কাজী সালমা সুলতানা: ২৯ ডিসেম্বর ১৯৭১। এদিন ঢাকা প্রেস ক্লাবে অনুষ্ঠিত বুদ্ধিজীবীদের এক সভায় ফ্যাসিস্ট আল-বদর বাহিনী কর্তৃক বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞের রহস্য উদ্ঘাটনে ‘বুদ্ধিজীবী হত্যা তদন্ত কমিটি’ নামে সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির প্রধান করা হয় প্রখ্যাত লেখক ও চিত্রপরিচালক জহির রায়হানকে। এক সরকারি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী আরও ১৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা হলেনÑ১. ঢাকা বেতার কেন্দ্রের সাবেক আঞ্চলিক পরিচালক সৈয়দ জিল্লুর রহমান, ২. পুলিশের সাবেক ডিআইজি মঈনুদ্দিন খান (মুক্তিযুদ্ধকালে করা তথাকথিত উপনির্বাচনের এমপিএ), ৩. ঢাকার তেজগাঁও এলাকার মো. জিএ খান, ৪. তথাকথিত উপনির্বাচনের এমএনএ জামায়াতে ইসলামের অধ্যপক এসএম ইউসুফ, ৫. গোপালগঞ্জের মুসলিম লীগ নেতা ওয়াহিদুজ্জামানের ভাই তাফায়েকুজ্জামান, ৬. জামালপুর মহকুমা কনভেনশন মুসলিম লীগের সম্পাদক অধ্যাপক গোলাম রব্বানী, ৭. ঢাকার শান্তিনগরের নুরুজ্জামান খান, ৮. ঢাকার মিরপুরের শাকিল আহমদ, ৯. সভিল আর্মড ফোর্সের সদস্য আনিস খান, ১০. ঢাকার মিরপুরের আনোয়ারুল হক, ১১. কুমিল্লার মতলবের মওলানা সফিউল্লাহ, ১২. কুমিল্লার ফরিদগঞ্জের শহিদুল্লাহ, ১৩. ঢাকার মিরপুরের আব্দুল কাইয়ুম, ১৪. অলিম্পিয়া টেক্সটাইল মিলের শরীফ খান, ১৫. ঢাকার মিরপুরের মো. ইউসুফ, ১৬. ঢাকার মিরপুরের রাজাকার মো. সিদ্দিক, ১৭. ঢাকার মানিকগঞ্জের শান্তি কমিটির সদস্য একেএম সিরাজুল ইসলাম ও ১৮. ঢাকার খোদাদাদ।
এদিন খিলগাঁও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ কার্যালয় আবার চালু উপলেক্ষ এক কর্মিসভায় প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, সর্বপ্রকার শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি চালু করাই সরকারের লক্ষ্য। বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতন্ত্রী দেশ হিসেবে পুনর্গঠনের জন্য সর্বশক্তি দিয়ে ও উদ্যমী হয়ে কাজ করতে তিনি জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ সাড়ে সাত কোটি মানুষের মুক্তি-সংগ্রামের শহীদদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ও শ্রদ্ধা নিবেদন করে বলেন, সরকার শহীদদের রক্ত বৃথা যেতে দেবে না। তিনি বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে বাংলাদেশের মানুষ সত্য, ন্যায়বিচার ও মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে মাত্র ৯ মাসে জয়ী হয়েছে। কোনো জাতি এত কম সময়ে স্বাধীনতা অর্জন করতে পারেনি, স্বাধীনতার জন্য এত রক্তের ঋণও পরিশোধ করেনি।
প্রধানমন্ত্রী বাঙালির মুক্তির সংগ্রামে অকুণ্ঠ সমর্থনের জন্য ভারতের ৫৫ কোটি অধিবাসী, ভারত সরকার ও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের জনগণ ও সরকারের প্রতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, আমাদের মুক্তি সংগ্রামের প্রতি রাশিয়ার দৃঢ় সমর্থনের ফলেই বাংলাদেশ বিশ্বযুদ্ধের শিকার হয়নি। স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিয়ে চিরকালের জন্য পঙ্গু হওয়া এবং বেসামরিক লোকদের পুনর্বাসনের জন্য সরকার বদ্ধপরিকর। প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান ও জোটনিরপেক্ষ নীতি পুনর্ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের যুবসমাজ স্বাধীনতার পুরোধা ছিল। তাদের নিরস্ত্র করা হবে না। তারা নিজেদের পেশায় ফিরে যেতে না চাইলে জাতীয় মিলিশিয়ার অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
পিটিআই এক খবরে জানায়, আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই পর্যায়ক্রমে প্রায় ৪৫ হাজার যুদ্ধবন্দিকে জাহাজযোগে ঢাকা থেকে ভারতে নেয়া হবে। এই যুদ্ধবন্দিদের মধ্যে নিয়মিত ও অনিয়মিত সৈন্য রয়েছে।
এদিকে চট্টগ্রামে ভারতীয় সেনাবাহিনীর জিওসি জগজিৎ সিং অরোরা, বিমানবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ড প্রধান এয়ার মার্শাল দেওয়ান, নৌবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ড প্রধান ভাইস অ্যাডমিরাল কৃষ্ণানের সম্মানে মুজিববাহিনী আয়োজিত এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ভারতীয় বাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের জিওসি জগজিৎ সিং অরোরা বলেন, সাড়ে সাত কোটি বাঙালির ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের ফলেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। তিনি আশা প্রকাশ করেন দেশের পুনর্গঠনে এবং অর্থনীতি পুনঃপ্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশিরা পাহারের মতো অটল থাকবে। তিনি বলেন, মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করায় ভারতীয় সেনাবাহিনী গর্বিত। তিনি বলেন, যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনর্গঠন এবং অর্থনীতি সচল করার জন্যই ভারতীয় বাহিনী এখনও রয়ে গেছে। তিনি বলেন, এত কম সময়ে কোনো জাতি স্বাধীনতা অর্জন করতে পারেনি এবং এত রক্ত দিয়েও কোনো দেশ স্বাধীনতা অর্জন করেনি। অনুষ্ঠানে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের বেসামরিক প্রশাসক নুরুল ইসলাম চৌধুরী তিন বাহিনীর কমান্ডারদের উদ্দেশে মানপত্র পাঠ করেন।
তথ্যসূত্র: মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ও সংগ্রামের নোটবুক।