Print Date & Time : 19 June 2025 Thursday 12:53 am

বিজয়কেতন

কাজী সালমা সুলতানা: ১৯৭১ সালের ২৩ ডিসেম্বর কুমিল্লা জেলার হোমনায় বড় ঘাগুটিয়া স্বাধীন হয়। মুক্তিবাহিনী তাদের ক্যাম্প হিসেবে বড় ঘাগুটিয়ার জামে মসজিদটি ব্যবহার করে।

এদিন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ সরকারি কর্মচারীদের উদ্দেশে বলেন, বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলার যে রূপরেখা তৈরি করে রেখেছেন, বৈপ্লবিক দৃষ্টিভঙ্গি ও নতুন উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে ঠিক সেভাবে দেশ গড়ে তুলতে আত্মনিয়োগ করার জন্য সরকারি কর্মচারীদের তিনি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, বাংলাদেশের কর্মচারীদের কর্মতৎপরতায় লালফিতার স্থান নেই। যারা স্বেচ্ছায় প্রত্যক্ষভাবে দখলদার বাহিনীকে গণহত্যা পরিচালনায় সহায়তা করেছে, তাদের কখনও ক্ষমা করা হবে না। অন্যান্য যুদ্ধবন্দিদের মতো তাদেরও বিচার করা হবে। তিনি আরও বলেন, অন্যায়ভাবে কাউকে শাস্তি প্রদান করা হবে না। ৯ মাসের ক্ষতি দুই মাসে পূরণ করতে হবে অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য। তিনি সবাইকে অক্লান্ত পরিশ্রম করার আহ্বান জানান। তিনি ঢাকা সচিবালয়ের সব অফিসার ও কর্মচারীদের সমাবেশে ঘোষণা করেন, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাÑএই তিন নীতির ওপর ভিত্তি করে দেশকে গড়ে তোলা হবে। সচিবালয়ের বক্তৃতায় সরকারি প্রশাসনের সর্বাত্মক সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই মুক্তিযুদ্ধে যারা প্রাণ দিয়েছেন তারা সংগ্রাম করেছিলেন। আইনের শাসন ও ব্যক্তিস্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি সব ধরনের বৈষম্য চিরতরে বন্ধ করতে এবং একমাত্র সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই এ দেশের সব মানুষের জীবিকা নিশ্চিত করা সম্ভব। তাজউদ্দীনের এসব  ঘোষণা প্রায় সর্বাংশেই ছিল আওয়ামী লীগের ঘোষণাপত্রের অধীন। দেশের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার মৌল রূপান্তরের জন্য ১৯৭০ সালের নির্বাচনী ঘোষণাপত্রে আওয়ামী লীগ যেসব লক্ষ্য অর্জনের প্রতিশ্রুতি দেয়, সে সম্পর্কে দলীয় নেতাদের প্রভাবশালী একাংশের মনোভাব ছিল নেতিবাচক।

সত্তরের নির্বাচনে জনসাধারণ বিপুল ভোটে আওয়ামী লীগকে জয়যুক্ত করার পর সেগুলোর বাস্তবায়ন করা ছিল স্থানীয় সরকারের জন্য বাধ্যতামূলক। তিনি এসব লক্ষ্য অর্জনের উপায় হিসেবে স্বাধীনতার সমর্থক রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রতিষ্ঠিত ঐক্যবোধকে জাতীয় পুনর্গঠনের কাজে সংহত ও সক্রিয় করা এবং দেশের তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের ঐক্যবদ্ধ ও কার্যকর শক্তিতে রূপান্তর করার সংকল্প প্রকাশ করেন। এর আগে ১৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশ মন্ত্রিসভা সব সদস্যদের সমবায়ে জাতীয় মিলিশিয়া গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বাস্তব পরিস্থিতির আলোকে ওই পরিকল্পনায় প্রয়োজনীয় সংশোধনের পর ২৩ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার তালিকাভুক্ত ও তালিকাবহির্ভূত সব মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে জাতীয় মিলিশিয়া গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

এদিন চট্টগ্রামের কুখ্যাত মুসলিম লীগ নেতা ফজলুল কাদের চৌধুরী গ্রেপ্তার হন। তাকে নৌবাহিনী দপ্তরে আটকে রাখা হয়। তার গুডস হিলের বাড়ি মুক্তিযোদ্ধারা দখল করে সেখানে ক্যাম্প বসান। ৭ জানুয়ারি দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত বিবরণ অনুযায়ী ফজলুল কাদের চৌধুরী সপরিবারে ১৮ ডিসেম্বর কর্ণফুলী দিয়ে বঙ্গোপসাগর দিয়ে বার্মা যাচ্ছিলেন। আনোয়ারার পালকি বরাবর এলে তিনি লঞ্চের চালককে মাইনভীতির কারণে পাড়ের কাছ দিয়ে লঞ্চ চালাতে বলেন। চালক চালাকি করে তাকে বহনকারী লঞ্চ ডুবোচরে আটকে দিয়ে বলেন, লঞ্চ ছাড়তে কিছু লোক আনতে হবে। চালক লঞ্চ থেকে নেমে কিছু বিচ্ছু (মুক্তিযোদ্ধা) নিয়ে আসেন। বিচ্ছুরা (মুক্তিযোদ্ধারা) ফজলুল কাদের চৌধুরীর পরিবারসহ এক পাক মেজরকে নামিয়ে নিয়ে আসেন। পরে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল তাদের আটক করে নিয়ে যায়। তার কাছে তখন দেড় মণ সোনা ও সাত লাখ রুপি ছিল।

তথ্যসূত্র: মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ও মূলধারা ৭১