কাজী সালমা সুলতানা: ৮ ডিসেম্বর ১৯৭১। এদিনে পাকিস্তানি হানাদার মুক্ত হয় মৌলবীবাজার, বরিশাল, ঝালকাঠি, চাঁদপুর, পিরোজপুরসহ বিভিন্ন এলাকা। মুক্ত জনপদবাসী স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িয়ে বিজয় আনন্দে মেতে ওঠে। অন্যদিকে অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এদিন এক বেতার ভাষণে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে ভারত ও ভুটানের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করতে বিশ্বের গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর কাছে আবেদন জানান।
এদিনে কুমিল্লার টাউন হল মাঠে বীর মুক্তিযোদ্ধা মিত্রবাহিনী জনতার উপস্থিতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। তৎকালীন পূর্বাঞ্চলের প্রশাসনিক কাউন্সিলের চেয়ারম্যান জহুর আহমেদ চৌধুরী, দলীয় পতাকা এবং কুমিল্লার প্রথম প্রশাসক অ্যাডভোকেট আহমদ আলী জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। কুষ্টিয়ার মিরপুর থানায় কমান্ডার আফতাব উদ্দিন খান ১৭০ মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা গান স্যালুটের মাধ্যমে উত্তোলন করেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং তারা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। ঢাকার দিকে পালানোর কোনো পথ তাদের ছিল না। এই সুযোগে ভারতীয় সেনাবাহিনীপ্রধান ফিল্ড মার্শাল শ্যাম মানেকশ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। তিনি আশ্বাস দেন, আত্মসমর্পণ করলে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতি জেনেভা কনভেনশন অনুসরণ এবং রীতি অনুযায়ী সম্মানজনক ব্যবহার করা হবে। মানেকশ’র এই আহ্বান ভারতীয় বেতারকেন্দ্র আকাশবাণী থেকে কয়েকটি ভাষায় বারবার প্রচার করা হয়। জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরাকে তিনটি কলাম নিয়ে ঢাকার দিকে দ্রুত অগ্রসর হওয়ার জন্য বলা হয় এবং একটি ব্রিগেডকে দ্রুত হালুয়াঘাটের দিক থেকে ময়মনসিংহের দিকে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। এদিন জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ বাংলাদেশে অবিলম্বে যুদ্ধ বিরতি পালন এবং সৈন্য প্রত্যাহারের জন্য ভারত ও পাকিস্তানের প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রস্তাব গ্রহণ করে। সাধারণ পরিষদে ভারতীয় প্রতিনিধি সমর সেন বলেন, পাকিস্তানের অবশ্যই বাংলাদেশকে স্বীকার করে নিতে হবে। উপমহাদেশে শান্তি পুনঃস্থাপনের জন্য আওয়ামী লীগপ্রধান শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিতে হবে। বাংলাদেশ সরকারের কাছে গ্রহণযোগ্য না হলে জাতিসংঘের কোনো প্রস্তাবই বাস্তবায়ন করা যাবে না।
বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে এদিন যুদ্ধের তীব্রতা বাড়তে থাকে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই হানাদার বাহিনীকে একের পর এক পরাজিত করতে থাকে মুক্তিবাহিনী।
ভারতীয় জেনারেল সগত সিং এদিন তার বাহিনী নিয়ে পূর্ব সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে পশ্চিম দিকে অভিযান শুরু করে। এর আগেই একটি অগ্রবর্তীদল আশুগঞ্জ ব্রিজের কাছে উপস্থিত হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৫৭ মাউনটেইন ডিভিশন ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌঁছায়। ভারতীয় সেনাবাহিনী পৌঁছার আগেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছেড়ে চলে যায়। ওদিকে মেজর শফিউল্লাহর নেতৃত্বাধীন এস-ফোর্স কোনো ধরনের প্রতিরোধ ছাড়াই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলে পৌঁছায়। এদিন সকালে আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। ৭ ডিসেম্বর সারারাত তিনদিকে মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনী কুমিল্লা বিমানবন্দরে পাকিস্তানি বাহিনীর ২২ বেলুচ রেজিমেন্টের ঘাঁটিতে আক্রমণ শুরু করে। পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানের ওপর মুক্তিসেনারা মর্টার শেল নিক্ষেপ ও আর্টিলারি আক্রমণ চালিয়ে শেষ রাতের দিকে তাদের আত্মসমর্পণ করাতে সক্ষম হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে ২৬ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এছাড়া এদিন বরিশাল ও মাদারীপুরও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দখল থেকে মুক্ত করে বিজয়ের পতাকা ওড়ান অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধারা।
তথ্যসূত্র: মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ও মূলধারা ৭১