে অনুমিত। স্বাধীনতা অর্জনের অব্যবহিত পরে বাংলাদেশের দিগন্ত ছিল এমনই ঘোর অমানিশায়।

তথ্যসূত্র: মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ও মূলধারা ৭১