বিজয়ের ৫১ বছর: প্রত্যাশা ও প্রাপ্ত

কণিকা রানী: বিজয় দিবস মানে আনন্দ এবং খুশির দিন। আমরা যখন যেই দিনে কোনো কাজে সফলতা লাভ করি তাহলে সেটা আমাদের বিজয়ের দিন। একজন খেলোয়াড় যেদিন জয়লাভ করে সেটা হচ্ছে তার বিজয় দিবস। তেমনি বাংলাদেশ দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধের পর জয়লাভ করে ১৬ ডিসেম্বর। এজন্য এটি আমাদের বিজয় দিবস। ‘বিজয়’ শব্দটির সঙ্গে জড়িয়ে থাকে অজস  ত্যাগ। অজস  ত্যাগের মধ্য দিয়েই বিজয়কে ছোঁয়া যায়। আমরা বাঙালি জাতিও বিজয় পেয়েছি মহা ত্যাগের বিনিময়ে। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ৩০ লাখ শহিদের তাজা রক্ত এবং দুই লাখ মা-বোনের ইজ্জত বিসর্জন দিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমরা অর্জন করেছি বিজয়, পেয়েছি লাল-সবুজের গৌরবান্বিত একটি পতাকা। স্বাধীনতা শব্দটি উচ্চারণ যতটা সহজ তার চেয়ে হাজার লক্ষ গুণ কঠিন সেটি অর্জন করা। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে অগণিত মানুষের প্রাণ বিসর্জন, ৩০ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি, সব মিলিয়ে অবর্ণনীয় ত্যাগের বিনিময়ে আমরা আমাদের স্বাধীনতাটুকু পেয়েছি। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ অঙ্কুরিত হয়েছিল পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের সময় তার পরিচর্যায় তা মহীরুহে পরিণত হয় এবং রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে ৩০ লাখ প্রাণের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঠিক দিক নির্দেশনায় যে দুর্লভ স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি তার সুফলই বা আমরা কতটুকু ঘরে তুলতে পারছি সেই দিকটিই স্বাধীনতার ৫১ বছরে এসে আমাদের আলোচ্য বিষয়। ৩০ লাখ শহিদের এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বিজয়, বাঙালি জাতির আজীবনের লালিত স্বপ্ন; শেকল থেকে মুক্ত হয়ে বিজয়ের মশাল ওড়াবার দিন। চিরকালব্যাপী বাঙালি জাতি বিজাতি-বিজিত, শাসিত-শোষিত ভাঙামনের; কালে কালে বাঙালিরা অন্যের দ্বারা যেমন নিগৃহের শিকার হয়েছে, তেমনি তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদও করেছে বারবার। এই দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনে স্বপ্ন যেমন ভেঙেছে, তেমনি আবারও নবোদ্যমে চলেছে স্বপ্ন গড়ার অবিরাম প্রচেষ্টা। বীরের জাতি বলে সমাদৃত বাঙালিরা তারই ধারাবাহিকতায় পশ্চিম পাকিস্তানিদের ক্রমাগত অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে তেজোদীপ্ত মানসিকতা নিয়ে। মায়ের ভাষার অধিকার রক্ষায় বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন বেনিয়া শাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের সূচনার ইতিহাস। বাংলার দামাল ছেলেরা বুকের তাজা রক্ত দিয়ে সেই অধিকারকে করেছে প্রতিষ্ঠিত।

বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশ-এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ ঘটেছে। জাতিসঙ্গের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন নীতিসংক্রান্ত কমিটি-সিডিপি এলডিসি থেকে বাংলাদেশের উত্তরণের যোগ্যতা অর্জনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছে। এলডিসি ক্যাটাগরি থেকে উত্তরণের জন্য মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ সূচক এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক এ তিনটি সূচকের যেকোনো দু’টি অর্জনের শর্ত থাকলেও বাংলাদেশ তিনটি সূচকের মানদণ্ডেই উন্নীত হয়েছে। জাতিসঙ্ঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিলের (ইকোসক) মানদণ্ড অনুযায়ী এক্ষেত্রে একটি দেশের মাথাপিছু আয় হতে হবে কমপক্ষে ১ হাজার ২৩০ মার্কিন ডলার, বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় তার থেকে অনেক বেশি। মানবসম্পদ সূচকে ৬৬ প্রয়োজন হলেও বাংলাদেশ অর্জন করেছে ৭২ দশমিক ৯। অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক হতে হবে ৩২ ভাগ বা এর কম; যেখানে বাংলাদেশের রয়েছে ২৪ দশমিক ৮ ভাগ। বাংলাদেশ এখন ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করে এগিয়ে যাচ্ছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকে আজকের এই উত্তরণÑযেখানে রয়েছে এক বন্ধুর পথ পাড়ি দেয়ার ইতিহাস। সরকারের রূপকল্প ২০২১ বাস্তবায়নের এটি একটি বড় অর্জন। এই অর্জনের অবদানও বিতর্কিত। কেউ বলতে চান তা সম্ভব হয়েছে, কেবল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে। আবার কারও মতে, তা দেশের খেটে খাওয়া কৃষক-শ্রমিকসহ উৎপাদনমুখী মানুষের ঘামের ফল।

আয়তনে ক্ষুদ্র হলেও বাংলাদেশ প্রাকৃতিক সম্পদ ও জনসম্পদে ধনাঢ্য। কৃষি খাতে অভূতপূর্ব কিছু সাফল্যের জন্য বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ বারবার আলোচিত হয়েছে। প্রায় ১৬ কোটি জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশ বর্তমানে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। বিগত বছরগুলোতে দেশে ধানের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৫০ লাখ মেট্রিক টন।

স্বাধীনতার ৫০ বছরে স্ব-অর্থায়নে পদ্মা সেতু, প্রশস্তকরণসহ মহাসড়ক সংস্কার, মেট্রোরেল, ট্যানেল, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট, রূপপুর পারমাণবিক প্ল্যান্ট, ওভার ব্রিজ, ফ্লাইওভার, অসংখ্য ব্রিজ-কালভার্ট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভবন, রেল উন্নয়ন, নৌপথ উদ্ধার, নতুন রাস্তা নির্মাণ ও পুরোনো রাস্তা সংস্কার, বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে সক্ষমতা লাভ করলেও জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়নি সাধারণ জনগণের। পূরণ হয়নি মৌলিক অধিকার

বর্তমান বিশ্বে বাংলাদেশ অপার সম্ভাবনাময় একটি দেশ। বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীতে এসে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে ধারাবাহিক অগ্রগতির চিত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে। এসব উন্নয়ন অগ্রগতির পর এখনও বাংলাদেশে আয়বৈষম্য অত্যন্ত প্রকট, স্বাধীনতার ৫০ বছরেও দুর্নীতির ভয়াল গ্রাস থেকে মুক্ত হতে পারেনি দেশ, রাজনীতিতে মূল্যবোধের সংকট, বিশ্ববিদ্যালয়ে মৌলিক গবেষণায় অনীহা, বেকার সমস্যা, অসহনশীল ছাত্র রাজনীতি, মাদকের করাল গ্রাস, উচ্চশিক্ষায় সনাতনী সিলেবাস অনুসরণ, আমদানিনির্ভর অর্থনীতি এবং সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতির চিত্রপট স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসে দেশের অগ্রযাত্রার পথে অন্যতম প্রতিবন্ধকতার রূপ পরিগ্রহ করেছে।

গণতন্ত্র নিয়ে প্রশ্ন দেশে-বিদেশে। দেশে খাদ্যদ্রব্যের মজুত নিয়ে সরকারি সন্তুষ্টি। বাজারে উল্টো চিত্র। মধ্যবিত্ত-নি¤œ মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের দুর্দশা-দুর্নীতির মধ্যে নাভিশ্বাস ওঠার খবর। বাজার অশান্ত। আসলে বাঙালির লড়াই শেষ হলো না। সেই সেøাগান : ‘লড়াই লড়াই লড়াই চাই/লড়াই করে বাঁচতে চাই।’ কখনও ব্রিটিশ, কখনও পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে লড়াই। কখনও মৃত্যুর বিরুদ্ধে জীবনের লড়াই। কখনও পেছন থেকে এগিয়ে যাওয়ার লড়াই। আবার কখনও পণ্যমূল্যের বিরুদ্ধে লড়াই। বাঙালির জীবন থেকে যেমন প্রকোপ গেল না, লড়াইও শেষ হলো না। বাঙালির জীবনে কোনো না-কোনো প্রকোপ থাকেই। প্রকোপই যেন বাঙালির নিয়তি। কখনও পাকিস্তানি শাসন-শোষণের প্রকোপ। কখনও ঝড়-বন্যা-খরা-জলোচ্ছ্বাসের প্রকোপ। কখনও মহামারির প্রকোপ। বাঙালির ইতিহাসই লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাস। এবার স্বাধীনতা দিবস উদযাপিত হচ্ছে করোনার মৃদু প্রকোপ আর পণ্যমূল্যের ভয়ংকর প্রকোপ আর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রকোপের মধ্য দিয়ে। তার তাপও নানাভাবে সহ্য করতে হচ্ছে আমাদের।

তাই দেশের চলমান অগ্রযাত্রাকে অব্যাহত রাখতে এবং জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা বাস্তবায়নে বিদ্যমান সমস্যার সমাধানপূর্বক যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে; আর সে জন্য দেশের সরকার, প্রশাসন, নাগরিকসমাজ এবং দলমত নির্বিশেষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। আর তাহলেই সম্ভব হবে সত্যিকারের ক্ষুধা, দারিদ্র্যমুক্ত, বৈষম্যহীন ও জ্ঞানভিত্তিক সোনার বাংলা নির্মাণ। বিজয়ের এই দিনে এসে তাই বাংলার ১৭ কোটি মানুষের প্রত্যাশা তাদের স্বপ্নের স্বদেশ নির্মিত হোক সমৃদ্ধ রূপে।

৫১তম বিজয় দিবসে আমাদের প্রার্থনা এবং প্রতিজ্ঞা হোক সব রকম লড়াই ও প্রকোপ মুক্তির। যুদ্ধ নয়, শান্তি হোক আমাদের আদর্শ। আমরা চাই একটি অপরাধমুক্ত, সন্ত্রাসমুক্ত, গডফাদার-মাফিয়ামুক্ত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। যুদ্ধমুক্ত একটি বাসযোগ্য বিশ্ব। বিশ্ব শান্তি ও সভ্যতা রক্ষার দায় নিতে হবে আমাদের সবাইকে। এবারের বিজয় দিবস সফল হোক, সার্থক হোক।    

শিক্ষার্থী, দর্শন বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০