কাজী সালমা সুলতানা: ২৮ ডিসেম্বর ১৯৭১। এদিন হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকার লন্ডন অফিসের সংবাদে প্রকাশ করা হয়, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি কনফেডারেশন গঠনের প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। এ ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট ভুট্টোর সঙ্গে আলোচনার জন্য শেখ মুজিবুর রহমানকে রাওয়ালপিন্ডি নেয়া হয়েছে। আলোচনায় অংশগ্রহণের জন্য ভুট্টো চীনা ও মার্কিন প্রতিনিধিকেও আমন্ত্রণ জানান। আরও বলা হয়, ২২টি দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার ব্যাপারে এরই মধ্যে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।
জাতীয় পরিষদ সদস্য ও ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি সামসুদ্দিন মোল্লা এক বিবৃতিতে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর দোসর জামায়াতে ইসলামীর কুখ্যাত আল-বদর, আল-শাম্স ও রাজাকার কর্তৃক পরিচালিত ব্যাপক গণহত্যার বিচার অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্যে স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল গঠনের দাবি জানান। তিনি বলেন, দখলদার পাকবাহিনীর দোসররা ঢাকার সাহিত্যিক, সাংবাদিক, অধ্যাপক ও বুদ্ধিজীবীদের অপহরণ করে নিয়ে যায় এবং তাদের প্রায় সবাই খুনিদের হাতে প্রাণ হারান।
তিনি আরও বলেন, শিল্পী, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের এই অমানুষিক ও লোমহর্ষকভাবে হত্যা করার ঘটনা ফেরাউন, নমরুদ ও হিটলারের বর্বরতাকেও ছাড়িয়ে গেছে। সারাবিশ্ব এসব প্রতিভার হত্যাকাণ্ডে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে পড়েছে। সোনার বাংলার বুদ্ধিজীবী সমাজকে নির্মূল করাই ছিল দখলদার বাহিনীর সর্বশেষ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য। তাদের পৈশাচিক অভিযানের শিকারে পরিণত হয়েছেন ইত্তেফাকের কার্যনির্বাহী সম্পাদক প্রখ্যাত সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন, দৈনিক সংবাদের শহীদুল্লাহ কায়সার, পিপিআই’র নিজামুদ্দিন আহমদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী এবং আরও অনেকে।
এদিন ভুট্টো বেশ নাটকীয়ভাবে সাংবাদিকদের বলেন, এইমাত্র শেখ মুজিবের সঙ্গে কথা বলে এলাম, নিরাশ হইনি। ভুট্টোর এই টালবাহানার ভেতর ঢাকায় বঙ্গভবনে অনুষ্ঠিত প্রথম সংবাদ সম্মেলনে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে মুক্তি দেয়ার জন্য ভুট্টোর প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতিকে এক মিনিটও আটক রাখার অধিকার ভুট্টোর নেই। ভুট্টো যদি জনগণের ভালো চান, তাহলে তার বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে স্বীকার করে নেয়ার মতো বাস্তব মনোভাব ও সাহসিকতা থাকা প্রয়োজন। তিনি শেখ মুজিবের মুক্তির জন্য চাপ সৃষ্টি করতে বিশ্বসংস্থাগুলোর প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, কোন ক্ষমতাবলে ভুট্টো প্রেসিডেন্ট তা তিনি জানেন না। তিনি ভুট্টোকে পূর্ব পাকিস্তান পুনর্দখলের রঙিন স্বপ্ন ত্যাগ করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, যতদিন মানবসভ্যতা থাকবে, ততদিন বাংলাদেশ বেঁচে থাকবে। তিনি বলেন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন যদি তাদের মনোভাব পরিবর্তন করে বাংলাদেশের বাস্তবতাকে মেনে নেয়, তাহলে বাংলাদেশ সরকার এ দুটি দেশের সঙ্গে সম্পর্ক বিবেচনা করবে। তিনি দুই দেশের জনগণের প্রশংসা করে বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে দুটি দেশের জনগণের সমর্থন ছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয় সমর্থনের জন্য তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর কেনেডি, সিনেটর সেক্সবি, সিনেটর ফ্রাঙ্কচার্চ, কংগ্রেস ম্যান কালাহান ও যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদপত্রগুলোর প্রতি ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয় সমর্থনের জন্য তিনি ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পোল্যান্ডের সরকার ও জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন।
এদিন ভারতের মেজর জেনারেল ও মুজিববাহিনী প্রধান সুজন সিং উবান বেগম মুজিবের সঙ্গে দেখা করেন। এ সময়ে তার সঙ্গে ছিলেন শেখ মণি, আব্দুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদ। ঢাকাস্থ সোভিয়েত কনসাল ডিএফ পোপোভ বেগম মুজিবের সঙ্গে দেখা করেন। তিনি বড়দিন উপলক্ষে সোভিয়েত জনগের পক্ষ থেকে বেগম মুজিবকে উপহার প্রদান করেন।
তথ্যসূত্র: মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ও মূলধারা ৭১